আমি গা – শিউরে ওঠা এক ঝড়ের রাতের কথা বলব। সে এক বিভীষিকাময় ঝড়ের রাত। সে রাতে প্রায় মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়েছিল আমার শিয়রে।
আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেনির ছাত্র। বৈশাখ মাস সবে শুরু হয়েছে। মা – বাবাসহ বেড়াতে গেছি গ্রামে, নানার বাড়িতে। প্রচন্ড গরম পড়ছে। আমার নানি বলেন – কাঁঠাল পাকানো গরম। চারদিকে রুক্ষ – শুক্ষতা। মাটি ফেটে চৌচির। একদিন বিকেলে হঠ্যৎ উত্তর – পশ্চিম আকাশে কালো হয়ে মেঘ জমল। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। মাঝে মাঝে দমকা হাত্তয়ার ধাক্কা। সন্ধ্যা হতে না- হতেই সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। অজানা আশঙ্কায় সবাই তখন উদ্ভিগ্ন।
বাতাসের ঝাপটা উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।
মামা আবহাত্তয়ার খবর শোনার জন্য রেডিও অন করলেন। রেডিওর আত্তয়াজ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। মামা তবু রেডিওর সাথে কান লাগিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করছেন। আমার মামার কাছেই বসেছিলাম। হঠ্যৎ প্রচন্ড একটা ঝাপটা এল। আর বিকট শব্দে বাড়ির দরজার আমগাছের বড় ডালটি ভেঙে পড়ল। পাশে কোথাও যেন তীব্র শব্দে বাজ পড়ল। ভয়ে আর আতঙ্কে আমার বুক দুরুদুরু।
নানিবাড়িতে বিদ্যুৎ নেই হারিকেনের আলোয় সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম। সবার বিছানা তৈরি হল। কিন্তু কেউ আর ঘুমাতে পারল না। রাত প্রায় দশটা হবে। প্রচন্ড ঝড় আর শিলাবৃষ্টি শুরু হলো বাতাসের ঝাপটায় এক- একবার মনে হতে লাগল এই বুঝি পুরো ঘরটি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। পশ্চিমে কোণের ঘরের চাল হঠ্যৎ খুটি থেকে আলগা হয়ে গেল। ঝড়ো বাতাসে সেটা দাপাদাপি করতে লাগল। নানা কোথেকে একটা মোটা রশি নিয়ে খুটিটা বাধতে লেগে লেগে গেলেন। মামা ও বাবা দৌড়ে গেলেন সেখানে। অন্ধকারে ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় দেখলাম মামা আর বাবা প্রানপন চেষ্টা করছেন ঘরের চালের সঙ্গে খুটিটাকে বাধার জন্য কিন্তু পারছেন না। খাটের ওপর আমার মা, ছোটবোন ফারহানা, নানি সবাই আল্লাহ, আল্লাহ করতে লাগলেন।
এমন সময় প্রচন্ড শব্দে আমাদের মাথার ওপর থেকে ঘরের টিন উড়ে গেল। আমার নানি চিৎকার করে কেদে উঠলেন। নানির কান্নার শব্দে আমার বোন ফারহানা এবং আমার মা হাউমাউ করে কাদতে লাগলেন। গোয়ালঘরে গরুর হাম্বা ডাক, মানুষের আর্ত চিৎকার, বাতাসের ঝপটা – সব মিলিয়ে মেনে হলো যেন কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। নানা জোরে শব্দ করে আজান দিতে লাগলেন মামা চিৎকার করে বললেন সবাই খাটের তলে আশ্রয় নিলাম। এভাবে কতক্ষণ ঝড় চলেছে বুঝতে পারিনি। সকালে যখন আমার হুশ হলো তখনও আমি খাটের নিচে চারদিকে কাদাজল আমি যেন কাদতে ও ভুলে গেছি। আম্মা কোথায় নানি বা কোথায় গেল কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
খাটের নিচ থেকে আমি উঠে দেখলাম, ঘর কোথায় ঘর নেই। একটা নারকেল গাছ পড়ে আছে ঘরের ওপর। টিনের একটা চালা উড়ে গেছে কোথাও বরই গাছে ঝলছে একটা টিন। একটা ঘুঘুপাখি মরে পড়ে আছে উঠোনে। দৌড়ে গেলাম বাড়ির দরজার দিকে। দেখি কলাগাছ, সুপারিগাছ, কড়ই গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আছে পথের ওপর। বাব- মা, নানা- নানি, মামা সবাই সেগুলো পরিষ্কার করছে।
কালবৈশাখী ঝড়ের কথা এর আগে শুনেছিলাম। কিন্তু আমার নিজের কোনো অভিজ্ঞতা হলো ভাবলাম এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যেন কারও না হয়। এর মধ্যে চার বছর চলে গেছে কিন্তু আমার স্নৃতিতে আজও গেথে আছে সেই রাতের ভয়াবহতা। সে রাতের কথা মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে ঝড়ের প্রলয় তান্ডব, ভয়ংকর রূপ সে রাতে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। সেদিন ঝড়ের রাতে আমি বুঝেছি প্রকৃতির কোলে মানুষ কত অসহায় কত নি:স্ব।