সংগৃহীত ছবি
গরীব হল তারাই যাদের সব কিছুই খুব বেশি বেশি দারকার। কারন যাদের সবকিছুই বেশি বেশি লাগে তারা কখোনই জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট হয় না। এটা হোসনে মুহিকার কথা । প্রচলিত পুজিবাদি রাষ্ট্র পরিচালনার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যাতিক্রমি দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে তার ভূমিকা সত্যি অসামান্য। কোন দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমরা বুঝি কোন ভাব গাম্ভীর্যপূর্ন, অর্থসম্পদে প্রাচুর্যপূর্ন এবং মান আর যশে পরিপূর্ন কেও। পুরো পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে এমনটি ভাবা অসামান্য কিছু নয়। কিন্তু ব্যাতিক্রম শব্দটি সবসময় চিরাচায়িত নিয়মের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে। তেমনি এক ব্যাতিক্রমের জলজ্যান্ত উদাহরন হোসে মুহিকা। উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট বলা হলেও মেধা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর ফিলোসোফি জানার পর বুঝা যাবে, তিনিই বিশ্বর সবচেয়ে ধনী প্রেসিডেন্ট। তিনি ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৫ সালের ২০শে মে হোসে মুহিকা জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা দিবেত্রিয় মুহিকা ছিলেন একজন কৃষক আর মা লুসি কর্ডানো একজন ইতালিয় মাইগ্রেন্ট। মুহিকার বয়স যখন ৫ বছর, তখন তার বাবা মারা যান। আর তার সাথে সাথেই সংসারে নেমে আসে চরম দারিদ্রতা। এ সময় তিনি স্থানীয় এক বেকারির ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ শুরু করেন আর কখনো কখনো হোটেল বয় হিসেবেও কাজ করতেন । এসবের পাশা পাশি তিনি লিলি ফুল তুলেও সংসারের খরচ যোগাতেন। এভাবেই দারিদ্রের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে তার জীবন।
১৩ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত মুহিকা বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে স্যাইকেল চালিয়ে অনেক পুরস্কার জিতেন। কিউবান বিপ্লবের প্রতি সাড়া দিয়ে তিনি ১৯৬০ সালে উরুগুয়ে সরকারের বিরুদ্ধে এক গেরিলা মুভমেন্টে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে মন্টএভিডিওর কাছে পান্ড শহর দখল নিতে তিনি সফল গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেন। পরে উরুগুয়ের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট-এর সাংবাধানিক বিধিনিষেধের আওতায় তার জেল হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে তিনি অন্যান্য বন্দিদের সাথে জেলখানা থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু ১৯৭২ সালে তিনি আবার পুলিশের কাছে ধরা পরেন। ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুথানের পর তাকে ১৪ বছরের কারাদন্ড প্রদান করে আর্মি জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
১৯৮৫ সালে দেশে গণতন্ত্র পুনরউদ্ধার হলে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। তিনি ২০০৯ সালে নির্বাচলের মাধ্যমে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াই তিনি যতটা না আলোচিত হয়েছিলেন, তার জীবন যাপনের ধরন তাকে বিশ্ব মিডিয়ায় তাকে তার চেও বেশি আলোচনায় নিয়ে আসে। তবে বিশ্বের মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত উরুগুয়ের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে তার মাসিক বেতন মাত্র ১২ হাজার ডলার । কিন্তু বেতনের শতকরা ৯০ ভাগি তিনি দান করে দেন রাষ্ট্রিয় কোষাগারে এবং নিজের জন্য অবশিষ্ট রাখেন মাত্র ৭৭৭ ডলার। এই দানশীলতাই তাকে বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে।
তার স্ত্রীর নাম লুসিআও নিঃসন্তান এই দম্পতীর সবথেকে দামি সম্পত্তি হল, ১৯৮৭ সালে কিনা ১ হাজার ৮শ ডলারের একটি গাড়ী। হোসে মুহিকা বসবাস করতেন তার খামার বাড়িতে। শুধু দুইজন পুলিশ ছিলো তার বাড়ির নিরাপত্তায়। তার বাড়িটি ছিল রাজধানীর বাইরে কৃষি জমির সাথে সেখানে তিনি ও তার স্ত্রী মিলে ফুলের চাষ করতেন। পরিবারের খরচ চলতো স্ত্রীর আয় থেকে। বিলাশ বহুল প্রাসাদের পরিবর্তে তিনি নিত্যান্তই সাধারন ভাবে বাস করতেন। এমনকি তার যাবার পথটিও ছিল কর্দমাক্ত আর তিনি যে বাড়িটিতে থাকতেন তার মালিকও তিনি ছিলেন না তাদের সেই বাড়িটির মালিক ছিলেন তার স্ত্রী। প্রেসিডেন্ট হওয়া সর্তেও খামারে নিয়মিত কৃষি কাজ করতেন তিনি। তিনি নিজেকে সবসময় ঋন মুক্ত রেখেছেন। আর তাই তার নামে কোন ঋন নেই’ এমনকি তার নামে কোন ব্যাংক একাউন্টও নেই। তিনি নিজেকে একজন সাধারন মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাছন্দ বোধ করেন। তাকে আদর করে দেশবাসি ডাকেন এলপেপে।
২০১২ সালে তিনি সংবাদ শিরনাম হয়েছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট হিসেবে। উরুগুয়ে সরকারের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর সরকারী কর্মচারিদের সম্পদের হিসাব দেখানো বাধ্যতামূলক এর-ই ধারাবাহিকতায় তিনি তার সম্পদের পরিমান দেখান ১ হাজার ৮ শত মার্কিন ডলার। যা কিনা ১৯৮৭ সালে তার ক্রয় করা গাড়ীটির দাম। তিনি ২০১২ সালের বিবরনিতে স্ত্রীর অর্ধেক সম্পত্তি যুক্ত করেছেন। আর সেই সম্পদের মধ্যে রয়েছে জমি, ট্র্যাক্টর, বাড়ি ও জমির দাম। এতে তার মোট সম্পদের পরিমান দারিয়েছে ২ লক্ষ্য ১৫ হাজার ডলার। যা এখনো দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্টের ঘোষিত সম্পদের মাত্র ২ তৃতীয়াংশ । তার সবচেয়ে দামি সম্পদ তার কেনা গাড়ী কিন্তু সেটিও তিনি আর রাখতে চান না কারন তার জন্য তিনি ১ হাজার ডলারের অফার পেয়েছেন। তিনি এও বলেন যে গাড়ী বেচার কিছু অর্থ তিনি দান করতে চান। তিনি যখন ক্ষমতা থেকে অবসর নেন তখন তাকে বলা হয়েছিল পৃথিবীর সবথেকে বিনীত লোকটি আজ পদত্যাগ করছেন। আর এই ছিলো হোসে মুহিকার চরম চাওয়া আর চরম পাওয়া।