মেরি অ্যান বেভান একজন ব্রিটিশ নারী ছিলেন। যিনি বিংশ শতাব্দীতে “দ্যা আগলিয়েস্ট ওম্যান ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড” (বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত নারী) হিসেবে অভিভূত হয়েছিলেন।
তার জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী –
মেরি অ্যান ওয়েবস্টার ১৮৭৪ সালে লন্ডনে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তারা ৮(আট) ভাইবোন ছিলেন। তিনি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো সুস্থভাবেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমাদের সবার মতো ওনার জীবনও খুব স্বাভাবিক ছিলো। তিনি স্কুল ও মেডিকেলের পড়াশোনা শেষ করে, খুব কম বয়স থেকে হাসপাতালে নার্স হিসেবে চাকরি করতেন। মেরি অ্যান ওয়েবস্টার খুবই সুন্দরী একজন নারী ছিলেন। তিনি সবসময় নিজের একটি সুস্থ-সবল বড় পরিবারের স্বপ্ন দেখতেন। ওনার স্বপ্ন সত্যিতে পরিণত হয়েছিল।
১৯০৩ সালে ২৯ বছর বয়সে থমাস বেভানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। থমাস বেভানের নামানুসারে তার নাম হয় মেরি অ্যান বেভান। তাদের দুটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে মোট চারজন সন্তান ছিলো। তাদের জীবন খুবই সুখময় ছিলো।
তাদের জীবনের দুঃস্বপ্ন শুরু হয় ১৯০৬ সালে, যখন মেরি অ্যান বেভান খুবই বিরল একটি রোগে আক্রান্ত হন। মেরি অ্যানের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা প্রথমে এতটাও গুরুতর মনে হয় নি। প্রথমে মেরি অ্যানের কাছে তার বিয়ের আংটি ধীরে ধীরে টাইট লাগতে থাকে, তারপর তার জুতোর সাইজও বড় হতে থাকে। কিন্তু সন্তান জন্মদানের পর, আঙ্গুল এবং পা ফোলা খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিলো। তিনি পরিবার সামলানোর পাশাপাশি ঘরের অনেক কাজকর্মও করতেন। তাই ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা, হাতের অবশতা এই লক্ষণগুলো তার কাছে খুবই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। এজন্য তিনি এই পূর্ববর্তী লক্ষণগুলোতে বেশি একটা গুরুত্ব দেন নি।
কিন্তু কিছু সময় পর থেকে তার মুখের পরিবর্তনগুলো সবাই খেয়াল করে। তার কপালের হাড়, চোয়াল এবং নাক তুলনামূলকভাবে বড় হচ্ছিল। তার দাঁতগুলোর ফাঁকও ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাচ্ছিলো। ঐ সময় ডাক্তাররাও বুঝতে পারছিলেন না যে, মেরি অ্যানের সাথে কী হচ্ছিলো। তবে সময়ের সাথে সাথে তার শরীরে আরো কিছু নতুন লক্ষণ দেখা দিতে থাকে। মেরি অ্যানের হাত এবং পাগুলি অস্বাভাবিকভাবে বড় হতে থাকে। তার শরীরের চামড়ার পুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং রুক্ষ-শক্ত হতে থাকে। কন্ঠস্বর গম্ভীর এবং ফেসফেঁসে হতে থাকে। তার চেহারাও মারাত্মকভাবে বদলাতে থাকে। তার আগের সৌন্দর্যের কোনো চিহ্ন-ই বাকি ছিলো না। মেরি অ্যানের স্বাস্থ্যের অবস্থাও তখন খারাপ হতে থাকে। জয়েন্ট পেইন, দৃষ্টিশক্তি দুর্বলসহ আরো নানা সমস্যা দেখা দেয়।
অ্যাক্রোমেগালিঃ
মেরি অ্যানের যে রোগটি হয়েছিলো সেই রোগটির নাম হচ্ছে অ্যাক্রোমেগালি। এটি খুবই বিরল একটি রোগ। প্রতি বছর ১ মিলিয়ন মানুষ থেকে ৩ কিংবা ৬ জনের মধ্যে এ রোগটি পাওয়া যায়। এই রোগটি একটি হরমোনজনিত সমস্যা বা ব্যাধি।
আমাদের মস্তিষ্কের নিচে একটি ছোট গ্রন্থি আছে। এই গ্রন্থিটিই মূলত বিভিন্ন ধরনের হরমোনের জন্য দায়ী। যদি কোনো টিউমার এর কাজকে ব্যাহত করে, তাহলে এটি অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রোথ হরমোন শরীরে নিঃসরণ করে। যার ফলে শরীরের টিস্যু এবং হাড়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে।
আজকাল অ্যাক্রোমেগালি সার্জারি, বিকিরণ থেরাপি, বিভিন্ন মেডিসিন ইত্যাদি আরো অনেক আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই রোগ থেকে সুস্থ হওয়া যেতে পারে। কিন্তু তৎকালীন সময়ে, এই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলি ছিল না। যার ফলে মেরি অ্যান বেভান সঠিক চিকিৎসা পান নি।
মেরি অ্যান বেভান খুবই হতাশাজনক এবং যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রতিদিন তিনি একটু একটু করে নিজের সৌন্দর্য্য শেষ হয়ে যেতে দেখছিলেন। এতকিছুর পরেও, তার স্বামী থমাস বেভান ওনার পাশে ছিলেন। এই দুঃসময়েও তিনি মেরি অ্যানকে একা রেখে যান নি। কিন্তু মেরি অ্যানের ভাগ্যে হয়তো অন্যকিছু লেখা ছিলো। তাদের বিয়ের ১১ বছর পর ১৯১৪ সালে থমাস বেভান মারা যান। তখন মেরি অ্যানের কাছে খুবই স্বল্প পরিমাণ অর্থ ছিলো এবং তার চার সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পরে একা তার ওপর।
মেরি অ্যান তার সন্তানদের লালন-পালনের জন্য কাজ খুঁজছিলেন। কিন্তু তার সৌন্দর্য্যহীনতার জন্য কেউ তাকে কাজ দিচ্ছিলেন না। সবাই বাজে মন্তব্য করে তাকে তাড়িয়ে দিতেন।
পরবর্তীকালে, এই রোগটিই তার আয়ের উৎস হয়ে উঠেছিল। তিনি জানতে পারেন যে, ইংল্যান্ডে “দ্যা আগলিয়েস্ট ওম্যান ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড”(বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত নারী) নামক একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় যিনি জয় লাভ করবেন, তাকে নগদ পুরস্কার বা টাকা দেওয়া হবে। তাই মেরি অ্যান এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন, তিনি প্রতিযোগিতাটিতে যোগ দেন। প্রতিযোগিতাটিতে মেরি অ্যান প্রথম স্থান দখল করে বিজয়ী হয়েছিলেন। পরে মেরি অ্যান বুঝতে পারেন যে, তার এবং তার সন্তানদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এইভাবে নিয়মিত উপার্জন করা।
১৯২০ সালে, তিনি আমেরিকান শোম্যান স্যামুয়েল গাম্পার্টজের কাছ থেকে “কনি আইল্যান্ডের ড্রিম ল্যান্ড” এর একটি সাইডশোতে কাজ করার প্রস্তাব পান। বলতে গেলে, তিনি একটা “ফ্রিক শো” এর অংশ হয়ে উঠেন। যেখানে তার মতো আরো অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধীকতার মানুষরা যোগ দিতেন জনসাধারণকে বিনোদন দেওয়ার জন্য। আর তাদেরকে দর্শকদের সামনে হাস্যকরভাবেই উপস্থাপন করা হতো।
১৬ শতাব্দী থেকে এই ফ্রিক শোগুলো মানুষের বিনোদনের উৎস হয়ে উঠে। শোম্যানরা অস্বাভাবিক এবং কুৎসিত চেহারার মানুষদেরকে খুঁজে এনে, এই ফ্রিক শোগুলোতে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করতো। তারা তাদের শো – এর টিকিটগুলো সস্তায় বিক্রি করতো। তখনকার সময়ে এই ফ্রিক শোগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো।
কিন্তু মানুষ যখন বৈজ্ঞানিকভাবে জানতে পারে, কিছু মানুষ শারীরিক প্রতিবন্ধীকতার সাথে জন্মগ্রহণ করে আর অনেকে পরে মেরি অ্যানের মতো এসব শারীরিক প্রতিবন্ধীকতার শিকার হন, যা মোটেও উপহাসমূলক বিষয় নয়। তখন থেকে এই শোগুলো তাদের জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে।
তবে তখন মেরি অ্যানের মতো মানুষদের উপার্জনের একমাত্র পন্থা এই শোগুলিই ছিলো। আর জনসাধারণরা সত্যিই মেরি অ্যানকে ভালোবাসতো এবং মেরি অ্যান ছিলো এই শো – এর এক অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী।
মেরি অ্যান বিখ্যাত নিউরোসার্জন ডঃ হার্ভে কুশিং এর রোগীও ছিলেন। টাইম ম্যাগাজিন মেরি অ্যানের কিছু ছবি উপহাসমূলকভাবে প্রকাশ করেছিলো। তাই ১৯২৭ সালে তিনি টাইম ম্যাগাজিনের কাছে লিখেছিলেন, “হতভাগ্য মহিলা যিনি ‘রিঙ্গলিং ব্রাদারস’ এর সাইডশোতে বসেছিলেন, তার জীবনের একটি মর্মান্তিক গল্প আছে। তিনি একজন সুদর্শন যুবতী ছিলেন। তিনি অ্যাক্রোমেগালি নামক একটি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমি একজন চিকিৎসক হয়ে এইটা মানতে পারি না যে, টাইম ম্যাগাজিন রোগের ট্র্যাজেডির ওপর এতোটা বেমানান হতে পারে।”
দুর্ভাগ্যবশত, যারা অ্যাক্রোমেগালিতে ভোগেন, তাদের বেশিরভাগ মানুষই খুব বেশিদিন বাঁচতে পারেন না। ১৯৩৩ সালে মেরি অ্যান বেভান ৫৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
মেরি অ্যান বেভানের জীবনের গল্পটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাকে অনেক ঠাট্টা, মশকরা, লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। শোতে কখনও কখনও তাকে পুরুষালি পোশাকও পরিধান করতে হয়েছে, যেনো লোকজন সেটা দেখে হাসি-তামাশা করতে পারে।
আজ আমরা কেবল তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে পারি।