রুমেলা , সত্যি বল তুমি কি আমায় আজও ভালোবাসো ‘ ? রুমেলার হাতটা চেপে ধরলো তপন সরকার নামের লোকটা।এই রুমেলার সাথে তপনের দাম্পত্যটা দীর্ঘ পঁচিশ বছরের। বিয়ের পর পর সম্পর্কে একটু টান থাকলেও ক্রমেই ফিকে হতে শুরু করেছিল সেটা ডাল ভাতের মতো বোরিং একঘেয়ে বৌয়ের ওপর থেকে।
বিয়ের বছর পনেরো পর থেকে , বাচ্চা দুটো হয়ে যাবার পর থেকে তো অসহ্য লাগতো মহিলাটাকে কোল বালিশ এর মত মোটা শরীর , আর সাথে তেমনই ঘ্যানঘ্যান করা স্বভাব। রাত দিন নুন তেলের হিসাব কষছে , নয়তো রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ছে , কিংবা ছেলেদের নিয়ে পড়ে আছে ওকে দেখলেই অসহ্য লাগতো তপনের। পাশে শুতেও বিরক্তি লাগতো গা জ্বলে উঠতো কথায় কথায় ওর সব কথাতেই ঐজন্য খিঁচিয়ে উঠতো তপন। অপমান করতো মাঝে মাঝেই আর সেজন্যই বোধহয় আস্তে আস্তে নিজেকে একেবারে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল রুমেলা।
অবশ্য তাতে কিছু অসুবিধা হয়নি তপনের। রুমেলা কে নিয়ে মাথা ঘামানোর তো ওর কোন প্রয়োজনই ছিল না তত দিনে ওর লাইফে যে মালা এন্ট্রি নিয়ে নিয়েছে মালা ওর অফিস কলিগ। সুন্দরী , স্মার্ট , মডার্ন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে গোপনে অভিসার চালিয়েছে মালার সাথে তপন। কিন্তু আজ ছয় মাস হয়ে গেলো মালার আর টিকিটিও নেই। থাকবে কি করে ! তপন যে এখন হুইল চেয়ারে বন্দি। আচমকা হওয়া সেরিব্রাল এটাক টা যে বদলে দিয়েছে ওর জীবন। হঠাৎ করেই সুস্থ সবল মানুষ থেকে পঙ্গু আজ ও।
‘ কি হল রুমেলা বললে না তো ! ‘
রুমেলা নীরব। খাইয়ে দিচ্ছে তপনকে। রোজই দেয় এখন। স্বামীর সবটুকুই যে করিয়ে দিতে হয় এখন ওকে।
‘ বল ‘। আবার বললো তপন।
‘ আবোল তাবোল কথা না বলে তুমি খেয়ে নাও তো ঝটপট।এরপর ওষুধ খেয়ে ঘুমাবে ডাক্তারবাবুর কথামত ‘।
রুমেলা তপনকে খাইয়ে , ওষুধ খাইয়ে , বিছানায় শুইয়ে দিলো যত্ন করে। কিন্তু তপনের ঘুম আসছে না। রুমেলা উত্তর টা আজও দিয়ে গেলো না !
কি ভাবছেন এই রুমেলা আর তপন কোন কাল্পনিক চরিত্র ? একদম নয়।
‘ জানো পল্লবী , মিথ্যাটা সত্যির মতো করে সুন্দর করে সাজিয়ে আমি কোনোদিনই আমি বলতে পারতাম না। আর আজও পারি না। তাই তপনকে মিথ্যা করে বলতে পারি না যে ওকে ভালবাসি আজও। তাই প্রতিবার এড়িয়ে যাই ওর কথাটা। আসলে ভালোবাসা তো হল সম্পর্কের সেই সুক্ষ চারাগাছের মতো যাকে যত্ন দিয়ে পরম মমতায় বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু তপন কোনোদিন সেটা ভাবেইনি। আমাদের সম্পর্কটাকে কোনোদিন গুরুত্ব দেয়নি ও। সব সময় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে গেছে দিনের পর দিন। আমার প্রাপ্য সম্মানের ছিটে ফোঁটাও কোনোদিন দেয়নি আমায় ও। আর আমি জানি ও অন্য সম্পর্কেও জড়িয়েছিল। সব জেনেও আমি পড়ে ছিলাম এই সংসারেই খানিকটা নিরুপায় হয়েই। আমি চাকরি বাকরি করি না , খুব বেশি পড়াশুনাও করিনি। তাই ঘর ছেড়ে যাব কোথায় ? ছেলেদের মানুষ করবো কিভাবে ?
এই সব নানা কারণে এই বাড়িতে থেকে গেলেও মানুষটা আস্তে আস্তে সরে গেছিলো আমার মন থেকে। যে লোকটাকে একদিন সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম তার প্রতিই মরে গেছিলো ভালোবাসাটা। আজও সেই মৃত ভালোবাসার লাশ বয়ে বেড়াচ্ছি আমি।
কিন্তু আজ তপন অসুস্থ। মনে প্রাণে চাই ও ভালো হয়ে যাক তাড়াতাড়ি। আমার তরফ থেকে আমি তার যত্নের কোন ত্রুটি করছি না। কিন্তু ভালোবাসা ! না সেটা সত্যিই মরে গেছে।আর যা মরে যায় একবার তাকে তো আর বাঁচিয়ে তোলা যায় না। আসলে সম্পকের ভালোবাসাটা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে দুজনকেই যত্নশীল হতে হয় সম্পর্কটার প্রতি। নইলে কোন মানুষ আজীবন পাশে থেকে গেলেও , মুখ বুজে সব কর্তব্য করে গেলেও , সে ভালোবাসতে আর কোনোদিন পারেনা।আর ভালোবাসা এবং দায়িত্ব পালন দুটো কিন্তু এক নয়।অনেক পার্থক্য দুটোর মধ্যে ‘।
রুমেলের মেসেজটা পড়ে থমকে গেলাম সেদিন।সত্যি আমরা অনেকেই হয়তো বুঝিনা রোজকার জীবনে জড়িয়ে থাকা সম্পর্কগুলোও একটু উষ্ণতা চায় , একটু যত্ন চায়। আমরা হয়তো একদম পাশে থাকা মানুষটাকে জিজ্ঞাসা করতে ভুলেই যাই তুমি ভালো আছো তো ? ভুলেই যাই তার মনের খবর নিতে। যেহেতু সে পাশে আছে , সব কর্তব্য করে চলেছে , তাই ধরেই নি তার মানে নিশ্চই সব ঠিকই আছে। ধরেই নিই আমি সম্পর্কটার প্রতি আলাদা করে যত্নশীল না হলেও সে থেকেই যাবে আমার হয়ে।
না এটা কিন্তু একেবারে ভুল। পাশে থাকা মানেই কিন্তু সাথে থাকা নয়। সারাজীবন পাশে থাকা মানুষটাও কিন্তু মন থেকে সরে যেতে পারে শুধু একটু ভালোবাসার অভাবে। আর একবার মন এর দূরত্ব তৈরী হয়ে গেলে কিন্তু সেটা মিটিয়ে নেওয়া একেবারে সহজ হয় না। তাই সময় থাকতেই সম্পর্কগুলোকে একটু যত্ন , একটু উষ্ণতা দেওয়া বড্ড দরকার। নাহলে একটা সময় সত্যি বড্ড আফসোস করতে হয় ! তখন চেয়েও আর ছিঁড়ে যাওয়া সুতোটাকে হয়তো জুড়ে নেওয়া যায় না।