একদিন তিন কচ্ছপ চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছে। এই তিনজনের মধ্যে একজন সিনিয়র আর দুইজন জুনিয়র। সিনিয়র কচ্ছপের বয়স পাঁচশো সত্তর বছর। জুনিয়র কচ্ছপ দুটোর মধ্যে একটির বয়স চারশো ষাট বছর। আর সবচেয়ে ছোটো কচ্ছপটির বয়স তিনশো আশি বছর। ছোটো কচ্ছপটিকে বড় দুজন পিচ্চি বলে ডাকে। আর এই পিচ্চির জন্যই তাদের এই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খেতে আসা। কারণ, পিচ্চি কচ্ছপ চাইনিজ খেতে খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে জন্মদিনে তার চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাওয়া চাই-ই চাই।
সেদিন ছিলো পিচ্চি কচ্ছপের জন্মদিন। সেদিন তার তিনশো ঊনআশি বছর পূর্ণ হয়েছে। তিনশো আশি বছরে পা রেখেছে সে। তিনশো আশি বছর আসলে কচ্ছপদের জন্য কোনো বয়সই না। প্রাণী জগতের মধ্যে তারা সবচেয়ে বেশিদিন বাঁচে। পাঁচ-ছয়শো বছর তারা অনায়াসে বাঁচে। তাদের কেউ কেউ তো হাজার বছরও বাঁচে। এই পিচ্চি কচ্ছপ, যার নাম “ঘটোৎকচ” —এই ঘটোৎকচ-এর দাদা “মন্থরম” বারশো পঁয়তাল্লিশ বছর বেঁচে কচ্ছপদের ইতিহাসে রেকর্ড করেছিলো। অবশ্য ঘটোৎকচ-এর বাবা কতদিন বেঁচেছেন, তা সঠিক করে ওরা কেউ বলতে পারে না।
কেননা, ঘটোৎকচ-এর বাবা, যার নাম ছিলো “দৌড়ামর”, তাকে মানুষেরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। তারপর কি হয়েছিলো, তারা আর জানে না। তবে মানুষের কাছে গেলে কেউই আর ফিরে আসে না। তাই ছোটোবেলা থেকেই তাদের পই পই করে শেখানো হয়, মানুষের কাছ থেকে সবসময় দূরে থাকতে। সাবধানে থাকতে। আরও শেখানো হয়, আস্তে আস্তে চলাফেরা করতে।
যেহেতু তারা কচ্ছপ, তাই তাদের সবসময় আস্তে আস্তে এবং ধীরে ধীরে চলাচল করা শিখতে হয়। জোরে জোরে চলা কিংবা দৌড়াদৌড়ি করা তাদের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক! ঘটোৎকচ-এর দাদা “মন্থরম” ঘটোৎকচকে খুব ছোটোবেলায়, মানে যখন তার বয়স মাত্র সত্তর আশি বছর; তখন তাকে গল্প বলেছিলো, কিভাবে ঘটোৎকচ-এর বাবা “দৌড়ামর” বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে মানুষের হাতে ধরা খেয়েছিলো!
দাদার কাছে তার বাবা “দৌড়ামর” এর সেই ভয়ংকর গল্প শোনার পর থেকেই ঘটোৎকচ খুব সাবধানে থাকে। কখনোই দৌড়াদৌড়ি করে না। সবসময় খুব ধীরে চলাচল করে। আর এজন্য তার মা “ধিরুমাই” তাকে খুব পছন্দ করে। তার মায়ের এখন বয়স পাঁচশো সত্তর বছর। তার মা এখন সিনিয়র কচ্ছপ। আর তার বড় বোন জুনিয়র কচ্ছপ “ধিরানা”ও মায়ের মতো ধিরস্থির। তার বয়স চারশো ষাট বছর। তার বিয়ের বয়স হয়েছে। তাই তার মা চিন্তায় অস্থির!
যাইহোক, ঘটোৎকচের জন্মদিন উপলক্ষে মা-বোনের
সাথে সে চাইনিজ খেতে এসেছে। তারা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা টেবিলে বসেছে, এমন সময় তার মা সিনিয়র কচ্ছপ “ধিরুমাই” বললো— কী সর্বনাশ! আমার হাতব্যাগটা তো ভুলে বাসায় রেখে এসেছি। ওটায় টাকা আছে। চাইনিজ খাওয়ার বিল দিতে হবে ওখান থেকে। যা তো বাবা ঘটোৎকচ, বাসায় গিয়ে আমার হাতব্যাগটা নিয়ে আয়। ঘটোৎকচ বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি নিয়ে আসছি।
ঘটোৎকচ যাওয়ার পর ছয় বছর পার হয়েছে। চাইনিজের অর্ডার দেয়া হয়েছে, কিন্তু সাত বছর পরও যখন খাবার সার্ভ করছে না, তখন ঘটোৎকচের বড়বোন ধিরানা বিরক্ত হয়ে বললো— কী ব্যাপার মা, এখনো খাবার দিচ্ছে না কেন? ঘটোৎকচের মা বিরক্ত হয়ে বললো— কী জানি বাপু, আমি ভাবছি ঘটোৎকচ এখনো আসছে না কেনো? এতক্ষণ তো লাগার কথা না।
এরপর আরো ষোলোবছর পার হয়ে যাবার পর টেবিলে চাইনিজ খাবার দিয়ে গেলো চাইনিজ ওয়েটার কচ্ছপ। তখনই ঘটোৎকচের বড়বোন ধিরানা খেতে চাইলে তার মা নিষেধ করে বললো— এখন না, আগে ঘটোৎকচ আসুক। তারপর আমরা তিনজনে খাবো। এরপর আরও বাইশ বছর পার হয়ে গেলো। তখন ঘটোৎকচের মা বললো, ঘটোৎকচ মনে হয় বাসায় কোনো কাজে আটকা পড়ে গেছে। চল, আমরা খেয়ে বাকী খাবার ঘটোৎকচের জন্য প্যাকেট করে নিয়ে যাই। ঠিক তখনই দরজার পাশ থেকে চিকন গলায় ঘটোৎকচ বললো— “মা, আমি তো এখনো যাই-ই নি।”
সাইফুল হক : লেখক, সম্পাদক, গবেষক।