সিরাজুম মুনিরা আর সিদরাতুল মুনতাহা দুই বোন। কাশ্মীরের এক পাহাড়ি উপত্যকায় তাদের বাড়ি। দুই পাহাড়ের মাঝে বিস্তীর্ণ উপত্যকা জুড়ে হালকা বেগুনি ফুলের যেনো এক বিশাল চাদর ছড়িয়ে রয়েছে। বড়ই মনোরম সে বেগুনি ফুলের বিছানা। আর সে মনোহর বেগুনি ফুলই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জাফরান ফুল।
সিরাজুম মুনিরা আর সিদরাতুল মুনতাহা স্থানীয় মাদ্রাসায় সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। তাদের বাবা একজন জাফরান চাষী। পড়াশোনার অবসরে তারা তাদের বাবার জাফরান চাষের জমিতে জাফরান ফুল তোলার কাজ করে। জাফরান ফুল খুবই স্পর্শকাতর ফুল। কুয়াশামাখা সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে জাফরান ফুল পাপড়ি মেলে। জাফরান ফুলের ভেতর দুই তিনটি পুংকেশর থাকে। এই পুংকেশরগুলিই আসলে জাফরান।
জাফরান ফুল সূর্য ওঠার সাথে সাথে ফোটে এবং শেষ বিকেলে সূর্যের আলো কমে আসার সাথে সাথেই ফুলের পাপড়ি গুটিয়ে যায়। তাই সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথেই জাফরান ফুল সংগ্রহকারী সিরাজুম মুনিরা আর সিদরাতুল মুনতাহার মতো মেয়েরা দলবেঁধে ফুল তোলে। বেগুনি জাফরান ফুলের বিছানায় এই জাফরানি ফুলতোলা মেয়েদের ফুল তোলার দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব!
মসলা হিসেবে জাফরান সারা পৃথিবীতে কেন এত দামি? এ প্রশ্ন জাগে অনেকের মনেই। মসলা হিসেবে মানুষ আসলে ব্যবহার করে জাফরান ফুলের পুংকেশর। হিসেব করে দেখা গেছে, এককেজি জাফরান পেতে হলে এক লক্ষ ষাট হাজার থেকে এক লক্ষ আশি হাজার জাফরান ফুলের প্রয়োজন হয়। আর এই এক লক্ষ ষাট বা আশি হাজার ফুলের ফুলের শুকনো পুংকেশরের ওজন এক কেজি। এই এক কেজি জাফরানের মূল্য চার থেকে সাড়ে চার লক্ষ টাকা।
জাফরান পৃথিবীর নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। শীতপ্রধান কাশ্মীর ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল তথা গ্রীস, স্পেন, ইতালি এবং ইরানে উৎকৃষ্ট জাফরান উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে স্প্যানিশ জাফরান সবচেয়ে বিখ্যাত। ইরানের জাফরান স্বাদে গন্ধে সেরা। আর ইরানে জাফরান উৎপাদিত হয়ও ব্যাপক পরিমাণে। গুণগত মানের দিক দিয়ে স্প্যানিশ ও ইরানী জাফরানই সবচেয়ে সেরা। তবে জাফরানের আদি জন্মভূমি হচ্ছে গ্রীস।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে পরবর্তীতে ইরান এবং কাশ্মীরের উপত্যকায় জাফরান বিস্তৃতি লাভ করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, জাফরানের বীজ নাই। জাফরানের মূলে যে কন্দ বা টিউবার থাকে সেই টিউবার থেকেই জাফরানের বংশ বৃদ্ধি হয়। জাফরান অনেক স্পর্শকাতর গাছ। সামান্য অবহেলা ও অসতর্কতায় এই গাছের মৃত্যু ঘটে। তাই জাফরান গাছের খুব পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। জাফরান ফুল তোলা ও সংরক্ষণও অনেক কষ্টসাধ্য। তাই জাফরান পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান মসলা।
জাফরান শুধু মসলা হিসেবে নয়, ভেষজ ওষুধ হিসেবে অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ। জাফরান মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। পিটুইটারি গ্লাণ্ডের হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। মনে আনন্দ, উৎসাহ, উত্তেজনা ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী এণ্ডোরফিন হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে মানুষ আনন্দিত হয়, সকল কাজে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। এছাড়া জাফরান যৌবন শক্তিবর্ধক ও স্নায়ু সতেজকারক।
যাদের মুত্রতন্ত্রের জটিলতা আছে এবং ফুসফুসের সমস্যা আছে, তাদের জন্য জাফরান অত্যন্ত উপযোগী ও উপকারী। মেয়েদের ঋতুকালীন জটিলতা নিরসনেও জাফরান যথেষ্ট কার্যকরী। শিশুদের কাশি ও বদহজমের সমস্যা দূর করতেও জাফরান অনেক উপকারী। তবে ইদানীং অসাধু ব্যবসায়ীরা জাফরান ফুলের মতো দেখতে এক ধরনের ফুলের পুংকেশরকে জাফরান হিসেবে বিক্রি করে। এসব নকল জাফরান উপকার তো দূরের কথা, এসব ভয়ংকর ক্ষতিকর। তাই এধরণের নকল জাফরান থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
সাফিকা শাহরিন হক