সময়টা ছিল ,12-12-2012 ইং। ডিসেম্বর এর দ্বিতীয় সপ্তাহ। শীতকাল তখন আরম্ভ হয়ে গেছে। খুব বেশি শীত না একটু একটু শীত। আমি তখন শহরে থেকে ফিরছিলাম। আমার খুব তাড়া ছিল। আমার বাড়ি মফস্বল কোন জেলায়। নামটা বললে অনেকেই চিনে ফেলতে পারেন। তাই নামটা বলছি না। আমার জীবনের এই ঘটনাটিকে আমি কখনোই ভুলতে পারিনা। এরপর কখনো আমার সাথে আর এমনটি হয়নি।
এখনো সেদিনের কথা মনে হলে শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে যায়। শরীরের রক্ত ঠান্ডা ঠান্ডা হয়ে আসে। বিশ্বাস করা আর বিশ্বাস না করাটা সম্পন্ন ব্যক্তিগত বিষয়। ঘটনাটা শুরু করা যাক। ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক দুটো বাজে। গুরুত্বপূর্ণ সেই ফোনটি পাওয়ার পর আমি আর অপেক্ষা করতে পারিনি। আমার দুঃসম্পর্কের এক ফুপু মারা গিয়েছিল সেদিন। দিনটি কি বার ছিল সেটা আমার মনে নেই। তবে তারিখটা একদম মনের মাঝে গেথে আছে। হয়তো সেজন্যেই ঘটনাটিকে কখনো ভুলতে পারিনি। হঠাৎ এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম আমার ফুপু মারা গিয়েছেন।
আমার সেই ফুফুকে আমি জীবনে একবারই দেখেছিলাম। খুব ছোটবেলায় মুখটা খুব ভালো করে মনে নেই। মার কাছে শুনেছি তিনি ছোটবেলায় আমায় খুব আদর করতেন। তাই তার মৃত্যুর সংবাদটা শুনে আমি আর স্থির থাকতে পারিনি। মনটা খুব ছুটি গিয়েছিল। মাতৃকুল এর মাঝে। তাই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিলাম। আমি রওনা দিলাম খুব তাড়াহুড়ো করে। জানিনা শেষ দা ফোনটা আমি ধরতে পারবো কিনা। তবে আমি শুধু চেয়েছি তাকে শেষবারের মতো একবার দেখতে। মুখটা খুব ভালো করে মনে নেই অল্প অল্প মনে আছে। খুব মায়া মায়া চেহারা ছিল তার।
দেখতে কিছুটা আমার মায়ের মত। আমি ঠিক দুটো বাজে শহরের সিএনজি স্টেশনে এসে পৌছালাম। এখান থেকে আমাকে যেতে হবে আরো বহুদূর। সে পথটি একদমই আমার অচেনা। তবে ঠিকানাটা আমি জোগাড় করেছিলাম খুব কষ্ট করে। তবে আজ অব্দি সেখানে আমার যাওয়া হয়নি। তবে আজ আমাকে যেতে হবে। মাতৃকুলের কিছুটা ঋণ আমায় পরিশোধ করতে হবে। আমি সিএনজিতে চড়ে বসলাম। আশেপাশের লোক গুলো থেকে আমি আমার গন্তব্য স্থল সম্পর্কে জেনে নিলাম। সিএনজিতে চলতে শুরু করল। আমি মনে মনে অনেক কিছু ভাবছি। আমি ঠিক সময়মতো পৌঁছাতে পারবো তো। অবশ্য আসার সময় অনেকেই আমাকে অনুরোধ করেছিল না আসার জন্য।
আসার জন্য নিষেধ করার কারন ও ছিল অনেকগুলো। প্রথমত যে কারণটি ছিল সেটি ছিল জায়গাটি অত্যন্ত দুর্গম। অচেনা পথ কোনদিন আসা হয়নি। তবুও কারো কথা না শুনে আমি রওনা হলাম। এর আগে কোনদিন আসা হয়নি। রাস্তাটি একদম অচেনা। আমার সেই ফুফু যে গ্রামে থাকে সেই গ্রাম অনেক দূরে। অনেকেই দুর্গম চর হিসেবে চেনে। তবে শুনেছি এক সময় এটি চর ছিল না। অন্য আর দশটা গ্রামের মতোই ছিল। কিন্তু যমুনার করালগ্রাস বর্তমানে তাদেরকে দুর্গম এলাকার বাসিন্দা হতে বাধ্য করেছে। তবুও জীবন জীবন সংগ্রামে এগিয়ে তারা সেখানে বসবাস করছে। অনেক মানুষই এখন চরে থাকেন।
আমাদের কাছে দুর্গম মনে হলেও। তাদের কাছে এটি খুব সাধারন একটি ব্যাপার। থাকতে থাকতে তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। অন্য জায়গায় তাদের ভালো লাগে না ।অন্য জায়গায় তাদের ভালো লাগে না। তারা জীবনকে জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলেছি। এই বন্ধন থেকে তাদের মুক্তি খুবই কঠিন। তবে জায়গাটা চর হলেও। অর্থনৈতিক মুক্তি তারা অনেক আগেই লাভ করেছে। শুধু জীবনযাত্রায় আলাদা একটি বৈচিত্র্য তাদের মাঝে আছে। আমি কখনো এমন জায়গা দেখিনি। তবে অনেকের কাছ থেকে এসব কিছু শুনেছি। তাই কেমন একটি ঘাবড়াবার বিষয় হিসেবে আমি কখনও কল্পনাও করিনি।
অন্য আর দশটা স্বাভাবিক বিস্ময়ের সাথে আমি এর কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনা। দেখতে দেখতে প্রায় 40 মিনিট পার হয়ে গেল। যতোটা দূরত্ব আমি ভেবেছিলাম এখন দেখছি দূরত্বটা তার চেয়ে অনেক বেশি। প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর একটি বাজারে এসে সিএনজি থামল। আমি সিএনজি থেকে নামলাম। সেই সময় সিএনজির ভাড়ার কথা আমি আজও ভুলিনি। প্রায় 180 টাকা ভাড়া নিয়েছিল সে দিন। তখন বুঝতে পারলাম জায়গার দূরত্ব টা নেহাত কম নয়। এখানকার সিএনজি কিলোমিটারে চলে না। তাদের কোন মিটার নেই। নির্দিষ্ট পরিমান ভাড়া নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা হিসেবে আগে থেকেই ঠিক করা।
আমি এটা কার চিন্তা না করে শুধু চিন্তা করছি তাড়াতাড়ি পৌছাবার। জীবনের শেষবারের মতো হলেও যদি ফুপি কে একবার দেখতে পারতাম। মনটা আমার বড়ই উতলা হচ্ছিল তার জন্য। ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই দেখলাম চারটে বেজে 40 মিনিট হয়ে গেছে। এই বাজারের নাম মেঘাই ঘাট। খুব বড়োসড়ো একটি হাট বাজারের মত মনে হলো। তাড়াহুড়োতে দুপুরের খাবার কথাটা ভুলে গেছি। খুঁজে খুঁজে ভালো একটি হোটেলে কিছু খাবার দাবার সেরে নিলাম। তারপর একটি টি স্টলে চলে গেলাম। সেখানে অনেক মানুষ। আমি কৌশলে সেখানকার মানুষের কাছ থেকে আমার গন্তব্য স্থল সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা নিলাম। তারা যেভাবে বলল তাতে মনে হলো আমি খুব বেশি দূরে ন ঐ। এখান থেকে আমাকে নৌকায় চড়তে হবে সেই নৌকায় করে আমাকে নদীর ওপার যেতে হবে। যে জায়গার কথা শুনলাম তার নাম ভাঙ্গাবাড়ী।
কিছুক্ষণ ঘাট পাড়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেক নৌকায় চলতে শুরু করল। কিন্তু সব নৌকায় ভাঙ্গা বাড়ি যাওয়া যাবেনা। নির্দিষ্ট কিছু নৌকা আছে যারা ওই পথ দিয়ে যায়। যাবার পথে যাত্রীদের শিলচরে নামিয়ে দিয়ে যায়। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে গ্রামের ভিতরে চলে যাওয়া যায়। একজনের কাছ থেকে শুনলাম সেখানে মানুষের সংখ্যা দিন দিন অনেক কমে গেছে। অনেক মানুষ সেখান থেকে অন্যত্র চলে গিয়েছে। চট্রলা কয়েকটি ভালো বলে মনে হলো না। যতটুকু ভেবেছিলাম এখন দেখছি যাত্রাটি ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
আমি কিছুটা ধারনা পাবার পর বুঝতে পারলাম সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার রাত্রি হয়ে যাবে। তাই আমি বাজার থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও একটি ব্যাগ কিনে নিলাম। আমি কিছু জিনিসপত্র নিলাম। তেমন কিছু না প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। একটি টসলাইট, টিম ম্যাচ, ও কিছু খাবার-দাবার ও পানির বোতল। ভেবে দেখলাম এগুলোর প্রয়োজন আছে। তাছাড়া আমরা শহরের মানুষ। এখানকার আবহাওয়া ও খাবার পানি গুলো তেমনটা ভালো বলে মনে হলো না। আমি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ঘাটে চলে এলাম। ঘাটে এসে দেখলাম একটি বিশাল তেল বোঝাই করা নৌকা। আমি সেই নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম ভাই ভাঙ্গা বাড়ি যাওয়া যাবে?
তিনি আমার প্রশ্নটি শুনে চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললেন। তিনি বললেন এখন তো সেখানে যাবার কোন নৌকা খুঁজে পাবেন না। তাছাড়া জায়গাটি অত্যন্ত দুর্গম। এই সময় কোন লোক সেখান থেকে আসে না। আবার সেখানে যাওয়ার মত লোক এখন থাকেনা। তারা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যায়। যাদের নিজস্ব নৌকা আছে তারাই শুধু এই বাজারে আসা যাওয়া করে বেশি। তাছাড়া এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আপনার আজ না যাওয়াই ভালো। আমি তার কথা খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে বললাম, সমস্যা নেই কাকা আমি যেতে পারবো। তিনি আর কোন কথা বাড়ালেন না।
শুধু বললেন আমাকে তিনি একটি শর্তে নিয়ে যেতে পারবেন। তবে ভাড়াটা একটু বেশি দিতে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। তিনি আমাকে বললেন তিনি ভাঙ্গা বাড়ি যাবার চরে আমাকে নামিয়ে দিবেন। সেখান থেকে আমাকে একা একাই যেতে হবে সেই গ্রামের দিকে। নৌকা ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম শরীরে প্রচণ্ড বাতাস লাগছে। সেই সাথে শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে। যখন শহরের ছেড়েছিলাম তখন শীতের মাত্রা কম ছিল। যতই পূর্ব দিকে যাচ্ছে ততই শীতের তীব্রতা বেড়েই চলছে। আমি শীতের পোশাক পড়ে আছি। তবুও খুব শীত লাগছে। নৌকা চলতে শুরু করল। ইঞ্জিন চালিত নৌকা খুব দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। তবে নৌকার ভটভট শব্দ টা আমার কানটা ঝালাপালা করে দিচ্ছে। নাকের পাশ দিয়ে শুধু তেলের আর পোড়া মবিলের গন্ধ ভেসে আসছে। আমি নৌকার ঠিক সামনের দিকটায় দাঁড়িয়ে নদীর সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতা উপভোগ করছি। সন্ধ্যের পর চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে।
একটু আগে আবছা আবছা দেখা গেল এখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব কিছু অস্পষ্ট অস্পষ্ট। আমি মাঝে মাঝে সেই মাছি কাকাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম আর কতদূর? তিনি মাথা নেড়ে মাঝে মাঝে ইশারা ইঙ্গিতে বলতে লাগলেন, তিনি বোঝাতে চাইছেন ঠিক জায়গায় তিনি আমাকে নামিয়ে দিবেন। আমি তার কথাতে কিছুটা হলেও সান্তনা পাচ্ছি। আসলে গ্রামের এই প্রতিকূল তার সাথে যুদ্ধ করা মানুষগুলো অতি সাধারণ। তাদের মুখগুলো অনেক নিষ্পাপ। তাদের চেহারা গুলো অনেক মায়া মায়া। খুব বিশ্বাস করতে শুরু করলাম লোকটিকে। আমার এই অচেনা ভ্রমণে এখন এই মাঝিটি আমার পরম বন্ধু। মাঝি কিছুক্ষণ পরপর বিড়ি টানতে লাগলো। একটার পর একটা সেটা নিয়ে চলছে। লোকটির বয়স কতোই বা হবে। 50 কিংবা সাঁট। গায় তেমন কিছু নেই। শুধু একটি পাতলা চাদর জড়িয়ে আছে। আমি মনে মনে ভাবছি এদের শীত আর গরম বলে কিছু নেই। এরা জীবন যুদ্ধে সবকিছুতেই জয় করে নিয়েছে।
প্রায় 40 থেকে 50 মিনিট নৌকা চলার পর মাঝি নৌকার গতি টা একটু থামল। দু’পাশে নদী বয়ে চলছে গুনগুন করে। লোকটি তার আঙ্গুলের ইশারা দ্বারা বোঝাল আমাকে এখানে নামতে হবে। আমি জায়গাটি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কোন লোকজন নেই। জায়গাটি অনেক উঁচু নদীর কাছ থেকে। দেখতে ভিটেমাটির মতই। তবে নিচে বাড়ির পরিমাণটা অনেক বেশি। কিছুটা অংশ ভেঙে ভেঙে জুড়ে রয়েছে। মনে হচ্ছিল গত কাল বোধহয় কিছুটা জায়গায় অবস্থিত ছিল। সেগুলো ভেঙে ভেঙে এমন হয়েছে। কিছু মানুষের পায়ের ছাপও সেখানে দেখা গেল। হয়তো এই ঘাটে তারা নেবে থাকে। বিষয়টি ঠিক সেরকম নয়। আসলে এটি কোন ঘাট নয়। এটিকে সুতা খাল বলে থাকেন।
অর্থাৎ নদীর মাঝে কোন নালা নদী সৃষ্টি হলে ঠিক সেদিকেই সুতা নাল বলা হয়। এটি এখানকার স্থানীয় ভাষা। অনেকেই হয়তো সে ভাষাটা বুঝবেন না। যাইহোক আমি নৌকা থেকে নেমে পড়লাম। রাত্রি তখন প্রায় 8 টার কাছাকাছি। আমার কাছে যে মোবাইল ফোনটি ছিল সেটি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জ ফুরিয়ে গেছে। তখনকার সময়ে আসলেই স্মার্টফোনের সস্তা বাজার ছিল না। তখন যে ফোনগুলো আমরা ব্যবহার করতাম তাতে ইন্টারনেট চালানো অনেক কষ্ট হতো। সর্বোচ্চ কথা বলা যেত। কিছু কিছু ফোন তখন উন্নত প্রযুক্তির ছিল। তবে সেগুলোর দাম ছিল অনেক বেশি। সবার হাতে হাতে তখন স্মার্ট ফোন আসেনি। আমার ফোন টির বেকাপ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
তবে আমার হাতে ঘড়ি ছিল।তারপর বাজার থেকে যে টর্চ লাইট টা কিনেছিলাম সেটা হাতে নিলাম। নদীর নিচ থেকে আমি উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। বেশ কিছুটা উঠার পর বুঝতে পারলাম। আমি যেমনটা ভেবেছিলাম এখানকার চালচিত্র তার চেয়ে একটু বেশি। আমি নিচ থেকে উপরে উঠে এলাম। উপরে উঠার পর আমি অবাক হয়ে গেলাম! আমি উপরে উঠতে উঠতে নিচের দিকে তাকাচ্ছিলাম বারবার। আমি যেই নৌকাটিতে এসেছিলাম সেটি ছেড়ে দিয়েছে। এবং সেই নৌকার মাঝি টি আমাকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছিল। অন্ধকারের মাঝে কিছুটা হলেও আমি তা দেখতে পাচ্ছিলাম। তবে লোকটির মুখ খুব নিষ্পাপ ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল সে কিছু একটা আমাকে বলবে।
কিন্তু সে কোন কিছুই নেই বলল না। সে তার নৌকা নিয়ে তার গন্তব্যের দিকে চলে যাচ্ছিল। পূর্বদিকে। আমি উপরে উঠে দেখলাম আমার সামনে সব মরুভূমির মতো লাগছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে হয়তো কোন ফসল ছিল। এখন আর নেই ফসল গুলো কেটে নেওয়া হয়েছে। শুধু নিচের গোড়ালি অংশগুলো হয়ে গিয়েছে। সামনে বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা। সেখান থেকে শুধু আকাশকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। জনমানবের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। আমি ভিতরে ভিতরে একটু একটু দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম। প্রথমত ফোনটা বন্ধ হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ জায়গাটি ছিল একদম নতুন। তৃতীয়ত: আমি ছিলাম একদম একা। তখন মনে মনে ভাবতে লাগলাম একজন সঙ্গী থাকলে খুব ভালো হতো। দুজনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেতে পারতাম। জীবনের এই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম না আসলে মানুষ কেন একা চলতে পারে না। তখন সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে আমার বাস্তব ধারণা হলো। আমি এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম।
কোথাও একটি পশুপাখি পর্যন্ত নেই। আমি মনে মনে ভাবলাম আমি সঠিক রাস্তা হয়ে এসেছি কি? নাকি কোথাও একটু ভুল হল। আবার ভাবছি এতক্ষণে হয়তো জানা জানা হয়ে গেছে। আমি কোন কিছু না ভেবে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। কারণ পেছনে এগোবো এগোবার আর কোনো পথ নেই। পিছনে শুধু নদী যেদিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি। সেই পানিগুলো কল করলে শব্দের বয়ে চলা আমার কানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে কিছু একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে । তবে সেটা কিসের শব্দ বোঝা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম শব্দ টা ছিল বাতাসের। খুব বেশি জোরে না হলেও হালকা হালকা বাতাস ছিল। আমি যতই সামনে এগোচ্ছে ততোই অবাক হচ্ছি।
আমি শুধু এগুচ্ছিলাম কোন কিছু একটা পাবার আশায়। কোন না কোন বাড়ি অথবা কোন না কোন মানুষ। সেই চেনা হোক আর অচেনা হোক। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম আমি কি আজ পৌঁছাতে পারবো? আমি সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। সামনে ডান পাশে বড় একটি আখের ক্ষেত দেখলাম। ঠিক সেটি বড় আখের ক্ষেত নয়। এটি ছিল চিকন চিকন এক ধরনের আখ। যা আমরা গ্রাম্য ভাষায় বলে থাকি কাইসা। অনেকেই চিনে থাকবেন। বিশেষ করে যাদের বাড়ি দুর্গম অঞ্চলে। তবে সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না।
তবে পশুপাখির কিছু বিষ্ঠা আমার চোখে পরলো। তখন মনে মনে একটু খুশি হতে লাগলাম যেহেতু পশুপাখির অবাধ বিচরণ নাইরে দৃশ্য এখানে আছে সেহেতু এখানে মানুষ থাকতে পারে। আমি আরও সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। কিন্তু আমি হতাশ হয়ে গেলাম কোন মানুষকেই আমি খুঁজে পেলাম না। পেছন ফিরে তাকালাম। দেখতে পেলাম আমি অনেক দূরে চলে এসেছি। সামনে শুধুই মরুভূমি আর মরুভূমি। বালুরচর আমি জীবনে অনেক দেখেছি কিন্তু এমন বালুরচর আমি নতুন করে দেখতে শুরু করছি। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু মনে হয় ফাঁকা ফাঁকা। মনের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে। অজানা আতঙ্কে এই শীতেও আমার গরম ধরে গেছে। এখন না আমাকে আমারি শত্রু বলে মনে হচ্ছে। আমি নিজের শত্রু। আমার খুব রাগ হচ্ছিল। আমি কেন এমন ডিসিশন নিলাম।
দিনের বেলা হলে হয়তো কোনো কথা ছিল। এখন তো রাত্রি প্রায় সাড়ে নয়টা। আমি এখন পর্যন্ত কোন মানুষ খুঁজে পাচ্ছিনা। মানুষ তো খুঁজে পাচ্ছিনা সেটা বড় কথা নয় বড় কথা হচ্ছে এখন আমি ফিরে যাব কিভাবে। নদীর দিকে তাকাতেই সে ঠিকই মনে হচ্ছে শুধু সাদা আর সাদা। একটি নৌকা ও চোখে পড়লো না। আমি এখন শুধু সামনে এগুতে লাগলাম। পেছন ফিরে তাকানোর সময় আমার ফুরিয়ে গেছে। হাতের টর্চ লাইট একদম নতুন।
আলোগুলো অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ভাগ্যিস টর্চলাইট কিনে রেখে ছিলাম। মুখ থেকে পানির বোতল টি বের করে পানি খেয়ে নিলাম। এখন সত্যি সত্যি আমার নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। আমি কিছুটা মনের ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে গেলাম। অন্য কোন জায়গা হলে কথা ছিল, যখন মন চায় তখন ফিরে যেতে পারতাম। কিন্তু এমন জায়গা থেকে ফিরে যাওয়া বর্তমান সময়ে একদম অসম্ভব। আমার মাথা থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরতে শুরু করলো। অজানা এক আতঙ্কে আমি আতঙ্কিত হতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম এই পথ কি সত্যি সত্যি শেষ হবে। (পর্ব 2) অপেক্ষা করুন।
সত্যি বলছি আমি কোনদিন মর্গের লাশ দেখেও এত ভয় পাইনি। সেদিন এত ভয় পেয়েছিলাম। এখনো সেদিনের কথা মনে হলে আমার শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে যায়। গল্পটা এখনো শেষ হয়নি, গল্পের শুরুটা ঠিক সেই সময় হচ্ছিল:-তারপর,,,,, (পর্ব 2) writing by-momin Sagar.