জীবন নামের গল্পের ডায়েরিতে জমা পড়ে থাকে হাজারো গল্প! আমাদের জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, প্রিয়জনকে হারানো, কাছের মানুষগুলোর কাছ থেকে প্রতারণা এরকম নানান গল্পের ভিড়ে হারিয়ে যায় ভয়ংকর কিছু সত্য। আমার জীবনের ডায়েরিতেও আছে এরকম ভয়ংকর কিছু সত্য; যে সত্য ধ্বংস করে দিয়েছে আমার সাজানো- গোছানো স্বয়ংসম্পূর্ণ সুন্দর একটি পরিবার!
আমি টিনা। আমাদের বাসা ছিলো ঢাকার একটি বিলাশবহুল এলাকায়। আমার মা ফরেন। তিনি তার নিজ দেশেই লেখাপড়া করেছেন। আমার বাবারা পাঁচভাই দুইবোন। আমার বাবা তার ভাইদের মধ্যে চার নম্বর ছিলেন। একটা সময় লেখাপড়া শেষে আমার বাবা দেশে ফিরে আসেন। বাবা দেশে ফিরে রেস্টুরেন্টের বিজনেস শুরু করেন। আমার দাদার যে বাড়িটা ছিলো সেই বাড়ির নিচতলাতে বাবা বিজনেস করেন। আর তখন আমার দুই ফুপুর বিয়ে হয় বিদেশে। তারা বিয়ের পর দুইজন দুই দেশে চলে যান।
এদিকে আমার মায়ের এক রিলেটিভ হলেন আমার বড় চাচি। আমার মা পার্লারের কাজ জানতেন। আমার চাচির সাথে পার্লারের বিজনেস করার জন্য আমার মা বাংলাদেশে আসেন। সেখান থেকেই আমার বাবার সাথে আমার মায়ের পরিচয় ও বিয়ে।
বিয়ের পর আমার মা তার পারলারের বিজনেস আমাদের দাদার বাড়ির ফার্স্ট ফ্লোরে শুরু করেন। আর গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলতে থাকে বাবার রেস্টুন্টের বিজনেস। অনেক বড় বড় সেলিব্রেটিরা সার্ভিস নেবার জন্য আমার মায়ের পারলারে আসতেন। তারপর কয়েক বছর কেটে যায়। আমার ভাই হয়, আমি হই। আমরা এর মধ্যে বড় হতে থাকি। আমার ভাই আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। আমার বয়স যখন ৭/ বছর তখন আমার বাবার রেস্টুরেন্টের বিজনেস কোন এক কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
আমার দাদারও রেস্টুরেন্টের বিজনেস ছিলো। আমার তিন চাচা সেই বিজনেস করতেন। তখন থেকে বাবা আমার চাচাদের সাথে দাদার বিজনেসে বসতে শুরু করে। আমার চাচারা তখন থেকে আমাদের উপর অধিকার খাটাতে শুরু করেন। বিশেষ করে আমার তিন নম্বর চাচা-চাচি যে কোনকিছু নিয়েই শাসন শুরু করে দিতেন। এটা করতে পারবা না, ওটা করতে পারবা না আরো অনেককিছু। এভবেই চলতে থাকে আমাদের দিন। আমার মায়ের পার্লারও চলতে থাকে ভালোই।
কয়েকবছর পর………
আমার দাদা চলে যান বিদেশে আমার ছোট ফুপুর কাছে। সেখানে আমার দাদার বাড়িও ছিলো। আমার দাদিও বিদেশে আমার বড় ফুপুর কাছে চলে যান। আমার বাবার বড় তিন ভাই আলাদা বাসায় থাকতেন। আমার ছোট চাচারা দাদার বাড়িতে সেকেন্ড ফ্লোরে থাকতো। ফার্স্ট ফ্লোরে মায়ের পার্লার ছিলো ও আমরা থাকতাম । এরমধ্যে আমার দুই ও তিন নম্বর চাচা আমাদের সাথে বাজে আচরণও করা শুরু করে। প্রতিদিন আমার বাবা কাজ শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে অনেক রাত করে বাসায় ফিরতেন।
হঠাৎ একদিন দেখি বাবা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসেন। অনেকটাই অস্বাভাবিক দেখা যায় বাবার শারীরিক অবস্থা। বাবা বাসায় এসেই বলে যে বাবার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয় বাবার বমি। আলো একদম সহ্য করতে পারছিলেন না। এমনকি কোন শব্দও শুনতে পারছিলেন না। বাবার সময়টা নানা অস্থিরতায় কাটতে থাকে।
ঘণ্টাখানেক পরে বাবার শরীর আরো বেশি খারাপ হতে থাকে। প্রচণ্ড জ্বর আসে বাবার শরীরে, ডায়রিয়া শুরু হয়। চোখ লাল হয়ে যায়। আমার মা: বাবার এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়। আমার মা ফরেন, তাই এ দেশের কিছুই আমার মা চিনতো না। তাই ফোন করে আমার বড় চাচাকে মা সব বলেন। কিন্তু আমার বড় চাচা আমার মাকে বলেন কোনো টেনশন না করতে। এসব কোন ব্যাপার না। ঠিক হয়ে যাবে। ফোন রেখে দেয় আমার বড় চাচা। তারপর মা ছোট চাচাকে ডাকে।
ছোট চাচাও একই কথা বলেন। এমন অবস্থায় আমার বাবার শরীর আরো বেশি খারাপ হতে থাকে। মা কোন উপায় না দেখে নিচে নেমে সিকিউরিটিদের ডাকে। তারাও চাচাদের মত একই কথা বলেন।
আমার মায়ের পার্লারের কর্মীরা পার্লারেই থাকতেন। অবশেষে কোনো উপায় না দেখে আমার মা তাদের সহায়তা নিয়ে হসপিটালে যান। হসপিটালে ভর্তি করা হয়। বাবাকে।
বাবার অবস্থা দেখে ডাক্তার কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। ঘণ্টাখানেক পর বাবার মেমোরি প্রায় লস্ট হয়। বাবা আমাদের কাউকেই চিনতে পারছিলেন না। তাই নানা টেস্ট করতে দেন বাবার। বাট রিপোর্ট আসবে পরের দিন সকালে। বাবাকে তাই ইনজেকশন দিয়ে ঘুমের মধ্যে রাখা হয়। দুইঘণ্টা পর আমার বড় চাচা ফোন করে বলতে থাকে যে সব ঠিক হয়ে যাবে। ও কিছু না ।
পরের দিন সকালে বাবার টেস্টের সব রিপোর্ট আসে। রিপোর্টে দেখা যায় সবকিছু নরমাল। শরীরের কোথাও কোন সমস্যা বাবার নেই। এ কথা শুনে আমার মা চাইলেন বাবাকে দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করাতে। ওইদিন সকালেই আমার মেঝ চাচি আমার ছোট চাচাকে সাথে নিয়ে হসপিটালে এসে আমার মায়ের কাছ থেকে আমাদের পাসপোর্ট চায় ভিসার করার জন্য। আমার মা তাদের সাথে বাসায় গিয়ে তাদেরকে পাসপোর্ট দিয়ে চলে আসে।
তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় আমার বড় চাচা এক কবিরাজকে নিয়ে হসপিটালে আসেন বাবাকে ঝাড়-ফুঁক করার জন্য। কবিরাজ বাবাকে ঝেড়ে চলে যান। তখন বড় চাচা মাকে বলেন বাসায় যেয়ে রেস্ট নিতে, ঘুমাতে, নয়তো মা অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তিনি আজ হসপিটালে থাকবেন। বাবার দেখাশোনা তিনি করবেন। মা একথা শুনে আমাদের নিয়ে চলে আসেন।
পরেরদিন সকালে মা বাবার জন্য নরম খাবার রান্না করে আমাদেরকে নিয়ে হসপিটালে যায়। হসপিটালে যেয়ে দেখি বাবার কেবিনে নার্স, বড় চাচা কেও নেই । বাবার বেডে অনেক রক্ত! আমার বাবা উপরের দিকে অসহায়ের মত মুখ করে তাকিয়ে আছেন। বাবাকে দেয়া স্যালাইন ও অক্সিজেন কে যেন খুলে ফেলেছে! যার কারণে বাবার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছে! রক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এমন পরিস্থিতি দেখে হাতের খাবার ফেলে দিয়ে আমার মা দৌড়ে নার্স ও ডাক্তার ডেকে বাবার অক্সিজেন ও স্যালাইন লাগায়। বাবার অবস্থা দেখে ডাক্তার বলেন যে অবস্থা ভালো না। তাকে লাইফ সাপোর্টে দিতে হবে। এ কথা শুনে আমার মা খুবই ঘাবড়ে যান। কারণ তখনকার সময়ে বাংলাদেশে একটিমাত্র হসপিটালেই লাইফ সাপোর্টের ব্যবস্থা ছিলো। এ ঘটনার ১ ঘণ্টা পর আমার বড় চাচা আসেন। তাকে মা বাবার দেখাশোনার দায়িত্বের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি ঠাণ্ডা মাথায় বলেন এ নিয়ে কোনো টেনশন না করতে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি আশেপাশেই ছিলেন। কোনো সমস্যা হবে না। তবে কষ্টের বিষয় হলো তিনি কোনোরকমের সহযোগিতাই আমাদের করেননি। কেবল মুখেই বলে যাচ্ছিলেন।
এদিকে মেঝ চাচি আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে আটকে রেখেছেন। এবং বাবার বাড়ির কেউ আমাদের আর্থিকভাবে সহায়তাও করছিলো না। আমার নানার পরিবার এক্ষেত্রে আমাদের আর্থিকভাবে সম্পূর্ণ সাপোর্ট দেন। শেষে আমার মা বাবাকে লাইফ সাপোর্টে দেয়ার জন্য ওই হসপিটালে ভর্তি করান যে হসপিটালে লাইফ সাপোর্টের ব্যবস্থা ছিলো। আমার বাবার তখন পুরো মেমোরি লস্ট! বাবা হসপিটালে একা থাকেন। কারণ লাইফ সাপোর্টে রোগী রাখলে সেখানে আর কেও থাকতে পারে না।
লাইফ সাপোর্টে ওই আগের অবস্থায়ই বাবার চলতে থাকে। বাবার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না! আমার বাবার এমন খারাপ অবস্থায় আমার মায়ের কান্নাকাটি আরো বেড়ে যায়। আমরা দুইভাইবোনও খুব কাঁদতে থাকি। কিন্তু আমাদের মাথায় স্নেহের হাত রেখে সান্ত্বনার বাণী দেবার মতও কেউ ছিলো না।
আমার মায়ের পরিবার বিদেশ থেকে আমাদের আর্থিক সাপোর্ট দিচ্ছিলো। এখানে বাবার পরিবার আমাদের মেন্টালি সাপোর্টও দেয়নি; বরং আমাদের দেশের বাইরে যেয়ে বাবার চিকিৎসা করার রাস্তাও পাসপোর্ট আটকে রেখে বন্ধ করে দিয়েছিলো! তারা এটা কেন করছিলেন আমার মা তখন তা বুঝেননি। কারণ আমার মা ফরেন। এদেশের মানুষের মনের এত প্যাচ আমার মা আজও বোঝেন না।
বাবাকে লাইফ সাপোর্টে দেবার দুইদিন পর রাত একটার দিকে আমি বাবাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠি। মা আমাকে পানি খাইয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। এমন সময় আমার বড় চাচা আমাদের বাসায় আসেন। রাত তখন একটা বিশ মিনিট হবে। আমার বড় চাচা এসে খুবই সাধারণভাবে আমাদেরকে বলেন যে আমার বাবা আর এ পৃথিবীতে নেই! আমার বাবার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা হবে। আর বাবাকে বাড়িতে আনা হবে না। হসপিটাল থেকেই তাকে দাফন করা হবে।
বড় চাচা আমার বাবার মৃত্যুর ও কাফন-দাফনের কথাগুলো এমনভাবে বললেন যে, কিছুই হয়নি। অথচ আমার বাবা আর পৃথিবীতে নেই। আমরা দুই ভাইবোন চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করি। আমার মা তখন আমার বড় চাচাকে বলেন যে বাবার লাশ বাড়িতে আনার জন্য। কিন্তু আমার বড় চাচা নানাকিছু বুঝিয়ে বাবাকে বাসায় আনতে রাজি হলেন না। এবং বাসায় আনেওনি! আমার মা খুব কাঁদেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
পরেরদিন সকাল ১০ টার দিকে আমার বাবাকে গোসল করানো হয়। জানাজা পড়ানো হয়। ১১ টার দিকে বাবার লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু আমার বাবার লাশ আমাদের বাড়িতে আনা হয়নি!
ছয় মাস পর……
আমার চাচা ও চাচিরা হুমকি দিয়ে আমার মায়ের পার্লার বন্ধ করে দেয়। আমাদের উপর নানারকম মানসিক অত্যাচার শুরু করে দেয়। আমার বাবার নামে যা কিছু ছিলো সব তাদের নামে করে নেয়। আমার ভাই তখন ক্লাস সেভেনে পড়তো আমার চাচারা তখন বলে যে পড়াশোনা করিয়ে কোনো লাভ নেই। তাদের সাথে বিজনেস করতে বলে। আমার মা তখন বুঝে যায় যে আমার বাবার সাথে যা হয়েছে আমার ভাইয়ের সাথেও তাই হতে যাচ্ছে। তাই মা আমার ভাইকে লেখাপড়া করার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দেয়। আমার নানার সহযোগিতায়।
আমার দাদা বিদেশে এসবের সবই জানতেন। কিন্তু কখনো কিছু বলার সাহস পেতেন না। কারণ আমার চাচারা সামান্য কিছুতেই আমার দাদার গায়ে হাত তুলতেন। যে কারণে তার বিদেশ যাওয়া। তিনি আমাদের এ অবস্থার কথা জেনে বিদেশের তার একটি বাড়ি আমাদের নামে লিখে দেন। আমার চাচারা সেই বাড়িটিও তাদের নামে করে নেন।
এদিকে আমাদের বিভিন্নরকম অত্যাচার করে দাদার বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমি ও আমার মা এখন ঢাকার এক এলাকায় একটি বাসা ভাড়া করে থাকি। আমার ভাই যা টাকা পাঠায় তাই দিয়ে আমাদের জীবন চলছে।
আর আমি!! ছোটবেলায় আমার চোখে কিছুটা সমস্যা ছিলো। আমার বাবাকে হারানো, ভাইয়ের দুরত্ব, পরিবার ভেঙে যাওয়া, আত্মীয়দের কাছ থেকে একের পর এক মানসিক অত্যাচার পাওয়া হয়েছে আমার প্রতিনিয়ত! এই কারণগুলোই প্রতিনিয়ত আমায় কাঁদতে শেখায়! যার ফলে আজ আমি পুরোপুরি অন্ধ!
আমার বন্ধু বলেন, ভালোবাসার মানুষ বলেন অথবা প্রিয় মানুষ যাই বলেন না কেন; আমার সেই একমাত্র মানুষটিই হলেন আমার মা! যার সাহায্য ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অচল! আজ আমার লেখাপড়াও সম্পূর্ণ বন্ধ । আর কখনো পারবও না পড়তে! তাই আজ এভাবেই চলছে আমার জীবন! জানিনা কোন নদীর কিনারায় গিয়ে থামবে এ জীবনের নৌকা!