আজ থেকে সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবী সবে মাত্র সৃষ্টি হয়েছিল তখন একটা সময় পৃথিবীর কাছে এরকম ছিল যখন পৃথিবীর কোনো চাঁদ ছিল না। কিন্তু তারপর কিছু বছর পরেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যেটা সৌরজগতের সব কিছু পাল্টে দেয়। আজ থেকে ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবী একাই সূর্যের চারিদিকে ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু একদিন এই অনন্ত মহাশূন্য থেকে একটা মঙ্গল গ্রহের সমান সাইজের জিনিস পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খায়, যার ফলে পৃথিবীর কিছু টুকরো মহাকাশে ছিটকে যায়।
কিন্তু পৃথিবীর মহাকর্ষ বল এতটাই শক্তিশালী ছিল যে সে টুকরো গুলোকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে শুরু করে, আর এই কারণে ওই টুকরোগুলো পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এসে একে অপরের সঙ্গে জোড়া লেগে একটা গোলাকার উপগ্রহের সৃষ্টি করে। এটা একটা এমন ঘটনা ছিল যেখানে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা একটা এমন জিনিসকে জন্ম দেয় যেটা খুবই সুন্দর ছিল। আর ছিল খুব মায়াবী। তখনই জন্মনেয় আমাদের সবার প্রিয় চাঁদ।
এই ঘটনার পরেই পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব শুরু হতে থাকে। প্রাণের সঞ্চার ঘটে আমাদের এই পৃথিবীতে। এই জন্য কিছু বিজ্ঞানীদের থিয়োরি এটা বলে যে চাঁদের কারণেই পৃথিবীতে জীবন শুরু হয়েছিল, যদি চাঁদ জন্ম না নিতো তাহলে পৃথিবীতে কখনো জীবনের সঞ্চার হতো না। কিন্তু কিভাবে? চাঁদ আমাদের পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টি করলো কিভাবে? এই জিনিসটা জানার জন্য আপনাদের দেখতে হবে যদি চাঁদ না থাকে, মানে কোনো কারণে যদি চাঁদ কোনো একটা বিস্ফোরণের কারণে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আমাদের পৃথিবীর অবস্থা কি হতে পারে? এই আর্টিকেলটি পড়ার পর আপনি সম্পুর্নভাবে বুঝতে পারবেন যে চাঁদ আমাদের জন্য কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার যত অনুমান অর্থাৎ হাইপোথিসিস আছে তার মধ্যে সবচেয়ে এই বিষয়টা বেশি বিপদজনক। আমরা জানি যে আমাদের পৃথিবীর ৭ ভাগ পানি ও ৩ ভাগ স্থল। আর এই পৃথিবীর ৭ ভাগ পানিকে যদি সত্যিকার অর্থে কেউ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তাহলে সেটা হলো চাঁদ। চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর সমুদ্রের পানিকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। যার কারণে সমুদ্রের জোয়ার ভাটা হয় এবং সমুদ্রের জলের স্তর অনেক উঁচু পর্যন্ত উঠে যায়।
আমরা সব সময় দেখে থাকি সমুদ্রের বড় ঢেউ উঠতে। যা দেখে আমরা স্বাভাবিকভাবে মনে করি যে এগুলো হয়তো বাতাসের কারণে। বাতাসের যোগদান এই ঢেউ গুলোকে তোলার পেছনে খুব অল্প থাকে। সমুদ্রে এই ঢেউ গুলো ওঠার প্রধান কারণ হলো চাঁদের টান। ভাবলে সত্যি আশ্চর্য লাগে, যে চাঁদ আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় তিন লক্ষ চুরাশি হাজার চারশ কিলোমিটার দূরে আছে তার আকর্ষণের জন্য আমাদের সমুদ্রের মধ্যে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি হয়! যে চাঁদ সমুদ্রের জলকে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে নিজের দিকে টানছে। আসলে সূর্য মহাকর্ষ বলের সাহায্যে সমুদ্রের পানিকে নিজের দিকে টানে, কিন্তু যেহেতু সূর্য পৃথিবী থেকে অনেক দূরে সেই কারণে সূর্যের প্রভাব সমুদ্রের জলের উপর খুব একটা পড়ে না। এই কারণে সূর্য চাঁদ এর থেকে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও দূরত্বের কারণে সমুদ্রের জলের ওপর এর প্রভাব খুব একটা পড়ে না। এর অর্থ হলো চাঁদ এবং সূর্য মিলে একসঙ্গে সমুদ্রের জলকে নিজের দিকে টানছে।
কিন্তু এইবার আমরা একটা হাইপোথিসিস মানে অনুমান করতে চলেছি, কাল্পনিকভাবে যদি আমরা ধরে নিই যে চাঁদ কোনো একটা কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখান থেকে যদি আমরা চাঁদকে সরিয়ে দিই তখন কি হবে? সবকিছু আগের কি আগের মতোই থাকবে? নাকি পৃথিবী ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে? চলুন বিষয়টি আরো ভালভাবে বোঝা যাক।
এই ক্ষেত্রে সূর্য আর পৃথিবীর মাঝখানে চাঁদ থাকছে না, মানে সমুদ্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সূর্যের কাছে চলে যাবে। আর তখন যেটা হবে হয়তো তাকেই বলে মহাপ্রলয়। সূর্যের মহাকর্ষ বল সমুদ্রের পানিকে অতটা প্রভাবিত করতে পারে না। এই কথাটা ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যি ছিল যতক্ষণ আমাদের সাথে চাঁদ ছিলো। কিন্তু যেই মুহুর্তে চাঁদ ধ্বংস হয়ে যাবে তখন সমুদ্রে হঠাৎ করেই অনেক উঁচু উঁচু ঢেউ উঠতে শুরু করবে। উঁচু উঁচু ঢেউ মানে অনেক উঁচু উঁচু। চাঁদের ধ্বংস হওয়ার কেবল মাত্র এক মিনিট পরেই দানবীয় ঢেউ, সুনামি আর বড় বড় টর্নেডো পুরো পৃথিবীর যত উপকূলীয় এলাকা আছে সেগুলোকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করবে।
এই কারণে প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে একটা আশ্চর্য রকমের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে যাবে। এরপর প্রায় ৫ মিনিট পর সারা পৃথিবীর সমুদ্রের মধ্যে যত ছোট ছোট দ্বীপ আছে সে সবগুলোই সম্পূর্ণভাবে জলের তলায় চলে যাবে। সমুদ্র এলাকায় যত শহর আছে সেই শহরের সমস্ত লোক নিজের চোখে নিজের শহরের ধ্বংস নির্বাক দর্শকের মতো দেখতে থাকবে। কিন্তু কিছুই করতে পারবে না। এরপর প্রায় এক ঘন্টা পর উপকূল এলাকায় যত শহর এবং গ্রাম ছিল সে সবই সমুদ্রের তলায় তলিয়ে যাবে এবং ঠিক তখনই হঠাৎ করে এই তাণ্ডব এই হাহাকার শান্ত হয়ে যাবে।
কারণ পৃথিবীর যত সমুদ্র আছে তারা নিজেদের পানির স্তরকে ব্যালেন্স করে নিবে। এই কারণে আর বড় বড় ঢেউ উঠবে না। এর থেকে একটা ছোট্ট জিনিস আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে চাঁদের ধ্বংস হয়ে যাবার মাত্র কিছুক্ষণ পর্যন্তই এই ধ্বংস চলতে থাকবে। কিন্তু শুধুমাত্র এই একঘন্টার ঘটনার জন্যই পৃথিবী আগের থেকে হাজার গুণ পাল্টে যাবে।
এরপর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর যা হবে– রাত্রেবেলা আমাদের আকাশে চাঁদ উঠতো ও ডুবে যেত। কিন্তু আমরা কেউই সেটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতাম না। এখন যখন আকাশে চাঁদ নেই তখন মানুষ চাতক পাখি যেমন জলের জন্য হাহাকার করে সেই ভাবে চাঁদের একবার দর্শনের জন্য হাহাকার করবে। কথায় আছে না যে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝেনা। এরপর আরো একটা খুব ভয়ঙ্কর জিনিস ঘটবে, একটা জিনিস তো আপনি ভূগোলে নিশ্চয়ই পড়েছেন যে পৃথিবী সাড়ে ৬৬ ডিগ্রি কোণে হেলে আছে। আর এরকম হেলানো অবস্থায় এটা সূর্যের চারদিকে আবর্তন করছে।
কিন্তু পৃথিবী এই সাড়ে ৬৬ ডিগ্রী কোণে হেলে আছে কিসের জন্য? এটা ওই চাঁদের জন্যই। কিন্তু যদি চাঁদ না থাকে তাহলে পৃথিবী নিজের ঘূর্ণনের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবে এবং খুব ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁপতে থাকবে। আর এর জন্য পৃথিবীতে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় ঋতু পরিবর্তন হবে। এরকম হতে পারে যে যেখানে মানুষ গরমের জন্য অতিষ্ঠ হয়ে পড়তো সেখানে বরফের বৃষ্টি হওয়া শুরু হয়ে যেতে পারে। আর যেখানে বরফ পড়তো সেখানে চোখ ঝলসানো রোদ্দুর কপাল থেকে ঘাম বের করে দিচ্ছে।
পৃথিবীর উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু যেখানে সব সময় বরফ জমে থাকে সেখানে তখন ঝলমলে উঠতে শুরু করবে। এরকম হতে পারে যে ঢাকায় তুষারপাত হচ্ছে। আর এইগুলো এজন্য হচ্ছে কারণ পৃথিবী নিজের অ্যাকসেসের ওপর কাঁপছে চাঁদের না থাকার কারণে। সৌরমণ্ডলের অন্যান্য গ্রহ ও সূর্যের ওপরে তো কোনো প্রভাব পড়বে না। ঠিক একইভাবে পৃথিবীও সূর্যের চারপাশে চক্কর লাগাবে, কিন্তু চাঁদের না থাকার কারণে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে চক্কর লাগাতে লাগাতে ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁপবে। এজন্য পৃথিবীতে ঘন্টায় ঘন্টায় ঋতু পরিবর্তন হবে। এর অর্থ হলো পৃথিবীতে সেসময় ঋতু নামে আর কিছুই থাকবে না।
এর মানে আমাদের চেনা পৃথিবী এক নিমিষেই অচেনা হয়ে যাবে। পৃথিবীর এই কাঁপার কারণে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কিছুক্ষণ পরপর ভয়ঙ্কর রকম ভূমিকম্পের দেখা দিবে। আর এর কারণে পৃথিবীর যত আগ্নেয়গিরি ছিল সেগুলো সব জীবন্ত হতে শুরু করবে। তাহলে একবার ভেবে দেখুন এই পরিস্থিতি যদি হয় তাহলে কি অবস্থা হবে পৃথিবীর।
আমরা এতক্ষণ পৃথিবীর চাঁদ না থাকার কারণে যেই বিপদ গুলো আসতে পারে সেগুলো সম্পর্কে জানলাম। এখন আমরা আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য সম্পর্কে জানবো যেটি জানার পর আপনি হয়তোবা চমকে উঠবেন। অনেক বিজ্ঞানীরাই এটা মনে করে যে একদম এরকম ধরনের ঘটনা মঙ্গল গ্রহের সাথেও ঘটেছিল। বিজ্ঞানীরা মনে করে যে মঙ্গল গ্রহেরও আমাদের পৃথিবীর মতো একটি চাঁদ ছিল। আর মঙ্গলে জীবনও ছিল, কিন্তু একদিন একটা সুপারনোভা থেকে আসা গামা বিস্ফোরণের কারণে মঙ্গলের ওই চাঁদ ধ্বংস হয়ে যায়। আর এর পরেই মঙ্গল গ্রহ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তারপর কয়েক বছর যেতে না যেতেই মঙ্গলের পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়ে যায় যে ওখানে বসবাস করা একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর মঙ্গলের জীবন একেবারে শেষ হয়ে যায়। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো বিজ্ঞানীরা আসলেই দেখেছে যে মঙ্গল গ্রহ তার অ্যাকসেসের ওপর কাঁপতে থাকে অর্থাৎ কেঁপে কেঁপে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। ঠিক সেভাবেই যেভাবে আমরা উপরে আলোচনা করলাম।
এই বিষয়টি জানার পর আপনার মনে হতে পারে যে পৃথিবীর চাঁদের সাথে যদি এমনটা হয় অর্থাৎ বাস্তবেও যদি পৃথিবীর চাঁদ ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আমাদের কি হবে? সে ক্ষেত্রে মনে রাখুন পৃথিবীর জন্য একটি সুখবর আছে, সেটা হলো যে আমাদের পৃথিবীর আশেপাশে এরকম কোন স্টার নেই যেটা নিকট ভবিষ্যতে সুপারনোভাতে পরিণত হতে পারে সুতরাং এ বিষয় নিয়ে তেমন কোনো চাপ নেই।
আমাদের পৃথিবীর সবথেকে কাছে যে তারাটা আছে তার নাম আলফা সেন্টোরি। যেটা পৃথিবী থেকে ৪.৩ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আর ঐ নক্ষত্র আমাদের সূর্যের মতো একেবারে সুস্থ আছে। আর ওই তারাটা যদি মারাও যায় তাহলে ওর সুপারনোভাতে পরিণত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ আমাদের পৃথিবীর চাঁদের সাথে এমন ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু আমার বিশ্বাস এই ঘটনা থেকে পৃথিবীর জন্য চাঁদ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আপনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।