শোঁ-শোঁ বাতাসের শব্দ। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, পাশে দাড়িয়ে কোনো এক দেবতা হাতে ত্রিশূল। চোখগুলো ঘোলাটে, সবকিছু কেমন আবছায়া দেখাচ্ছে, আমার ওড়নাটা উড়ছে পত-পত করে দেবতার হাতে পতাকার মতো।
আচ্ছা! সে কি দেবতা নাকি শয়তান? আমাকে ত্রিশূলের আঘাতে হত্যা করতে উদ্যত নাকি বাঁচাতে? চক্ষুদ্বয় ছোট করে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কী করছে সে? না কিছু না, দাড়িয়ে আছে সুধু। আরো অনেকে দাড়িয়ে এভাবে, হয় দেবতা নয়ত শয়তান। এটা নাকি চাক-কাটা ঘর । কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না, ভিতরটা কেমন বরফশীতল হয়ে আছে আমার। শীতল হয়েও ভীতরটা পুড়ে যাচ্ছে কেন? অনেক শীতলতা কী পোড়ায়?
বাইরে সমুদ্র, পাশ দিয়ে নদী প্রবাহিত, আমি নদীর পাড়ে শুয়ে আছি, জানালা দিয়ে সমস্ত পানি সমুদ্রে আছড়ে পড়ছে। আমি ঘুমের কোলে ঢলিয়ে পড়ছি। না! অন্য কিছু হচ্ছে, এরা দেবতা নয় এরা শয়তান! মরনাস্ত্রে সজ্জিত নেশাগ্রস্ত শয়তান। ছুড়িকাঘাতে আমার মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। আমার মগজ নিয়ে খেলছে, কিছুই বলতে পারছি না, শুধু দেখছি, আমার যে বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে আমার মরণ। না না ! তোমরা আমার পেটটা ছোঁবে না ওখানে আমার একটা মানিক আছে, আমার সন্তান। আমাকে যত পার আঘাত কর, ব্যাথা দাও, ওকে তোমরা ব্যাথা দিও না। না কেউ আমার কথা শুনলো না, আমার মানিকটাকে ওরা পেট চিরে বের করলো, আমার কলিজা, ফুসফুস।
আচ্ছা আমি কী অপরাধ করেছি? আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন? মরে যাওয়া কি আমার অপরাধ? আমি তো মরিনি, আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সবাইকে বিশ্বাস করতাম ওরাই তো আমাকে ধোঁকা দিল। আমার মা তো আমার মরে যাওয়া দেখেছিল, তার চোখের কোনায় পানি জমেনি কেন ? হয়ত বুকটা তার কেঁপে উঠেছে কিন্তু চিৎকার করেনি কেন? আমার উপর এত রাগ জমা করে রেখেছিল কেন? যার মা তার সন্তানের মরে যাওয়ায় নিশ্চিত হয় তার কি পৃথিবীতে বেঁচে থাকা শোভা পায়? তাই তো মরে গেছি।
বিশ্বাস করেছিলাম রায়হানকে। ওতো আমাকে কথা দিয়েছিল আমাকে বিয়ে করবে। বিয়ের আগেই আমাকে বউ ডাকতো। আমি তো বোকা ছিলাম না, শুধু বিশ্বাস করতাম খুব। ভাবতাম সে ভগবান হবে আমার জন্য, পুষ্পের মতো পবিত্র মন, আমাকে চায়। আমার স্বামী হবে তাই তো ওর সঙ্গ দিয়েছিলাম, আমি কি ভুল করেছিলাম? কিন্তু ও তো আমাকে হেলা করছিল, একবার সাফ জানিয়ে দিল এখন নাকি বিয়ে করতে পারবে না। আমার যে মানিকটাকে আমি মেরে ফেলতে পারিনা। ওকে মারার চেয়ে নিজে মরাই তো ভালো মনে করেছি। আমি কি ভুল করেছি মরে গিয়ে?
না না, আমিও ওকে ভালোবাসতাম না। মনে পড়েছে আমার সব। আমাকে সবাই অবহেলা করত, সেদিন থেকে যেদিন থেকে আমি একটা কিডনি নিয়ে বেঁচে ছিলাম। মা’কে কত বলতে শুনেছি, “একটা কিডনি ! বাঁচবে আর ক’দিন?” কিন্তু আমি মরিনি। যখন বিয়ের বয়স হলো কত চেষ্টা করল বিয়ে দিতে, কিন্তু কেউ বিয়ে করলো না। একটা কিডনি নিয়ে কেউ নাকি বাঁচে না। কত দুশ্চিন্তাই তো করল। বয়স বেড়ে যেতে থাকল, আমার ব্যবস্থা আমিই করবো বলে ভাবলাম, প্রেম করলাম। তাকে বুঝালাম অনেক ভালোবাসি। মন দিয়ে, শরীর দিয়ে বুঝালাম, যেন বিয়েটা আমাকেই করে। তবে সে যে আমাকে ধোঁকা দিতে চাচ্ছিল আমি তো বুঝে গিয়েছিলাম। সবাই শরীর নিয়ে খেলে, শেষ হলে চলে যায়। সৎ, বিশ্বস্ত ও দয়ালু হৃদয়ের মানুষ পাওয়া খুব কঠিন।
মানুষরা এমন হয় কেন? আমার কী অপরাধ ছিল? আর আমি কি মরে গিয়ে অপরাধ করেছি?
মা! আমাকে তোমাদের কাছে রাখতে পারলেনা কেন? এতটাই অবহেলা যখন করবে আমাকে সেদিন বাঁচালে কেন মা, যেদিন আমি মরে যাচ্ছিলাম কিডনি পঁচে ? আমাকে এত যত্ন-আত্তি করলে কেন? আমার যে মরে যেতে অনেক কষ্ট হয়েছে আজ, সবাইকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল জানো ? যখন ফ্যানের সাথে ঝুলছিলাম, গলায় চাঁপ লেগেছিল খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আর একবার বাঁচতে। মা! কত বার তোমাকে ডেকেছি, একবার বাঁচার আকুতি জানিয়েছি শোনোনি তুমি? আমাকে বাঁচালে আমি তোমাদের ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতাম, অনেক দূরে । মরে যেতে অনেক কষ্ট হয় মা, অনেক কষ্ট। মনে অনেক অভিমান ছিল তাই মরতে পেরেছি হয়ত।
মা! এমন সন্তান জন্ম দিওনা যার বেঁচে থাকা তোমাদের বোঝা মনে হবে, এমন ভাবে তোমার সন্তানকে বাঁচিয়েও রাখবে না যাকে কোনো এক সময় আর ভালোবাসতে পারবে না। অবহেলিত হবে সবার কাছে। তোমরাই তাকে মেরে ফেলে দিও কোনো এক রাতের অন্ধকারে, যেন নিজে নিজে মরতে না হয়। খুব আফসোস আর যন্ত্রনা নিয়ে মরতে হয়। মরার পরেও শান্তি পাইনা, দেখোনা আমার শরীরটা কেটে কেটে কী করেছে এরা! সবাই এমন কেন? পৃথিবীতে শয়তান ছাড়া কোন ভগবানের দেখা পেলাম না কেন আমি? তোমার ঘরেই তো তোমার ছেলে থাকে, কত মা’কে তো সেই ছেলেরাই ঘর থেকে বের করে দেয় যখন বৃদ্ধাবস্থায় অসহায় হয়ে পড়ে, তবুও তো ছেলেরা তোমাদের বোঝা হয় না! মেয়েরা বোঝা হয় কেন?
হোক, তোমরা সুখে থাক পৃথিবীরনির্দয় মানুষেরা। যারা মরার পরে আমাকে নিয়ে দয়া দেখাও। আমার অভিশাপ তোমাদের কপাল পোড়াবে। আমার এই কেটে কুচি কুচি করা শরীরটার কি মাটিতে একটু জায়গা হবে? কবর দিলে আমার মানিকটাকেও আমার সাথে রেখে দিও। আমি চিরতরে ঘুমিয়ে থাকবো সেখানে, মাটির নিচে। তবে আমার আত্মা ঘুমাবে না, যতদিন না আমার মৃত্যুর করুণ কান্না তোমাদের না শোনাতে পারে। আমি আসছি। আমার চোখে এখন আর কান্না নেই ক্ষতবিক্ষত রক্তচক্ষু আমার। আমার মনে প্রতিশোধ জাগ্রত, রাস্তা ছেড়ে বাসা অভিমুখে, সবার সাথে কথা আছে আমার, অনেক কথা। প্রতিশোধের কথা, অভিশাপের কথা।