কখনো ভেবে দেখেছেন কি? হাজারো সমস্যা মোকাবেলা করে টিকে থাকা এই আমরা যখন কোন সমস্যার মুখোমুখি হই তখন সমাধানের পথ বের করার জন্য কি করি?
হয়তো অনেকেই পরিস্থিতি সাপেক্ষে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে সমাধানের পথ বের করার চেষ্টা করি। অথবা নিজের থেকে অভিজ্ঞ বা শুভাকাঙ্ক্ষী কারো কাছে নিজের সমস্যাগুলো প্রকাশ করি এবং ভালো কোন সমাধান নেওয়ার চেষ্টা করি। যে যাই করি না কেন, সকলেই একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে চাই যে পথে অদূর ভবিষ্যতে তেমন কোনো বাধা-বিপত্তি আসবেনা। আমরা সামাজিক জীব। তার থেকেও বড় কথা হলো আমরা পরিবারে বাস করি। পরিবারের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমরা সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বা আমাদের কর্মজীবনে বাস্তবায়ন করি। পরিবারের সাথে নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। যেহেতু মানুষকে পরিবারে ও সমাজে উভয় স্থানে সসম্মানে বাস করতে হয়, তাই সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলাটা অত্যন্ত জরুরী।
নিজের আগ্রহ কে প্রাধান্য দিয়ে কেউ যদি সমাজে একটি সম্মানিত অবস্থান অর্জন করে, তার মানে এই নয় যে তাকে পরিবারের সিদ্ধান্তগুলো কে অবহেলা করতে হবে। আবার আবেগবশত পরিবারের সিদ্ধান্ত গুলোকেই ১০০% যৌক্তিক ভেবে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাটাও কোনভাবেই কাম্য নয়। জীবনে “সামঞ্জস্য” ও “ভাবার্থ”এর নির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা নেই। তবে উপলব্ধির বিস্তারটা ব্যাপক। কারণ প্রত্যেকের জীবনে সমস্যা গুলো যেমন অনেকক্ষেত্রেই আলাদা; তেমনই সমাধানগুলোও আলাদাই হতে হয়।
আমাদের জীবনে বাহ্যিক সমস্যাগুলো কি কি? যেমন: অর্থাভাব, চাকুরির অভাব, পরিবারের চাহিদাগুলো পূরণ করতে না পারা, নতুন ব্যবসায় লস খেয়ে বসা, টাকার অভাবে বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে না পারা, প্রেমের সম্পর্ক উভয়ের ফ্যামিলি মেনে নিতে না পারা….. ইত্যাদি ইত্যাদি। জীবনে এই সমস্যাগুলোর বিচরণে প্রাত্যহিক জীবনটাও যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। কোমর যেন ভেঙে পড়তে চায়। অথচ আমাদের সমাজে এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে সফলতার মুখ দেখা লোকেদেরও কিন্তু আনাগোনা কমও নয়। আমরা সুযোগ পেলেই যেন তাদের কাছে মন খুলে কথা বলতে চাই, তাদের থেকে সমবেদনা-সান্তনা-অনুপ্রেরণা খুঁজে পেতে চাই। মোটকথা তাদের দেখানো পথ বা যুক্তিতে একটু ভরসা রেখে মাথা ঠান্ডা করে এগিয়ে যেতে চাই।
আমাদের সমাজ বলতো গুরুজনের কথা শুনো, এখন বলে সফল মানুষদের অনুসরণ করো। কারণ তারা জীবনে হাজারো জঞ্জাল মাড়িয়ে আজ এই অবস্থানে আসতে পেরেছে। তাদের বলা প্রতিটি কথা জীবনমুখী শিক্ষা হতেই পারে, হতে পারে আমাদের জীবনে এগিয়ে যাওয়া অন্যতম সাপোর্ট। তবে আবেগবশত যেকোন সফলতার গল্পপের শিক্ষাগুলোকে নিজের বিবেকের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সমীচীন নয়।
পৃথিবীর যেকোন কিছু থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে পরিশ্রমী প্রাণি পিঁপড়া থেকেও অক্লান্ত পরিশ্রমের মানসিকতার শিক্ষা নেওয়া যেতেই পারে। তাই বলে পিঁপড়া নিজের ওজনের ১০গুণ ওজন তুলতে পারে বলে আপনিও নিজের সামর্থ্যের বেশি দায়িত্ব-কর্তব্য বা ব্যর্থতার বোঝা ঘাড়ে তুলে নিতে পারবেন; এমনটা নাও হতে পারে।
যেমন ধরুন, আপনার ব্যবসায় মন নেই। আপনি নতুন ব্যবসা খুলতে চাচ্ছেন যেখানে হয়তো আরো বেশি টাকা খাটাতে হবে। বাড়িতে আপনার মা খুব অসুস্হ, চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বাবার শরীরটাও খুব একটা ভালো নেই। পরিবারটাকে সেইভাবে সাজাতে পারছেন না। আবার নিজের বিয়েটাও এবার না সাড়লেই নয়। এখন আপনি কি করবেন?…..
আবার ধরুন, আপনি আপনার পছন্দের সাবজেক্টে অনার্স করতে চাইছেন। কিন্তু আপনার বন্ধুদের অধিকাংশই অন্য সাবজেক্টে অনার্স করতে চাইছে। সেক্ষেত্রে আপনি ভাবছেন তাদের পছন্দের সাবজেক্টে পড়তে না পারলে আপনি আপনার প্রিয় বন্ধুদের থেকে দলছুট হয়ে যাবেন। সেক্ষেত্রে আপনার কি করার?
দেখুন, জীবনে অন্যের থেকে মোটিভেশন নেওয়া ভুল কিছু নয়, অনুপ্রেরণা খুঁজে নেওয়া ভুল কিছুই নয়। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনি যদি কারো সাথে জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করার পরও কিছু নাই শিখতে পারেন, তবে তার সাথে মেশা কেন?
জীবনে আরেকজন যেই স্বপ্নটা দেখে সেই স্বপ্নটা আপনিও দেখতে পারেন। দোষের কিছু নয়। চিন্তা করুন যে ব্যাংকের ম্যানেজার পোস্টটার জন্য কত যু্বকই স্বপ্ন দেখেন। হয়তো সফল হয় কমই।
বস্তুত মানুষ স্রোতের দিকেই বেশি গাঁ ভাসাতে পছন্দ করে। পছন্দ-অপছন্দগুলো খুব বেশি সমাজ নির্ভর হয়ে গেছে। এই কথাগুলো অবশ্যই সত্য যে স্রোতের অনুসারী মানুষরাই সামঞ্জস্যতা ধরে রাখতে পারে। সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। সমাজের অবস্থান, পছন্দগুলো মেনে নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। তবে জীবনের কিছু সময় আসে যখন আপনার সমস্যা শেয়ার করার মতো কাউকে পাবেন না। মনের কথাগুলো বলতে পারবেন না। সমস্যাগুলো এতটাই ব্যক্তিগত হয়ে পড়বে যে তখন আপনার নার্ভ শক্ত না হলে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে আপনার জীবনটাকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আপনি বুঝে উঠতে পারবেন না।
যে ছেলেটা পুরনো ব্যবসা বাদ দিয়ে অন্যেরটা দেখে নতুন ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে চায়, সে নিজে একবার নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতেই পারে যে এই সংকটকালীন সময়ে তার নতুন ব্যবসায় আবার টাকা খরচ করাটা যৌক্তিক হবে কিনা। কারণ তার এই ফ্যামিলিগত সমস্যাকালীন নতুন ব্যবসায় লস খেয়ে গেলে হয়তো তার আর উপায় থাকবে না। যদি ব্যর্থ হওয়ার সম্ভবনাই বেশি থাকে, তবে বিবেকের সাথে বোঝাপড়াটা সেড়ে নেওয়া ভালো। কারণ একটা কথা আছে না? নিজের জীবনটাতো আর নিজের নয়। নিজের জীবনটা আরো দশজনের। পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজের নেওয়া সিদ্ধান্ত যেন আরো দশজনের উপর বিপদ না ডেকে আনে। আর যদি সে নতুন ভাবে ব্যবসায় মন দেবার মনোনিবেশ করে, তবে সে যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা যেন সঠিক থাকে সেই জন্য লড়াই করে যেতে হবে।
যে ছেলেটি নিজের বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে বন্ধুদের পছন্দের সাবজেক্টে অনার্স করার সিদ্ধান্ত নিলো,সে যেন নিজের এই সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। পথটা কঠিন হবে খুব। কারণ পছন্দ ও পরিস্থিতির সাপেক্ষে তারা উভয়ই ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত গুলো কে যথার্থ প্রমাণ করার দায়িত্ব তাদের নিজের। কারণ আমাদের কাছের মানুষরা যেমন আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী তেমনি আমাদের সিদ্ধান্তগুলোর কোন খারাপ প্রভাব তাদের উপর যেন না পড়ে সেই দিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। জীবনে চলার পথে প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি সিদ্ধান্তে আমরা বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। বিবেক ও উপলব্ধি দিয়ে নিজের পরিস্থিতি সাপেক্ষে নিজেদের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে জীবনটা অনেক ক্ষেত্রেই সহজ হয়।
দানিয়াল বলেছিলেন,”একটা সুন্দর মন অন্ধকারে আলোর মতো, যার মাধ্যমে কলুষতার মাঝেও নিজের অস্থিত্বকে মর্যাদাসম্পন্ন রাখা যায়।”
তাই সর্বদা অনুকরণ নয় বরং অনুভবেও জীবনটাকে এগিয়ে নিতে হয়।