ভারতের দশরথ মাঝির নাম শুনেছিলেন? Manjhi – The Mountain Man নামে বলিউডে যাকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও হয়েছিলো। রাস্তা না থাকায় নিজের স্ত্রীকে চিকিৎসকের কাছে নিতে না পারায় মারা যায় তার প্রিয় স্ত্রী। নিজেই নেমে পড়েন এক হাতুড়ি নিয়ে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরী করার জন্য। বাংলাদেশেও প্রায় এমনই এক ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে আছে। দেড় কিলোমিটার রাস্তা একাই বানিয়েছেন এক কৃষক।
তার গ্রামে কোনো রাস্তা ছিল না। ক্ষেতের আইল ধরে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পাকা রাস্তায় উঠে উপজেলায় যাতায়াত করতে হতো
প্রান্তিক কৃষিজীবী পরিবার। শত ব্যস্ততা। ঘরের কাজ, সন্তানদের দেখভালের পাশাপাশি সবজি ক্ষেত, গবাদিপশুর দেখাশোনা, পরিচর্যা, সবকিছু একা হাতে সামলাচ্ছেন লাকি বেগম। বেশ কিছুদিন ধরে তার কৃষক স্বামী সোইনুদ্দিন সংসারের কোনো কাজ করার সময় পাচ্ছেন না।কীভাবেই বা পারবেন? তিনি যে ব্যস্ত গ্রামবাসীর জন্য বিশেষ এক কাজে। এভাবেই দিন পেরিয়ে রাত হয়। আবার আসে ভোর। সোইনুদ্দীনের ব্যস্ততা তবুও শেষ হয় না।
একদিনের কথা, সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে লাকি বেগমের ক্লান্ত শরীরে ভর করছিল রাজ্যের ঘুম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে নেই। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১২টা ছাড়িয়ে গেছে। স্বামী সোইনুদ্দিন বাড়ি ফিরে তাকে ডেকে বললেন, “ভাইয়েরা চলে গেছে। আমি একা কাজ করছি। চল, আমাকে একটু সাহায্য করবে।”
কথা না বাড়িয়ে তিনি চলে গেলেন স্বামীর সঙ্গে। গ্যাসলাইটের টিমটিমে আলোতে রাত ৩টা পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের কাজ করলেন তারা।
টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার চকগগাধর গ্রামে যাতায়াতের জন্য কোনো রাস্তা ছিল না। ক্ষেতের আইল ধরে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ধুনাইল পাকা রাস্তায় উঠে মানুষকে উপজেলায় যাতায়াত করতে হতো। বর্ষাকালে অবস্থা হতো অবর্ণনীয়। কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হতো। ভুক্তভোগী গ্রামবাসী সবাই হলেও সোইনুদ্দিন ভাবলেন, কেউ সঙ্গে আসুক আর না-ই আসুক রাস্তা তৈরি করতেই হবে। সেই ভাবনা থেকে ৫ বছর আগে একাই নেমে পড়েন রাস্তা নির্মাণে। শুরুতে গ্রামবাসী তাকে “পাগল” বলেছেন, কেউ কেউ বাধা দিয়েছেন। দমে যাননি তিনি। স্ত্রী’র অসামান্য সমর্থন আর সহায়তা, ভাইদের সহযোগিতায় একদিন গ্রামের বুক চিরে দেখা দিলো রাস্তা। সোইনুদ্দীনের মাটির রাস্তা!
লাকি বলেন, গ্রামে কত পরিবার, কত মানুষ। অথচ তারা কেউ এগিয়ে আসেননি। উল্টো কেউ কেউ বাধা দিয়েছেন, জমি দিতে চাননি, মাটি কাটতে না করেছেন। অনেক বুঝিয়ে এমনকি কারও কারও পায়ে ধরে রাজি করানো হয়েছে।
প্রথমদিকে সোইনুদ্দিন একাই কাজ করলেও পরে তার পাঁচ সহোদর হাত লাগিয়েছেন রাস্তার কাজে। সৌদি প্রবাসী এক ভাই অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। অন্যরা সাধ্যমতো অর্থ ও শ্রম দিয়ে গেছেন।
সংসার ফেলে স্বামীর এমন কাজে মোটেই অখুশি নন লাকি বেগম। তার ভাষায়, “তাকে কেউ কেউ পাগলও বলেছে। আমি কিছুই মনে করিনি। আমিও তার সঙ্গে কাজে গিয়েছি। সাতদিনের মধ্যে পাঁচদিন রাস্তার কাজ করেছি আমরা। কষ্টকে কষ্ট মনে করিনি। তিনি তো খারাপ কিছু করেননি। এখন গ্রামের মানুষের কতো আরাম হয়েছে। তাদের খুশিতে আমিও খুশি।”
সোইনুদ্দিন বলেন, রাস্তা না থাকায় গ্রামের মানুষের কষ্ট দেখে রাস্তা বানানোর চিন্তা করলাম। প্রথম প্রথম কেউ সাহায্য করলো না। অনেকেই বাধা দিয়েছে। কারো কথা শুনিনি। ৫ বছর আগে ধুনাইল পাকা রাস্তা থেকে ডান দিকে গ্রামের ভেতরে রাস্তার কাজ শুরু করি। কিছুদূর এগোনোর পর জমির মালিকরা বাধা দেয়। অনেক চেষ্টা করেও তাগো রাজি করাতে পারিনি। পরে অন্য জায়গা দিয়ে ঘুরিয়ে আবার কাজ শুরু করি। সেখানেও একজন বাধা দেয়। একদিন তার পা ধরে বসে পড়ি। শেষে তিনি শর্তসাপেক্ষে রাজি হন। রাস্তার কাজ এগিয়ে তার জমির কাছে এলে তিনি আবার বাধ সাধেন। তখন তাকে বলি, রাস্তা করতে না দিলে আপনিও আমাদের জমির ওপর দিয়ে হাঁটতে পারবেন না। এভাবে দেড় কিলোমিটার রাস্তা বানিয়েছি আমরা। কিছুদিন আগে কাজ শেষ হয়েছে। অনেক জায়গাতে ঘাস গজিয়েছে। কোথাও কোথাও আবার পায়ের চাপে গর্তের মতো হয়েছে।
দীর্ঘ ৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরে রাস্তা নির্মিত হলেও সোইনুদ্দিন মনে করেন, মাটির রাস্তা এভাবে বেশিদিন টিকবে না। রক্ত জল করা রাস্তাটি নিয়ে তার শঙ্কা, খুব কষ্ট করে রাস্তা বানিয়েছি। এখন এটা পাকা হওয়া দরকার। যা আমাদের সাধ্যের বাইরে।
“সরকার তো কতো রাস্তাঘাট করে। এই রাস্তাটাও যদি পাকা করে দিতো…”
একই অভিমত লাকি বেগমেরও।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে অবশ্য নামেমাত্র সহায়তা করেছে এই রাস্তার কাজে।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, কৃষক সোইনউদ্দিন একটি অনন্য কাজ করেছেন। দেরিতে হলেও আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কিছু শ্রমিক দিয়ে এই কাজে কিছুটা সহায়তা করেছি। রাস্তাটি সংরক্ষণের বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলা হবে।
{{ কিছু অংশবাদে বাকি সবটুকুই অংশ ঢাকা ট্রিবিউন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। }}