যুদ্ধের ও অনেক আগের ঘটনা এটি। আগেকার সময় যানবাহনের জন্য মোটর চালিত যান খুব কমই ছিল আমাদের দেশে। কিন্তু যেহেতু আমাদের দেশ একটি নদীমাতৃক দেশ তাই নদী-নালা,খাল-বিল এর কোন কমতি নেই এই দেশে। পূর্বে যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পথ ছিল জলপথ।
মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াত সহ বিভিন্ন প্রকার কাজে এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য জলপথের ওপর নির্ভরশীল ছিল। যাই হোক তখন ছিল শুক্রবার। আমাদের দেশে আবার বিবাহ বেশিরভাগ সময়ই করা হয় শুক্রবারে। এমনই এক বরযাত্রী বিবাহের উদ্দেশ্যে আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে চলা খালটি দিয়ে নৌকা নিয়ে রওনা হয়।
তারা বেশ ধনাঢ্য পরিবার ছিল। বেশ জাঁকজমকভাবেই তারা পরিবারবর্গদের কে নিয়ে কনের বাড়িতে যায়। কন এর পরিবার ছিল ভালোই বিত্তশীল। বরের চেয়ে কোনো অংশেই কম নেই তাদের। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে তাদের বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। বরযাত্রী যেসকল নৌকা নিয়ে কনে বাড়িতে গিয়েছিল সেই সকল নৌকা নিয়েই তাদেরকে সেই খাল পথ ধরে ফিরতে হবে। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় অনেক রাত্রি হয়ে গেল।
কণাকে তার পরিবার বিদায় জানালো এবং বরপক্ষ তাদের ঘরের নতুন বউকে নিয়ে রওনা হল বাড়ির উদ্দেশ্যে। বেশ আনন্দ ফুর্তি করতে করতেই তারা তাদের নৌকায় করে ফিরে আসছিল। আমাদের বাড়ি হতে বেশ খানিকটা দূরে ছিল ওই খালটি। রাত বেশি হওয়ার কারণে তেমন একটা কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আর আকাশে তখন চাঁদের আলো তেমন একটা নেই। নৌকায় ব্যবহার করা আলোর মাধ্যমেই তারা এগিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু তাদের সাথে হয়ে যায় তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। কোন এক কারনে বরযাত্রীর সবগুলো নৌকায় পানিতে ডুবে যায়। কিছু লোক সাঁতরে পারে উঠতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে তারা প্রচুর লোকজন ব্যয় করে নৌকার অবশিষ্ট অংশ বা যদি কেউ বেঁচে থাকে তাদেরকে খোঁজার চেষ্টা করে। দুর্ভাগ্যবশত কারো লাশ তো দূরের কথা, নৌকাগুলোর কোন অবশিষ্টাংশ পর্যন্ত তারা খুঁজে পাইনি। খালটি তেমন একটা গভীর ছিল না।
এত চেষ্টা করার পরও তারা কেন কিছু খুঁজে পাইনি এর উত্তর কারো কাছেই ছিল না। দেখতে দেখতে পার হয়ে যায় অনেকগুলো বছর। সময়ের আবর্তনে খালটি শুকিয়ে যায়। তার উপর দিয়েই তৈরি হয় রেললাইন। খালের দুই প্রান্ত কে একত্র করার জন্য তার ওপর তৈরি করা হয় রেল লাইনের একটি লোহার ব্রিজ। তার পাশ দিয়ে চলে যায় একটি পাকা সড়ক।
যেহেতু রেল লাইনটি সড়কের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে তাই সেখানে গাড়ি-ঘোড়া থামানোর জন্য বসানো হয় চেকপোস্ট। আর সেই চেকপোস্ট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অবশ্যই কোন না কোন মানুষকে দরকার। তাই সেখানে মানুষও নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় সেখান থেকেই। সবাই কিছুদিন চাকরি করার পর নানা অজুহাতে চেকপোস্ট থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যেত। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা হলে কেউ কোনো উত্তর দিতে চাইত না। সবাই এই প্রশ্নটা এড়ানোর চেষ্টা করত।
চেকপোষ্টে ছিল ব্রিজ থেকে অনেকটাই কাছে। চেকপোস্টের জানালা দিয়ে ব্রিজটি সরাসরি দেখা যেত। কিন্তু চেকপোস্টের যদি কেউ না থাকে তাহলে ওই রাস্তায় দুর্ঘটনা এড়ানো অনেকটাই মুশকিল হয়ে যাবে। তাই এই ব্যাপারে রেললাইন কর্তৃপক্ষ বেশ খানিকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আগের কর্মচারীদের বেশ ভালোভাবে খোঁজখবর নেওয়া হয়। তাদের ওপর কেউ জোরাজোরি করছিলো কিনা তা জানার জন্য।
অনেক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর একজন উত্তর দেয় যে, সেরকম কোনো সমস্যায় তাদের ছিল না। তাদের সমস্যা হলো ওই লোহার ব্রিজটি। মধ্যরাত হওয়ার পরই তারা ওই ব্রিজের মধ্যে অনেক আজগুবি জিনিস দেখতে পেত। কখনো তারা দেখতো ব্রিজের ওপর থেকে কোন মহিলা সাদা কাপড় পড়ে পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে আবার কখনো দেখতো ব্রিজের উপর দিয়ে একটি দুই পা বিশিষ্ট সাদা ঘোড়া নব বধুর শাড়ি পড়ে ব্রিজের উপর দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। এসব কারণে আমরা সেখানে কাজ করতে চাই না।