“উপস্থিত বুদ্ধি” ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Presence of Mind এটা সকলের মধ্যে সমান ভাবে কাজ করে না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ কোন বিপদে বা সমস্যা মোকাবেলায় এমন সব বুদ্ধি প্রয়োগ করে, যা যে কাউকে হতবাক করে দেয়!
যাই হোক, আমি বলবো না যে, আমার উপস্থিত বুদ্ধির জোর খুব বেশি। তবে, আজকে আমি আমার জীবনের এমন একটি ঘটনার কথা বলবো, যেটি মনে হলে এখনো আমার শরীর হিম হয়ে যায়।
১৯৯০ সালের শেষের দিকের ঘটনা এটি। আমি তখন কবি নজরুল সরকারী কলেজ (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) এর একাদশ শ্রেণির ছাত্র। কলেজে ভর্তির কিছু দিন পরেই আমি বি, এন, সি, সি – এর ক্যাডার নির্বাচিত হয়ে “১নং রমনা রেজিমেন্টের ‘সি’ প্লাটুনে” যোগ দেই। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন আমাদের ক্লাস শুরুর ২ ঘণ্টা আগে কলেজে উপস্থিত হয়ে প্যারেডে অংশ গ্রহণ করতে হতো।
সকলেরই মনে থাকার কথা, ঐ সময় এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলমান ছিল। ঘটনার দিন যথারীতি আমি খুব সকালেই কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হই। এসে দেখি অন্যান্য ক্যাডারদের উপস্থিতি খুব কম। আরোও একটি বিষয় খেয়াল করি, আশেপাশে কেমন যেন একটা জনমানবহীন নীরবতা বিরাজ করছে। বলে রাখা ভাল, আমি থাকতাম খিলগাঁও যার কারনে সদরঘাট এলাকার ঘটনা আমার জানা থাকার কথা না। তখন তো আর মোবাইল কিংবা ফেসবুক ছিল না। আবার বাংলাদেশ বেতার আর বিটিভি ছাড়া অন্য কোন চ্যানেলও ছিল না। তাই তাৎক্ষনিক কোন ঘটনা সম্পর্কে আশে পাশের লোকজন ছাড়া কেউ অবগত হতে পারতো না।
আমি ক্যাম্পাসে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ করেই দুড়ুম দুড়ুম করে ৩/ ৪ টি বিকট আওয়াজ পেলাম। আমি ভয়ে দৌড়ে একটি ক্লাস রুমে ঢুকে পড়লাম। একটু পরেই দেখি আমাদের ইন্সট্রাকটর “সিপাহী আঃ আলিম” সাহেব ঐ রুমে দৌড়ে ঢুকে পড়লেন। আমি একটু সাহস পেয়ে তার কাছে গেলাম। যথারীতি অভিভাদন জানিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম –
ঃ স্যার, ঘটনা কি ঘটেছে কিছু জানেন কি?
ঃ গতকাল সন্ধ্যা থেকে নাকি জগন্নাথ কলেজের দুইটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধেছে। অবস্থা খুব খারাপ। কালকে কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। রাতভর বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। ভোর রাতে পুলিশের কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার কারনে পরিস্থিতি একটু ঠাণ্ডা হলেও আজ সকালে নাকি দুই গ্রুপই শক্তি বাড়িয়ে আবার কলেজ ক্যাম্পাসে মহড়া দিতে শুরু করেছে। আর একটু আগের ককটেল বিস্ফোরণের আওয়াজ তো মনে হয় তুমিও শুনেছ?
ঃ জ্বী স্যার, ভয় পেয়েই তো আমি এই রুমে ঢুকেছি।
আপনারা সকলেই হয়ত অবগত আছেন যে, কবি নজরুল সরকারী কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজ ঢাকার সদরঘাট এলাকায় ভিক্টোরিয়া পার্কের দুই পাশে অবস্থিত দুইটি কলেজ। কাজেই একটিতে কোন ঘটনা ঘটলে তার প্রভাব অন্যটিতেও পরবে এটাই স্বাভাবিক। তাই আমরাও ভয় পাচ্ছিলাম কখন কি হয়। আগে জানলে হয়ত সেদিন কলেজেই যেতাম না।
হঠাৎই ইন্সট্রাক্টর স্যার বললেন –
ঃ তোমাদের উপস্থিতি যদি কম হয় তাহলে আজকের প্যারেড বাতিল করে আমি চলে যাব। আর ১০ মিনিট অপেক্ষা করে দেখি।
কিন্তু বিধি বাম আমার মত সকলেই একে একে ক্যাম্পাসে উপস্থিত। কারন একটাই, ঘটনা তো কেউ আগে জানে নি। সবাই এখানে এসেই শুনছে বা দেখছে।
তাই যথা নিয়মে ইন্সট্রাক্টর সাহেব তার বাঁশি বাজালেন আর আমরা ভয়ে ভয়ে মাঠের উত্তর – পূর্ব কোনায় লাইন দিয়ে দাড়াতে লাগলাম। ইতিমধ্যে জগন্নাথ কলেজের দিক থেকে দুই তিন বার ককটেল বিস্ফোরণের আওয়াজ এলেও আমরা একসাথে অনেকজন থাকার কারনে তেমন ভয় পাচ্ছিলাম না।
যথারীতি আমাদের প্যারেড শুরু হলো। আমরা মনোযোগ সহকারে প্যারেড করছিলাম। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আশেপাশে কিছু ঘটছে। ইন্সট্রাকটর স্যাহেবও দিব্বি আগের মতই ইন্সট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ বাতাসে শিষ কেটে দ্রুত বেগে কিছু একটা এগিয়ে আসার আওয়াজ এবং আমি ভূলুণ্ঠিত।
আগামী পর্বে সমাপ্য ……