বর্তমান বিশ্ব বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। প্রতিটি দেশের নিজস্ব নিয়ম এবং রীতিনীতি রয়েছে যেগুলোর একটি অন্যটি থেকে আলাদা। তবে সমাজ ও রাষ্ট্র যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে তা নিশ্চিত করার একমাত্র মাধ্যম হল নিয়ম ও আইন। যেকোনো দেশ তার নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী আইন তৈরি করতে পারে। তবে কিছু দেশ যখন অদ্ভুত এবং অন্যরকম আইন তৈরি করে তখন তা হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। সেরকম কিছু অদ্ভুত আইন নিয়েই আজকের আয়োজন।
কুকুরের মল পরিষ্কার না করলে ডিএনএ পরীক্ষা, গুনতে হবে জরিমানা।
ইতালির নাপোলির অববাহিকায় প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছোট্ট একটি দ্বীপ কাপরি। দ্বীপ ছোট হলেও এই দ্বীপে রয়েছে একটি বিচিত্র আইন। আপনার কুকুর যদি কাপরির রাস্তায় মলত্যাগ করে তাহলে তা পরিষ্কারের জন্য কোন সিটি কর্পোরেশনের লোক আসবে না। আপনাকেই সেটা রাস্তা থেকে পরিস্কার করতে হবে। ভাবছেন কে দেখছে, ফেলে চলে যাবেন, সেটি হচ্ছে না। প্রয়োজনে মলের ডিএনএ পরীক্ষা করানো হবে। ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে আপনাকে খুঁজে বের করা হবে। আর আপনাকে গুনতে হবে প্রায় দুই হাজার ইউরো বা জরিমানা। টাকার অংকে যা দাঁড়ায় প্রায় দুই লক্ষ ২৬ হাজার টাকা।
সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ চুইংগাম
সিঙ্গাপুরে চুইংগামকে দেখা হয় মাদকের চোখে। চুইংগাম চিবানোর অপরাধে আপনাকে গুনতে হতে পারে এক লক্ষ ডলার বা এক কোটি তিন লাখ টাকা জরিমানা। সাথে হতে পারে দুই বছর পর্যন্ত কারাবাস। ১৯৯২ সাল থেকে দেশটিতে চুইংগামের ব্যবসা, বিক্রি এবং উৎপাদন আইনত অবৈধ। আর এ আইনের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় চুইংগাম চিবানোর মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে। পাশাপাশি চুইংগাম পচে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে সময় নেয় বেশ কয়েকবছর। গাম জাতীয় বর্জ্য পদার্থের উদপাদন কমাতেই এই আইন। এই আইন প্রসঙ্গে দুহাজার সালে দেয়া বিবিসির নেয়া সাক্ষাৎকারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ’কে জানানো হয়, চুইংগাম সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এ শুনে প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ বলেন, চুইংগাম খাওয়া একটি অপরাধ, আর সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য যদি কিছু চিবোতেই হয়, তাহলে সে একটি কলা চিবোলেই পারে। অবশ্য পরে, ২০০০ সালে এই আইনটি কিছুটা শিথিল করা হয়। শুধুমাত্র চিকিৎসা ক্ষেত্রে, চিকিৎসকের পরামর্শপত্রে চুইংগাম ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।
রাতের বেলা শৌচাগারে ফ্ল্যাশ করা শব্দদূষণ
রাতের বেলা প্রায়ই যাদের এক-দুইবার শৌচাগারে যেতে হয় তাদের জন্য দুঃসংবাদ। যদি আপনি সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা হন, তাহলে আপনাকে সেটা চেপেই শুয়ে থাকতে হবে, অথবা ফ্ল্যাশ না করেই চলে আসতে হবে। কারণ সুইজারল্যান্ডের আইনে রাত ১০ টার পর শৌচাগারের ফ্ল্যাশের আওয়াজ শব্দদূষণ বলে গণ্য করা হয়।
আফ্রিকায় চলবে না ক্যামোফ্ল্যাজ নকশার পোশাক
শত্রুর চোখে ধুলো দিতে ক্যামোফ্ল্যাজ বা ছদ্মবেশী পোশাক পড়ে থাকেন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া বর্তমান যুগে ফ্যাশন হিসেবেও অনেকে ক্যামোফ্ল্যাজ নকশা বা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মতো কাপড় পড়ে থাকেন। কিন্তু এই ক্যামোফ্ল্যাজ নকশার কাপড়ই আপনার জন্য বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের কিছু দেশে। সেখানে আপনার এই ফ্যাশন বিবেচিত হতে পারে উর্দি জালিয়াতি হিসেবে। যা সেখানে ভয়ঙ্কর অপরাধসমূহের একটি।
নো সেলফি উইথ বুদ্ধা
শ্রীলঙ্কায় গৌতম বুদ্ধের প্রতিমূর্তির সামনে সেলফি তোলা একটি গুরুতর অপরাধ। আর যদি তুলেও ফেলেন তাহলে সেই ছবি মোবাইল ফোন থেকে মুছে ফেলার জন্য আপনার সঙ্গে জোরজবরদস্তি করা হবে। তারপরেও যদি না হয় তাহলে ডাকা হবে পুলিশ। তবে ছবি তোলা যাবে বুদ্ধের প্রতিমূর্তির পাশে দাড়িয়ে অথবা আপনার আর বুদ্ধের প্রতিমূর্তি মুখোমুখি অবস্থানে। তবে বুদ্ধের প্রতিমূর্তির দিকে পিঠ দিয়ে ছবি তোলা নিষিদ্ধ।
কানাডায় গাছে চড়া নিষেধ
স্কুলের প্রাঙ্গন, উদ্যানসমূহ, এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত কোন স্থান হচ্ছে শিশুদের খেলাধূলা করার উত্তম জায়গা। তবে কানাডার ওশাওয়া শহরের শিশুদের কপাল একটু খারাপই বটে। অবাধে খেলাধূলা চললেও এসকল উদ্যানসমূহের গাছে চড়া নিষেধ। তাদের পৌরসভার একটি উপ-আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, কোন ব্যক্তি পৌরসভার সম্পত্তিতে অবস্থিত গাছ বা গাছের কোন অংশে হস্তক্ষেপ করবেন না, গাছ বা গাছের কোন অংশে কোন জিনিস লাগানো, সংযুক্ত করা অথবা স্থাপন করা নিষেধ, এবং গাছে চড়াও নিষিদ্ধ। দ্য কানাডিয়ান ল ডিসকাশন এই আইনের উৎস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, এই আইনটি বানানো হয়েছে জনগণের হুটহাট স্পাইডারম্যান হতে চাওয়া থামাতে।
দিনে অন্তত তিনবার কুকুরকে হাঁটতে না নিলে গুনতে হবে জরিমানা
ইতালীয়দের কুকুরপ্রীতি একটু বেশিই বলতে হবে। কারণ ইতালির তুরিন শহরের আইনে রয়েছে, নিজের পোষা কুকুরকে দিনে অন্তত তিনবার বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। এর অন্যথা হলেই গুনতে হবে জরিমানা। জরিমানার অংকটাও কম না, ৫০০ ইউরো বা প্রায় ৫৪ হাজার টাকা। প্রাণিপ্রেমী জাতি হিসেবে ইতালির সুনাম রয়েছে। ইতালির বিভিন্ন শহরের রাস্তার কুকুর-বিড়ালগুলো তাদের আইন দ্বারা সুরক্ষিত। তারপরেও, বেশ কিছু প্রাণী অধিকার সংগঠনের মতে, প্রতি বছরের ইতালির রাস্তায় প্রায় এক লক্ষ ৫০ হাজার পোষা কুকুর ও দুই লক্ষ বিড়াল পরিত্যাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
স্ত্রীর জন্মদিন ভুলে গেলে, যেতে হবে জেলে
অনেকে নিজের জন্মদিন ভুলে গেলেও স্ত্রীর জন্মদিন ভোলেন না। সংসারে শান্তি বজায় রাখার জন্য বিশেষ এই দিনটির গুরুত্ব স্বামী সমাজের কাছে অপরিসীম। তাই বেশিরভাগ স্বামীই অন্তত বিবাহবার্ষিকী ও স্ত্রীর জন্মদিন মনে রাখার জোরদার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু ভাবুন তো, জন্মদিন ভুলে যাওয়ার অপরাধে আপনার স্ত্রী আপনাকে জেলে ভরে দিল! অবাক হবেন না, ঠিক এমনটিই ঘটে ওশেনিয়ার সামোয়া শহরে। এই শহরে স্ত্রীর জন্মদিন ভুলে যাওয়া আইনত অপরাধ। এর জন্য আপনাকে যেতে হতে পারে লকআপে। এমনকি পুলিশের জেরার মুখোমুখিও হতে পারেন। তাই এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়িয়ে যেতে স্ত্রীর জন্মদিন মনে রাখুন এবং সুন্দর একটি উপহার দিন।
বৈদ্যুতিক বাতি পরিবর্তন আইনত অপরাধ
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া শহরে আপনি চাইলেই আপনার বাসার নষ্ট হয়ে যাওয়া বাতিটি পরিবর্তন করতে পারবেন না। ভিক্টোরিয়ান আইনে বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়া বৈদ্যুতিক বাতি পরিবর্তন নিষেধ এবং শুধুমাত্র অনুমোদিত বৈদ্যুতিক মিস্ত্রীরাই বৈদ্যুতিক বাতি পরিবর্তন করার অধিকার রাখেন। আর এই আইন না মানলে, গুনতে হতে পারে জরিমানা।
পায়রাদের দেয়া যাবে না খাবার
আবারও প্রাণী সংক্রান্ত আইন, আবারও দেশটির নাম ইতালি। যারা ইতালি ভ্রমণ করেছেন তারা জানেন যে মিলানের ডুওমো এবং সিয়েনা ক্যাথেড্রালের মতোই পর্যটনের প্রধান আকর্ষণ থাকে কবুতর। ঝাঁকে ঝাঁকে এই কবুতর দেখতে পাওয়া যায় ইতালির ভেনিসের সেইন্ট মার্ক স্কয়ারে। এখানকার পায়রাগুলোকে খাবার দিলেই আপনাকে জরিমানা গুনতে হবে ৭০০ ইউরো বা পড়ায় ৭৮ হাজার টাকা। বলা হয়ে থাকে, শুধু পায়রাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, সেইন্ট স্কয়ারে থাকা স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে কবুতরের মল থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই এই আইন।
দেশীয় সঙ্গীতশিল্পীদের গান না বাজালেই দন্ড
কানাডার রেডিওগুলোতে বাজানো গানগুলোকে একটি আইন দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। যদি সেখানে বাজানো গানগুলোর মধ্যে মোট ৩৫ শতাংশ নিজের দেশের সঙ্গীতশিল্পীদের গাওয়া গান না হয়, তাহলে সেই রেডিও স্টেশনকে গুনতে হয় জরিমানা। নিজের দেশের সঙ্গীতকে মূল্যায়ন করার অসাধারণ নজির এই আইন।
কাউকে দেয়া যাবে না নেটফ্লিক্সের পাসওয়ার্ড
যুক্তরাষ্ট্রে টেনেসি অঙ্গরাজ্যে একটি নির্দিষ্ট আইন রয়েছে, যে আইন নিশ্চিত করে যে আপনি নেটফ্লিক্সের পাসওয়ার্ড কারো যাতে কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করতে না পারেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, নেটফ্লিক্স নিজেই একটি অ্যাকাউন্টকে চার জনের সঙ্গে ভাগাভাগি করার অনুমতি দিয়ে থাকে। শুধু নেটফ্লিক্সই নয়, এই আইনের মাধ্যমে বিনোদন জগতের যেকোনো কন্টেন্ট সেবাসমূহের (যেমন কেবল টিভি) পাসওয়ার্ড অন্য কাউকে দেয়া নিষেধ। আর যদি ভুলক্রমেও অন্য কাউকে পাসওয়ার্ড দিয়ে বসেন তাহলে আপনাকে গুনতে হবে আড়াই হাজার ডলার বা প্রায় দুই লাখ ৬৪ হাজার টাকা জরিমানা। অথবা খাটতে হবে এক বছরের জেল। এই আইনটি করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ডিং শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নিয়োগকৃত লবিস্টদের সাহায্যে। এই আইনের আওতায় আপনার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা যেতে পারে যদি আপনি একজন কন্টেন্ট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাসওয়ার্ড বিক্রেতা হন।
দেশের বাইরে ফোন করা যাবে না উত্তর কোরিয়ায়
উত্তর কোরিয়ার নাগরিকরা আন্তর্জাতিক কল করতে পারেন না কারণ সেটি সেখানে অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়। গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৭ সালে একটি কারখানার বেসমেন্টে স্থাপিত ১৩টি ফোনে আন্তর্জাতিক কল করার অভিযোগে উত্তর কোরিয়ার একজন কারখানার মালিককে প্রায় দেড় লক্ষ লোকের সামনে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করার মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।