বাবা-মার চোখে শিশু শ্রমিক
সোনিয়া হোসেন
মাজেদা বেগম প্রায় ৬ মাস থেকে বিছানায় । স্বামী কুলি । সারা দিন-রাত সে স্টেশনেই থাকে । খুব সামান্য আয় । কোন ভাবে দিন চলে যেত । আর মাজেদা বেগম একটা বাড়িতে সারাদিন সমস্ত কাজ করতো । তাদের দুই ছেলে মেয়ে । হালিমা, রহিমা, পরে হারুন, বিলাল । হালিমার বয়স ১৬ , রহিমার বয়স হবে ১৪ বছর ।
পরের দু’জন ১২ আর ১০ । মাজেদা বেগম দুই বাসায় দুই মেয়েকে ছোট থাকতে অল্প বেতনে কাজ করতে দিয়েছিল। ওরা অর্ধেক বেলা কাজ করতো, পরে দুই ভাইকে দেখাশোনাও করতো । দুইভাই স্কুলে ভর্তি হলো । কোন ভাবে ওদের দিন কেটে যাচ্ছে ।
মা হঠাৎ করে অসুস্থ্য হয়ে গেল । জ্বর হয়েছে । আজ ১৫ দিন কিছুতেই ভাল হচ্ছে না । বাবার বয়স হয়ে গেছে । আগের মতো আর আয় নেই । মা পুরো মাসের বেতন পায় না । এর পরের মাসে তাকে মালিক কাজে রাখবে না । অন্য বাসা ঠিক করতে হবে । এসব দুশ্চিন্তায় সে আরও অসুস্থ্য হয়ে পড়ে । দুই মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে । তাদের কিভাবে বিয়ে দিবে । বড় মেয়ে বাইরে যাওয়া আসা করলে ছেলেরা তাদের সাথে দুষ্টুমি করে । এসব চিন্তায় মাজেদা বেগমের শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে গেল । জ্বর সেরে গেছে । সাথে ঠান্ডা এখনও ভাল হয়নি । কোন রকমে এক ডাক্তারের কাছে গেল । উনি তাকে অনেক কিছুউ টেস্ট করতে দিলেন । কাশি এতদিন থাকা ভালো লক্ষণ নয় । কিন্তু টাকার অভাবে তাও করা হলো না ।
দুই মেয়ের বেতন আর বাবার প্রতিদিনের সামান্য আয় দিয়ে ওদের সংসার আর চলে না ।
প্রায় দিনই ওরা এক বেলা না খেয়ে থাকে । এভাবেই দিন চলছিল । হঠাৎ করে একদিন ওর বাবা টেশনে মাথা ঘুড়ে পরে যায় । অনেকে তাঁর বাসা চিনতো । তাকে ধরাধরি করে বাসায় দিয়ে যায় । ডাক্তার নিয়ে আসে । ওর বাবার হাই প্রেসার । সংচালাবার তাগিদে আবার সে কাজে যায় । যা আয় করে সংসারে তাই এনে দেয় । মনে মনে ভাবে যতদিন পারি কাজ করে যাই । কিন্তু কাজ তেমন আর পাওয়া যায় না । কারণ বয়স হয়েছে । অনেকেই মাল নিতে ডাকে না । সে যতই বলুক আমি পারবো স্যার , মানুষ তাঁর মাথায় দিতে সংগকোচ বোধ করে ।
এভাবে সে নিজে বুঝে নেয় তাঁর দিন শেস হয়ে গেছে । আস্তে আস্তে আরও অসুস্থ হয় সে । ডায়বেটিসও ধরা দেয় দেহে । প্রেসার ও ডায়বেটিসের চাপে আর চলতে পারে না ।ঔষুধ খাবারও টাকা থাকে না তাঁর কাছে । ভাবে, জীবনে কি সঞ্চয় করতে পারলো না । দুই ছেলের বোঝার বয়স হয়েছে । সংসারের এমন অবস্থায় ওরা নিজেরাই কাজ করতে চাইলো । স্কুল বাদ দিয়ে দিলো ।
কি কাজ করবে ওরা । বাবা মা বুঝে উঠতে পারে না । আপাতত একজন কুলি । অন্যজন গাড়ির গেরেজে কাজ পেল । আর দুই মেয়ে অর্ধেক বেলা বাসায় কাজ করে । সংসার কোন ভাবে চলছে । দুই ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল ।কিছু করবার নেই বাবার । সারাদিন পর রাতে ১২ বছরের ছেলে কুলির কাজ করে বাসায় আসে । হাতের তালুতে ফোসকা দেখে বাবা চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না । মা চুপ করে বসে থাকে । তাঁর যে কিছুই করবার নেই ।
শরীর আর চলে না । এত রোগা হয়ে গেছে, কোন বাসায় কাজেও নিতে চায়না । দুই ছেলের কষ্ট চোখ বন্ধ করে সহ্য করা ছাড়া কিছু করার নেই মার ।
একদিন বড় ছেলে নিত্যদিনের মত স্টেশনে কাজ করে রাতে বাড়ী ফিরে । কিন্তু এদিন মাল নিয়ে হাটতে যেয়ে স্টেশনে পড়ে গিয়েছিল । পায়ে অসম্ভব ব্যাথা পেয়েছিল । বাবা মাকে সে বলেনি । যদি তারা আর না যেতে দেয় তাহলে কে আয় করবে সংসারে ।
কিন্তু পরে প্রচন্ড ব্যাথায় আর না বলে পারলো না । ছোট ভাই ঔষধ এনে দিল ।
দু’দিন পরে আবার সে স্টেশনে গেল । বাবা খেয়াল করলো ছেলে খোরাতে খোরাতে কাজে যাচ্ছে ।
বাবার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে ।
ভাবছে আমার এই অবুঝ দুটো ছেলে । বয়স আন্দাজ কতো কঠিন কাজ করছে ওরা । রাতে যখন ছোট ছেলে আসে সাড়া গায়ে তাঁর কালি, ধুলো ময়লা থাকে । প্রতিরাতে সে গোসল করে । মাঝে মাঝে বাবাকে লুকিয়ে গোসল করে ফেলে ।
মা বাবা খুটিয়ে খুটিয়ে যখন জিজ্ঞেস করে তুই কি কি করিস গেরেজে সারাদিন ?
সব কিছু শুনলে বাব্বা মা মন খারাপ করবে । তাই সে যতটা অম্ভব লুকিয়ে থাকে তাদের সামনে থেকে ।
মা যখন কুপির আলোতে ঘরের মধ্যে দেখতে পায় তাঁর ছেলের দুটো হাত ফুলে গছে, হাতে ফোসকা পড়ে গেছে, সার্টে কালো তেলের কালচে দাগ, বুঝতে বাকি থাকে না, কি পরিমাণ খাটনি খাটে তাঁর এই দশ বছরের ছেলে ।
মা খোদার কাছে মোনাজাত করে, তুমি ওদের রক্ষা করো খোদা ।
আমার ছেলের মতো আরও লক্ষ লক্ষ শিশুকে এতো কষ্ট থেকে রক্ষা করো তুমি খোদা ।