অনন্তার কেবলই মনে হচ্ছে আজকে খারাপ কিছু একটা ঘটবে৷ তার সাথে খারাপ কি ঘটতে পারে আজকে তা সে ভাবতে লাগলো৷ হঠাৎ করে ও খেয়াল করলো ক্লাসের সবাই দাড়িয়ে আছে৷ কেন দাঁড়িয়ে আছে, তা বুঝে ওঠার আগেই সে দেখতে ফেল ক্লাসে রিতা ম্যাডাম এসেছে এবং তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ এই রিতা ম্যাডামকে সবাই ভয় পায় আবার আড়ালে তারছেড়া ম্যাডাম বলেও ডাকে৷ রিতা ম্যাডাম এর দিকে চোখ পড়তেই অনন্তার বুকে ধ্বক করে উঠলো৷
সে বুঝতে পারছে যে সে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে৷ ক্লাসে ম্যাডাম আসার সাথে সাথে দাড়িয়ে যাওয়া তাদের স্কুলের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ম৷ রিতা ম্যাডাম তার কাছে এগিয়ে আসছে৷ অনন্তার তাড়াতাড়ি দাড়িয়ে যাওয়া উচিৎ অথচ সে দাড়াতে পারছে না, মনে হচ্ছে তার পা দুটো অসার হয়ে যাচ্ছে৷ এমন সময় রিতা ম্যাডাম এসে তার গালে ঠাস করে একটা চড় মারার সাথে সাথে সে ‘না’ বলে চিৎকার করে উঠে পড়লো ৷ বুঝতে পারলো এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল৷ আশ্চর্য স্বপ্ন এত স্পষ্ট হয়? আর স্বপ্নের মধ্যে কি অদ্ভুতভাবেই না পুরো বাস্তবের মতো চিন্তাভাবনা করছিল৷
স্বপ্ন নিয়ে আর বেশি চিন্তাভাবনা না করে সে চটপট বিছানা ছেড়ে উঠে স্কুলের জন্য রেডি হয়ে নিল৷ খাওয়ার সময় এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে ফেল সীমান্ত একটু দূরেই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে৷ এই দৃশ্যটা দেখেই অনন্তার মন খারাপ হয়ে গেল৷ তার ভাই যে দিন দিন এইরকম চেইন স্মোকার হয়ে যাচ্ছে, এটা সে মানতে পারছে না৷ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ‘ভাইয়া’ বলে একটা ডাক দিল৷ সীমান্ত অনন্তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ কিরে, কিছু বলবি?’ অনন্তা ভাই এর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করলো, ‘সকালের নাস্তা খেয়েছিস ভাইয়া?’
সীমান্ত ছোট্ট করে ‘না’ বলে উত্তর দিল৷ এবার অনন্তা চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে ভাই এর কাছে গিয়ে বললো, ‘মা মারা যাওয়ার পর থেকে তুই এমন হয়ে গেলি কেন? কেন পড়ালেখা ছেড়ে দিলি? কেন এভাবে নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছোস? আর অই বস্তির ছেলেদের সাথে মিশে মিশে তো চেইন স্মোকার হয়ে গেছোস৷ আমার কথা একবারও ভাবলি না কেন?’ ‘কারণ মা মারা যাওয়ার পর বাবা অই রাস্তার মহিলাকে বিয়ে করে আনে৷ আর আমাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়৷ এসব তো তুই জানোস, জানোস না? তো তোকে নিয়ে আমি কোথায় যাব, কি করবো বল? সেই জন্যই পড়ালেখা ছেড়ে দেই৷ আর তুই যাদেরকে বস্তির ছেলে বলছোস ওরা হয়তো এই সমাজের মুখোশধারী ভদ্রলোকদের মতো নয়, তবে ওরাই আমার কাছে সব৷ কারণ একমাত্র ওরা অনুভব করেছিল আমার কষ্ট।’
অনন্তা আর কিছু বললো না৷ ওকে এখন স্কুলে যাওয়ার জন্য টেম্পুতে উঠতে হবে৷ আজকালকার টেম্পুওয়ালাগুলোও হারে হারামি৷ ৮ টাকার ভাড়া দশ টাকা নেয়৷ ১০ টাকার নোট একবার দিলে আর ২ টাকা ফেরত দিতে চায় না৷ এদিকে অনন্তার কাছে আছে মোটে ৮ টাকা৷ আসার সময় কিভাবে আসবে তা সে জানে না৷ ক্লাসের কারো থেকে ধার করে আনতে হবে৷ ওর কোনো বান্ধবীও নেই৷ ক্লাসে এত গুলো মেয়ের মাঝে থেকেও সে একা, চিরএকা৷ ক্লাসে গিয়ে দেখলো ১০ মিনিট দেরি হয়ে গেছে৷ আর রিতা ম্যাডাম বসে আছে৷ সাথে সাথে সকালের স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল৷ কয়েকবার ঢোক গিলে বলল, ‘ম্যাডাম আসতে পারি?’ ম্যাডাম ওর দিকে তাকালো, তারপর খুবই বিষন্ন গলায় বললো , ‘এসো, আর কখনো দেরি করো না। ‘
অনন্তা ক্লাসে ডুকতে ডুকতে ভাবতে লাগলো আজকে ম্যাডামকে এমন দুঃখিত লাগছে কেন৷ অন্যান্য দিন তো ম্যাডাম এই সময়ের মধ্যে পড়ানো শুরু করে দিত, কিন্তু আজকে এখনো শুরু করেনি যে? পরবর্তী কয়েক মিনিট ক্লাসে একটা অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলে৷ কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম বলা শুরু করলেন, ‘আশা করি তোমরা সবাই ভালো আছো ৷ আজকে তোমাদের সাথে আমার শেষ ক্লাস৷ তোমাদেরকে আজ আমি আমার সকল অন্যায় শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিলাম৷ আমি জানি আমাকে তোমরা অনেক ভয় পাও, আমি তোমাদের উপর হয়তো অনেক অন্যায় করে ফেলেছি৷ তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও, তবে শুধু একটা কথাই মনে রেখো আমি যা করতাম তোমাদের ভালোর জন্যই করতাম৷ এখন ছোট বলে বুঝো না৷ কিন্তু একদিন ঠিকই বুঝবে৷ আমি অবসর নিয়েছি৷ তোমাদের মঙ্গল কামনা করি।’
পুনরায় ক্লাসে নীরবতা নেমে এলো৷ এতদিন ম্যাডামকে খুব ভয়ংকর মানুষ মনে হলেও আজকে হঠাত অনন্তার কাছে মনে হলো ম্যাডাম এর মতো একজন মানুষ কোনোভাবেই নিষ্ঠুর হতে পারে না৷ রিতা ম্যাডাম ক্লাস থেকে চলে যাওয়ার সময় অনন্তা দৌড়ে ম্যাডাম এর কাছে গেল৷ তারপর বলল, ‘ম্যাডাম , আপনি মায়ের মতো৷ আমার তো মা নেই, আজ অনেক বছর পর আপনার মধ্যে আমার মাকে খুঁজে পেলাম৷ দয়া করে দোয়া করবেন আমার জন্য যেন ভালো কিছু করতে পারি জীবনে।’ ম্যাডামের চোখে একফোঁটা পানি চিকচিক করছিল৷ তিনি চোখ মুছে বললেন, ‘অনেক বড় হও মা।’
তারপর তিনি চলে গেলেন৷ অনন্তা ভাবতে লাগলো, মানুষ কত বিচিত্র ধরনের৷ আমরা আসলে সহজে মানুষকে চিনতে পারি না৷ মানুষের বাহিরটা দেখে আমরা বিচার করি অথচ প্রতিটি মানুষের ভিতরে কত অজানা ক্ষত বিরাজ করে৷ এতসব কিছু ভাবতে ভাবতেই অনন্তার মনে পড়লো বাসায় যাওয়ার জন্য ভাড়ার টাকা তো তার কাছে নেই৷ তাই টাকা ধার করতে গেলো সে৷ ক্লাসে যারা একটু আধটু পরিচিত তাদের কাছ থেকে ধার চাইলো অথচ কেউ দিল না৷ সবাই নাই বলে তাড়িয়ে দিল৷ কি অদ্ভুত৷ এখানে অনেকেই আছে কত বড়লোক। অথচ ওদের কাছে বুঝি সামান্য বাড়তি ৮ টাকা নেই!
অনন্তা বুঝতে পারলো তার ভাই আসলে ঠিকই বলেছে৷ এই সমাজে যারা ভদ্রলোক সেজে থাকে তারা প্রকৃত অর্থে মানুষ না৷ যাই হোক কি আর করার আজকে তাকে হেটে হেটে বাসায় যেতে হবে৷ যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে, এটাই সমস্যা৷ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সে চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যেতে থাকে৷ কত সব বিচিত্র মানুষের আনাগোনা এই শহরে৷ কেউ কেউ দামী রেস্তোরাঁয় খেতে যায়, আবার কেউ কেউ পড়ে আছে অনাহারে৷
এইসব কিছু অনন্তার মনকে নাড়া দিতে থাকে, সে ভাবতে থাকে বড় হলে অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করবে৷ এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় এসে পৌঁছায়৷ বাসায় এসে যা দেখলো তাতে তার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা৷ দেখলো ঘরের সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে৷ দেখেই বুঝা যাচ্ছে এখানে হাতাহাতি হয়েছে৷ তাহলে এখন সীমান্ত কোথায়? অনন্তা তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো এখানে কি হয়েছে৷ পরে জানতে পারলো সীমান্তকে র্যাব ধরে নিয়ে গিয়েছে৷ সে ড্রাগ পেডলারদের দলের সাথে থেকে কাজ করতো৷