অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে অত্যন্ত ধনবান এক ব্যক্তি ছিলেন। তার ধনসম্পত্তি, টাকা পয়সা, লোকবল, ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তির কোন কমতি ছিল না। অর্থাৎ তিনি যেমন ছিলেন অর্থসম্পদের মালিক তেমনই ছিলেন ক্ষমতাবান।
একদিন তিনি তার অধীনস্থ লোকদের নিয়ে গাড়ি বহরসহ বেড়াতে বের হন। এক জায়গায় তিনি অত্যন্ত সুন্দরী ও খুবই গরীব ঘরের এক মেয়েকে দেখতে পান। প্রথম দেখাতেই তিনি মেয়েটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং মেয়েটির পরিবারের সাথে গিয়ে কথা বলে তার পিতামাতাকে বেশ কিছু উপহার উপঢৌকন দিয়ে মেয়েটিকে বিবাহ করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। মেয়েটিকে এনে তার জীবন খুব আনন্দে কাটতে লাগলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কিশোরী মেয়েটি কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়লো।
ধনী ব্যক্তিটি দেশের সকল নামকরা ডাক্তার দেখালেন, সবচেয়ে দামি ও উন্নত হাসপাতালে চিকিৎসা দিলেন। বিদেশে নিয়ে গিয়ে উন্নত সব চিকিৎসা করালেন। কিন্তু কোথাও তার শরীরের একটুও উন্নতি ঘটলোনা। তিনি মনে মনে সংকল্প করলেন যে চিকিৎসক ঐ মেয়ের রোগ ভাল করে দিতে পারবে তাকে তিনি সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে দিবেন। দেশ বিদেশের সব ধরণের চিকিৎককে দিয়ে তিনি চিকিৎসা করাতে থাকলেন। অনেকে অর্থের লোভ ছাড়াও মেয়েটিকে সুস্থ করার চেষ্টা করলো। তারা তাদের চিকিৎসা বিদ্যার সব মেধা দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলো। তা সত্ত্বেও তাদের কোনো চেষ্টাই সফল হলো না। মেয়েটি রোগ মুক্ত হতে পারলো না। যত দিন যায় তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে।
একসময় ধনাঢ্য লোকটি সব ডাক্তার এবং চিকিৎসা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন এবং শেষে সৃষ্টিকর্তার শরণাপন্ন হলেন। খালি পায়ে হেঁটে গিয়ে তিনি মসজিদে হাজির হলেন এবং আল্লাহর কাছে কাতর দিলে মোনাজাত করলেন। তার অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো, তিনি মহান আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে লাগলেন, যেন তার স্ত্রীকে সুস্থ করে দেন। এভাবে বেশ কিছু দিন ধরে মোনাজাত করতে থাকেন এবং একদিন রাতে তিনি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমন্ত ব্যক্তিটি স্বপ্নে এক শুভ্র দাড়িওয়ালা অত্যন্ত সুন্দর এক বৃদ্ধকে দেখতে পেলেন।
স্বপ্নে বৃদ্ধলোকটি ধনাঢ্য ব্যক্তিকে বললেন, “হে যুবক! আমি আপনাকে সুসংবাদ দিতে এসেছি, আল্লাহ আপনার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন এবং আপনার স্ত্রী মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠবে। আগামী শুক্রবার আপনার বাড়িতে একজন মেহমান আসবেন, তিনিই সেই চিকিৎসক যিনি আপনার স্ত্রীর চিকিৎসা করবেন এবং যার চিকিৎসার মাধ্যমে আল্লাহ তাকে রোগমুক্তি করবেন। তাঁর প্রতি ভাল আচরণ করবেন এবং তিনি যা বলবেন তা শুনবেন সেই সাথে মানবেনও।”
পরের শুক্রবারে লোকটির স্বপ্ন সত্যি হলো। অনেক দূরের একটি দেশ থেকে অত্যন্ত নামকরা একজন ডাক্তার এদেশে বেড়াতে আসলেন এবং তার বাড়িতে উঠলেন। চিকিৎসক বললেন, “আমি শুনেছি যে আপনার বাড়িতে এক কিশোরী মেয়ে আছে, যে কিনা কোনো এক জটিল রোগে আক্রান্ত। আপনি অনুমতি দিলে অমি তাকে পরীক্ষা করে দেখতে চাই, কারণ তাকে দেখতেই আমি এতদূর পাড়ি দিয়ে এসেছি।”
লোকটি বললেন, “অবশ্যই, অনুমতির প্রয়োজন নেই, আপনি তাকে দেখবেন। আসলে আমি আপনার অপেক্ষাতেই দিন গুজরান করছিলাম, আপনার আগমন আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছে।” সে রাতেই ধনাঢ্য লোকের বাড়িতে আগত মেহমান ডাক্তারের জন্য রাজভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। ভোজে বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকেও ডাকা হয় এবং সকলের সাথেই তিনি ডাক্তারকে পরিচয় করিয়ে দেন। অনুষ্ঠানের শেষে লোকটি ডাক্তারের নিকট তার কিশোরী স্ত্রীর অসুস্থতার যাবতীয় তথ্য বর্ণিত করেন এবং সবশেষে চিকিৎসককে রোগীর ঘরে নিয়ে যান।
ডাক্তার খুব সাবধানতা অবলম্বন করে অত্যন্ত গভীরভাবে মেয়েটিকে পর্যবক্ষেণ করলেন, পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। অতঃপর বললেন, “আসলে সত্য হল যে, ওর শারীরিক কোন সমস্যা নেই। সবটুকুই মানসিক সমস্যার ফল! যা কোনো কারণে বেশি কষ্ট পাওয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছে! কারণটা কী তা আমাকে খতিয়ে দেখতে হবে।” পরের দিন পুরোটা দিন ডাক্তার ঘরেই কাটালেন, কিছু ফাইল ঘাটাঘাটি করলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছু বই ঘাটলেন, খাতায় কী সব আঁকিবুঁকি, লেখালেখি করলেন, এমনকি দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য বারবার ডাকাডাকি করলেও খেতে আসলেন না! বরং ঐদিকে তাঁর মনোযোগ আরও বেড়ে গেল।
এর পরের দিন চিকিৎসক কয়েক ঘণ্টার জন্য মেয়েটির সাথে একা কথা বলতে চাইলেন। তাকে মেয়েটির ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। চিকিৎসক মেয়েটির কাছে গিয়ে আন্তরিকভাবে কুশলাদি জানতে চাইলেন। তারপর ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। আশেপাশে আর কেউ নেই এবং তার বলা কথা কেউ জানবে না বলে তাকে আশ্বস্ত করলেন। মেয়েটির সাথে অত্যন্ত নম্রতার সাথে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। রোগীর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নাড়ী পরীক্ষা করতে করতে বললেন, “এবার তুমি নির্ভয়ে আমাকে বল যে, তোমার নিজ বাড়ি কোথায়? তোমার শহর, তোমার এলাকা, তোমার জন্মস্থান কোথায়? আর তোমার বন্ধু বান্ধবই বা কারা?
মেয়েটি তাকে সব বলল। তার বন্ধু বান্ধবের কথা বলল। পিতা মাতার কথাও বলল। এমনকি এখানে আসার আগে সে অন্য আরও অনেক জায়গায় অনেক বাড়িতে কাজ করেছে এবং অনেকখানে ভাল থেকেছে আবার অনেক জায়গায় নির্যাতিত হয়েছে। এর মাঝে চিকিৎসক সর্বক্ষণই সতর্কভাবে তার নাড়ীর স্পন্দন খেয়াল করছিলেন যে, কখন নাড়ীর স্পন্দন বেড়ে যায়। মেয়েটি এই শহরে আসার পূর্ব পর্যন্ত যত শহরে কাজ করেছে, একের পর এক সব শহরের নাম বলে যায়। এর মধ্যে যে মুহূর্তে সে এক সুদর্শন তরুণের কথা বলে, যাকে সে হারিয়ে ফেলেছে, সেই মুহূর্তে তার নাড়ীর স্পন্দন উঠানামা করতে থাকে এবং বিমর্ষ চেহারা আরও বিমর্ষ হয়ে পড়ে।
এ থেকে ঐ চিকিৎসক মেয়েটির মনের সবচেয়ে বড় রোগের উৎপত্তিস্থল কোথা থেকে হয়েছে আন্দাজ করে নেন এবং তার মনের আবেগ চেপে রাখতে রাখতেই যে রোগটি বিস্তীর্ণতা লাভ করেছে সে উৎস আবিষ্কৃত করেন। চিকিৎসক মেয়েটিকে মা বলে সম্বোধন করেন এবং বলেন যে, ঐ সুদর্শন তরুণ ছেলেটি কোথায় থাকে, তার পরিচয় কি তাকে যেন নির্ভয়ে বলে। তিনি আরও বলেন যে, ছেলেটিকে খুঁজে বের করতে পারলে তিনি তাকে ঐ ছেলেটির সাথে মিলিয়ে দিয়ে তার জীবন রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন।
মেয়েটি তখন ঐ সুদর্শন তরুণ কোথায় থাকে সব বিস্তারিত ডাক্তারকে বলল। চিকিৎসক রোগ নির্ণয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে গেলেন এবং মেয়েটির অন্তরে লুকিয়ে থাকা কষ্টের কথা লোকটিকে জানান। তিনি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেন, “আপনার স্ত্রীকে সুস্থ করে তোলার জন্য তার কথিত ঐ তরুণকে এখানে আনা অত্যন্ত প্রয়োজন। যেভাবেই হোক আপনি তাকে এখানে আনার ব্যবস্থা করুন।” চিকিৎসকের পরামর্শমতো লোকটি তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান দুজন ব্যক্তিকে ঐ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন, যেন কৌশলে ছেলেটিকে তারা এখানে নিয়ে আসে। ঐ দুটি লোক ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন এবং তারা যেকোনো লোকের বর্ণনা শুনে যে কাউকে খুব দ্রুত চিনতে পারতো।
তারা খুব দ্রুতই সেই তরুণকে দেখে চিনতে পারে, যার মোহনীয় চেহারা দেখে তারা অবাক হয়ে যায়। ঐ তরুণকে খোঁজার জন্য যখন তারা আশেপাশে খোঁজ করছিল তখন তারা জানতে পেরেছে সে এই শহরের একজন স্বর্ণকার। তাই তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সহিত তাদের কাঙ্ক্ষিত ঐ সুদর্শন তরুণের কাছে গিয়ে বলল, আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি তোমার জন্য একটা সুখবর নিয়ে। আমরা শুনেছি স্বর্ণালঙ্কার তৈরিতে তোমার দক্ষতা অনেক বেশি। তুমি নাকি ভারী সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত স্বর্ণালঙ্কার বানাতে পারো। এজন্য আমাদের আমীর তোমাকে আমাদের শহরে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি তোমাকে দিয়ে অনেক স্বর্ণের কাজ করাতে চান। এর জন্য তুমি বিপুল পরিমাণে অর্থ পাবে। অতঃপর ঐ দুই ব্যক্তি সুদর্শন তরুণটিকে কিছু দামি দামি উপহার সামগ্রী প্রদান করল এবং সেই সাথে কিছু ভাল অঙ্কের টাকাও দিল। তারপর তারা তাকে ভাল কাপড়চোপড় পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে নিজেদের শহরে নিয়ে আসতে চাইলো।
তরুণ ছেলেটি অত্যন্ত সুদর্শন হলেও সে ছিল ভীষণ অর্থলোভী। সে আমন্ত্রণ পেয়ে নিজ শহর ছেড়ে নতুন শহরে যাওয়ার জন্য সাথে সাথে তৈরি হয়ে গেল। স্বর্ণকার তরুণ ছেলেটি পৌঁছানোর সাথে সাথে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও চিকিৎসক তাকে অভিবাদন জানালেন এবং ধনী লোকটি তাকে অনেক টাকা পয়সা দিলেন।
কিছুদিন পর চিকিৎসক ধনী ব্যক্তিটিকে পরামর্শ দিলেন মেয়েটিকে ঐ স্বর্ণকার ছেলের সাথে বিয়ে দিলে আশা করা যায় সে সুস্থ হয়ে যাবে। একথা শুনে লোকটি অনেক কষ্ট পেলেন। কিন্তু তবুও তিনি চান সে যেন সুস্থ হয়। তাই তিনি মেয়েটির ভালবাসায় কাতর হয়েও ঐ ছেলের সাথে মেয়েটির বিয়ে দেয়ার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু তার আগে মেয়েটিকে তাঁর বন্ধন থেকে আলাদা করে দিতে হবে! তিনি তাই করলেন, মেয়েটি শুধু তাঁর বন্ধন থেকেই আলাদা হলনা, সাথে তাঁর(লোকটির) হৃদয় মন সব আলাদা করে নিয়ে গেল।
কয়েকদিন পর ছেলেটির সাথে মেয়েটির বিবাহ দিয়ে দিলেন। তরুণ দম্পতির সুখে শান্তিতে দিন কাটতে লাগলো। দুজনেই দুজনকে পেয়ে খুশী। ছয় মাসেই মেয়েটির অসুস্থতা দূরীভূত হয়ে পুরুপুরি সুস্থ হয়ে উঠলো। মন প্রফুল্ল হল। হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পেয়ে আবার আগের মতো সুন্দর হয়ে উঠলো। কিন্তু তার এই ভাগ্য বেশিদিন টিকলো না। ছেলেটি প্রচুর পরিমাণ অর্থসম্পদ পেয়ে আচার আচরণ বিগড়ে গেল। সে নেশা করা শুরু করলো এবং একসময় নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লো। তাতে তার চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হতে লাগলো এবং শরীরের শক্তিও কমতে লাগলো। সে সব ধরণের কাজ কর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। তার সম্মান মর্যাদা হারিয়ে যেতে লাগলো।
সব মিলিয়ে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল যে, মেয়েটির প্রতিও তার আর কোন আগ্রহ রইলো না। দিন যায়, মাস যায়, মেয়েটি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে তার স্বামী আবার ঠিক হয়ে যাবে। সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার স্বামীর অবস্থার শুধু অবনতিই হয়। চেহারা আরও বিকৃত হয়ে যায়। পূর্বের সুদর্শন তরুণের চেহারার সাথে এখনকার চেহারার কোনো মিলই আর থাকে না। কিশোরী মেয়ে বাধ্য হয়ে একদিন তাকে ত্যাগ করে। তরুণটিও চলে যায় সে শহর ছেড়ে।
জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ দুর্ঘটনায় মেয়েটির চোখে শুধু একটা সত্যই বারবার ধরা দেয়, বারবার প্রমাণ পায়, “সুন্দর চেহারা মানুষের আসল সৌন্দর্য নয়, চরিত্রের দিকে যে উন্নত সেই সত্যিকারের সুন্দর”, “সুন্দর চেহারার প্রতি ভালবাসা হঠাৎ নিভে যেতে পারে, সেটা কখনো সত্যিকারের ভালবাসা হয় না”।
সে তখনই প্রকৃত ভালবাসার সঠিক ধারণা পেল, যখন সে তার ভালবাসাকে অবহেলায় অযত্নে হারিয়ে বিনষ্ট করে ফেলেছে। সে মরিচিকা দেখে বুঝেছিল জল পেয়ে গেছে। কিন্তু জলকেই হাতে পেয়ে মরিচীকা ভেবে ফেলে এসেছে।