অবস্থান
বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানাধীন রায়নগর ইউনিয়নের মহাস্থান গ্রামের (২৫০৫০০’ উঃ অঃ এবং ৮৯০৫০০ পুঃ দ্রাঃ) অবস্থান । রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে এর দূরত্ব সড়ক পথে ২৩৪ কিলোমিটার(রেখচিত্র-১) । এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও হিন্দুদের নিকট এ স্থান আজও অত্যন্ত পবিত্র ধর্মকেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে । প্রতি ‘বার’ বছর পর পর এখানে একবার এক মাসব্যাপী ‘নারায়ণ যোগ’ নামে একটি হিন্দু ধর্মীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় । এছাড়া প্রতি চৈত্র সংক্রান্তিতে এ স্থানে তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি মেলা বসে । এতে দেশ বিদেশের বহু দূরাগত মানুষের সমাগম ঘটে । সম্ভবত এত বড় মেলা এতদঞ্চলের আর কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না । সবচেয়ে বড় কথা হল প্রায় সাড়া বছর ধরেই এ প্রত্নস্থলে অবস্থিত হযরত শাহ সুলতান বলখি মাহীসওয়ারের দরগাহটি নানা ধর্মের নানা মানুষের সমাগমে জরাকীর্ণ থাকে । তাছাড়া আজ অবধি বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে অবস্থিত প্রত্নস্থলগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচীন । এর সময়কাল আনুমানিক খ্রীঃপূঃ চার শতকে পিছিয়ে নেয়া যায় । এর ধ্বংসাবশেষগুলো বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন শহর ও প্রশাসনিক কেন্দের ‘পুন্ড্রনগরের’ স্মৃতি বহন করেছে । এর কোন কোন স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম ঘর্মকেন্দ্র হিসাবে গণ্য হওয়ার যোগ্য । সুতরাং মহাস্থানগড় আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ ।
পরিচয় ও নামকরণ
খ্রীষ্টীয় বার-তের শতকের দিকে রচিত ‘করতোয়া মাহাত্ন্য’ নামের একটি সংস্কৃত পুস্তিকায় সর্বপ্রথম মহাস্থানের অবস্থান-বিবরণসহ পুন্ড্রক্ষেত্র (পুন্ড্রদের স্থান)নামের উল্লেখ দেখা যায় । অন্যদিকে ১৯৩১ সালে গড়ের উত্তর –পূর্ব ভাগের একটি অংশে মাটি খোড়ার সময় একজন কৃষক একটি ছোট চুনা পাথরের পট্রের সন্ধান পেয়েছিলেন । এ পট্রে উত্তর ভারতীয় ব্রাক্ষী রীতিবৈশিষ্ট্যে (Style) পুন্ড্রনগলেত (পুন্ড্রনগর) নাম খোদিত ছিল । বৈদিক, পৌরাণিক ও মহাকাব্য সাহিত্যে পুন্ড্র নামে একটি জাতি, একটি প্রজাতির ইক্ষু ও পান্ড্রু রোগের উল্লেখ আছে । এছাড়াও গুপ্ত, পাল ও সেনদের বহু তাম্রফলকে পুন্ড্রবর্ধনের উল্লেখ রয়েছে । এসব তথ্যের উপর নির্ভর করে ধরে নেয়া যায় যে, পুন্ড্র পদটি একটি জাতি বা প্রজাতির ইক্ষু অথবা পান্ড্রু নামে রোগের শহর বা নগর নির্দেশ করে । তবে মহাস্থানগড় নামটির উৎপত্তি নিয়ে একাধিক মতামত প্রচলিত আছে । এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে, করতোয়া মাহাত্ম্যের বর্ণনায় এ নগরকে বিষ্ণুর আবাস্থল এবং পবিত্র নগরী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । এই সূত্রেই মহাস্থান নামের প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ।
মহাস্থান মানের শব্দগত অর্থ ‘তাৎপর্যময় স্থান’ । তাই ধরে নেয়া যায় যে, হিন্দু-বৌদ্ধ আমল থেকেই একটি প্রাচীন ধর্মীয় পীঠ্যস্থান হিসাবে পরিচিতির ফলে এ স্থানটি মহাস্থান নাম অর্জন করতে শুরু করে । দ্বিতীয় দফায় এ নামের উল্লেখ দেখা যায় ১৬৮৫ ধ্রীষ্টাব্দের একটি সনদে । দ্বিতীয়ত, কোন কোন পন্ডিতের অভিমত অনযায়ী মহাস্থানগড় শব্দটি ‘মস্তানগড়’ নাম থেকে জন্ম নিয়েছে । মস্তান শব্দটি ইসলামী পরিভাষা থেকে উদ্ভূত । এর অর্থ দাঁড়ায় প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব । ফলে মস্তান এবং মহস্থান শব্দদ্বয় প্রাই-ইসলামী ও ইসলাম পরবর্তী যুগের পরিভাষিক বিবর্তন ব্যতীত আর কিছু বলে মনে হয় না । এছাড়া আমরা জানি যে, এ স্থানে সুদূর অতীতে একজন প্রখ্যাত সাধক আগমন করেন এবং ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি এখানেই বসবাস করতেন । শুধু তাই নয়, খ্রীষ্টিয় আঠার সতকে মস্তানা শব্দের এ পারস্পরিক সাদৃশ্য থেকে আপাতত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এসব শব্দাবলী সময়ের বিবর্তনে এঁকে অপরের অপভ্রশংশ হিসাবে প্রচলিতহয়েছে । আর এ প্রচলন অবশ্যই এদেশে মুসলিম শাসন প্রতিশঠার পর থেকে শুরু হয়েছে । কিন্তু এসব মতামত অভ্রান্তভাবে মেনে নেয়ার মতো কোন অকাট্য প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি ।
মহাস্থান নামটির সাথে ‘গড়’ শব্দটির সংযুক্তি থেকে এর আরও একটি পরিচয় প্রকাশ পায় । প্রচলিত অর্থে ‘গড়’ বলতে প্রাচীর বা পরিখা ঘেরা এমন সুরক্ষিত স্থান নির্দেশ করে যা প্রাচীন দুর্গ এবং নগরের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য । সুতরাং নামকরণের এ ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে এটুকু নিশ্চিত যে, এ গ্রামে একটি প্রাচীন দুর্গ বা নগরের ধ্বংসাবশেষ ঢাকা পড়ে আছে । কিন্তু এর উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশের ইতিহাস অনেকাংশেই আমাদের নিকট আরও অপরিজ্ঞাত । কারণ এ সংক্রান্ত কোন প্রত্যক্ষ লিখিত নিদর্শনের সন্ধান আজও এ গ্রাম বা অন্য কোন অঞ্চল থেকে পাওয়া যায়নি ।
(গোপাল কৃষ্ণ দাস)