এক গ্রামে ছিল এক কুমোর।
তার নাম কেয়ামত আলি।
তার তিন কুলে কেউ ছিল না।
তবুও নিজের জন্য কিছু তাে করতে হয়। তাই সে চাক ঘুরিয়ে হাঁড়ি, পাতিল, কলসি ইত্যাদি বানাতো আর হাটের দিন বিক্রি করতো। তাতে তার একার সংসার ভালােই চলত।
একদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে হাট থেকে বাড়ি ফিরতে তার রাত হয়ে গেল। সেদিন আবার আকাশে চাঁদ ও ছিলো না। কিয়ামত মিয়া ফেরার পথে পড়েছিল কুকরের পাল্লায়। তাদের তাড়া খেয়ে কোনোরকমে দৌড়ে উঠানে ঢুকলো। উঠানের এক কোণে ছিল ভাঙা হাড়ি-পাতিলের স্তপ। অন্ধকারে কিছু দেখতে না, পেয়ে হােচট খেয়ে পড়ল তার উপর। একদম হাত-পা মেলে পড়ল। কপালে লাগলো হাঁড়ির ভাঙা একটা অংশ। কপাল কেটে গিয়ে একেবারে রক্তারক্তি। কোনাে রকমে উঠে ঘরে গেল।
আচমকা চোটটা ভালাই লেগেছিল।
কপালের কাটা কিছুদিনের মধ্যেই শুকিয়ে গেলো। কিন্তু রেখে গেল চিরস্থায়ী গভীর দাগ।
তারপরও দিন কাটছিল ভালােই। কিন্তু হঠাৎ দেশে এলো দুর্ভিক্ষ।
খেতে না পেয়ে লোক মরতে লাগল। অনেকে দেশ ছেড় বিদেশে পাড়ি জমালো।
একদিন কেয়ামত আলিও তার গ্রামের এক দল লোকের সঙ্গে চলে এলো অচেনা এক দেশে। এখানে দুর্ভিক্ষ নেই। সুখী লোকজন। সাজানো গোছানো ঘরবাড়ি।
সে ভাবলো দেশ ছেড়ে যখন চলেই এসেছি তাহলে এখানেই থাকবো। কাজকর্ম কিছু একটা পাওয়া যাবেই। ছেট খাটো একটা কাজের আশায় একদিন সে রাজার কাছে উপাস্থিত হলো। রাজা তখন তার দরবারে বসেছেন । তার দুই পাশে নির্দিষ্ট আসনে বসেছে দুই রাজপুত্র। মুলতো তারাও রাজকাজ শিখছে। তবে সেদিন রাজার মন মোটেও ভালো ছিল না, তাই মুখ ভার।
কয়েকদিন আগেই তার ছোট সেনাপতি মারা গেছে।
যাইহোক, তারপর তিনি কেয়ামত আলির সব কথা শুনলেন।
কেয়ামত আলির শরীর ছিল যেমন তাগড়া, তেমনি লম্বা, তার উপর চেহারা ছিল খুব সুন্দর।
তবে পথের ধুলোেয় ও ক্লান্তিতে শরীর ছিল একটু মলিন। সামনে গিয়ে দাড়াতেই রাজার প্রথমেই নজর পড়ল কেয়ামত আলির কপালের গভীর দাগটার উপর। তিনি ভাবলেন, এরকম শক্তপোক্ত লােক দেখছি, তার উপর কপালে সামনাসামনি
লড়াইয়ের গভীর দাগ । এ লােক নির্ঘাত কোনো বীরপুরুষ। চেহারা দখেই বোঝা যায় এর বংশ ও জাতের পরিচয়। নিশ্চয়ই ছযবেশী কোনা রাজপুত্র হবে।
এই ভেবে তিনি কেয়ামত আলিকে ডেকে বললেন, তােমার উপয়ুক্ত কাজই তুমি পাবে। আজ থেকে তুমি আমার ছোট সেনাপতি।
কেয়ামত আলি অবাক হয়ে রাজার দিকে তাকিয়ে বললো, প্রভুর আদেশ, মহারাজ।
অচেনা-অজানা একজনকে সেনাপতির পদে বহাল হতে দেখে বৃদ্ধ মন্ত্রী যথেষ্ট ক্ষুদ্ধ।
রাজসভার সকলেই অবাক। কিন্তু রাজার মুখের উপর তাে আর কিছু বলা চলে না।
ছিল হাঁড়িপাতিল গড়ার কুমোর, অন্য দেশে এসে হয়ে গেল একেবারে সেনাপতি।
ছোট সেনাপতি কী কম কথা!
এখন তার আর কোনো অভাব নেই। অর্থ-সম্পদ, প্রতিপত্তি, সাজানোে বাড়ি সব পেল। সব সময় বাড়ি ভর্তি দাসদাসী। গায়ে জমকালাে পােশাক। মাথায় সেনাপতির পাগড়ি । কোমরে চকচোকে তরবারি ঝুলিয়ে প্রতিদিন রাজসভায় বসে। আবার মাস গেলে মােটা মাইনে তো আছেই।
এমনি সুখের দিনে হঠাৎ একদিন শক্র এসে হানা দিল রাজ্যে। রাজ্য জুড়ে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। অস্তশস্ত্রে শান দিতে লাগল সৈন্যরা। তারপর সবাই প্রস্তুত লড়াইয়ের জন্য।
যুদ্ধের সময় রাজার দরকার গোপন পরামর্শ। তিনি কেয়ামত আলিকে ডাকলেন।
কেয়ামত আলি আসলো।
এলে রাজা বললেন, ওহে রাজপুত্র আমি ভাবছি এই যুদ্ধে তােমাকেই সেনাপতি করে পাঠাব। তা এতোদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। বলাে তা বাপু কোন যুদ্ধে তােমার কপালের ওই দাগটা হয়েছিল?
কেয়ামত আলি তখন হাত জোড় করে বলল, মহারাজ, ওটা কোনো অস্ত্রের দাগ নয় । আমি আসলে এক কুমোর। বাড়ির উঠানের কোনে আনেক হাড়ি পাতিল ভাঙা অবস্থায় জমা পড় ছিল। এক অন্ধকার রাতে বেওয়ারিশ ককুরের তাড়া খেয়ে
ওথানে পড়ে গিয়ে কপালে চোট লাগে। সেই কাটা দগদগে ঘা থেকে শেষে এই দশা হয়েছে।
এসব শুনে রাজা তো পুরাই থ হয়ে গেছে। লজ্জায় তার মাথা হেট। কিন্তু তিনি তাে রাজা। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন আসলে আমার ভুল হয়েছে। প্রথমেই তোমার পরিচয় জানতে চাওয়া আমার উচিৎ ছিলো। তোমার কোনো দোষ নাই। তুমি এখন এসো। আমি যুদ্ধের জন্য অন্য সেনাপতি দেখছি।
তখন কেয়ামত আলি সাহসের সাথে বলল, মহারাজ, আপনি মিছে ভয় পাচ্ছেন। যুদ্ধটা করতে দিন, তখন বুঝবেন আমার হাতের কৌশল ও কায়দা।
রাজা বললেন, তুমি দেখতে ভালো, তােমার শক্তি ও সাহস সবই আছে মানলাম। কিন্তু যে বংশে তুমি জন্মেছ সেই বংশে কেউ কখনো যুদ্ধ করেনি সেনাপতিও হয়নি। তুমি এবারে তােমার পথ দেখে নাও। রাজপুত্ররা তোমার পরিচয় জানতে পারলে তোমাকে মেরেই ফেলবে।
সে দিনই যুধিষ্ঠির সেই দেশ ছেড়ে যে কোথায় পালালো তার আর খোজ পাওয়া যায়নি।
এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ যে কারো ওপরের চাকচিক্য দেখে তার অবস্থা সম্পর্কে ধারনা করা একদমি বোকামী।