গল্পের প্লটের গল্প

চেষ্টা করলে গল্প হয়তো আমি দু-চারটি লিখতে পারতাম, কারণ গল্পের প্লট আমার মাথার মধ্যে অহরহ ঘুরপাক খায়। কিন্তু সেগুলোকে মাথা থেকে খাতায় নামাতে ই যত গন্ডগোল। অনেকে, শুনেছি গল্পের প্লট খুঁজে মরে। আর আমি ‘প্লট’কে কেমন করে ‘গল্প’ করে তুলতে হয় সেই কায়দাটা এখনও রপ্ত করতে পারলাম না। নাহলে, এই দেখুন না, সেদিনের ব্যাপারটাই বলি। লিখতে পারলে চমৎকার একটা গল্প হয়ে যেত।

পাশের বাড়িতে যে ভদ্রলোক থাকেন, রফিক সাহেব, তার কথাই বলছি। তিনি একজন মাঝারী মাপের ব্যবসায়ী। তিনি তার এতদিনকার বিশ্বস্ত কাজের লোকটিকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন, বলতে গেলে বিনা দোষেই। শুধু বিশ্বস্ত বললেই সব বুঝায় না। রফিক সাহেব ছেলেটিকে তার নিজের ভাইয়ের মতই দেখতেন। ছেলেটি ১২ বছর ধরে এ বাড়িতেই ভৃত্য হিসাবে আছে। তিনি তাকে এতই ভাল জানতেন যে নিজেই, ছেলেটিকে বিয়ে করিয়েছেন এবং সস্ত্রীক এই বাড়িতেই তাদের থাকতে দিয়েছেন। তাতে রফিক সাহেবের একটা সুবিধাও হয়েছে, একসাথে দুইজন কাজের লোক পেয়েছেন। একজন বাইরে কাজ করে আর স্ত্রীটি রান্নাঘরে। যাই হোক এই অবস্থায়ও পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। তার বছর চারেকের এক ছেলেও আছে। রফিক সাহেবের ছোট ছেলের বয়সও প্রায় একই রকম। বাচ্চা দুটো সারাদিন একসাথে খেলাধুলা করে বেড়ায়।

একদিন রফিক সাহেবের কোন এক ব্যবসায়ী পার্টি এসেছিল তার বাসায়, হয়তো কোন ব্যবসায়ীক ডিল করতে। তাদের একজন খেলায় মত্ত এই শিশু দুইটির একটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে গাল টিপে দিলো। সেইদিন রফিক সাহেব প্রথম তার স্ত্রীকে বললেন যে, চাকরের ছেলের সাথে মনিবের ছেলের মেলামেশা সবসময় ভালো দেখায় না। -বলতে ভুলে গেছি এ ব্যক্তি চাকরের ছেলেটিকেই আদর করেছিলো। এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমারও ঐ ছেলেটিকেই বেশি ভালো লাগত।

এর কয়েকদিন পর রফিক সাহেবের এক সহকর্মী এসেছিলেন। তিনিও ছেলেটিকেই, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, -বাঃ! চমৎকার ছেলেটিতো আপনার!

বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, শুধুমাত্র এই কারণে রফিক সাহেব নানা প্রকার অসুবিধার দোহাই দিয়ে ছেলেটিকে অন্যত্র চলে যেতে বললেন। তার চেয়েও আশ্চর্য়- এই কাহিনী তিনি নিজেই আমার কাছে বর্ণনা করেছিলেন।

কিংবা ধরুন আলিমের বাবার কথা। ডাক্তার এসে আলিমের মাকে আলিমের বাবার অসুখের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলে গেলেন যে, “ঘরের সবাই একটু সাবধানে থাকবেন, ওনাকে আলাদা প্লেট-গ্লাসে খেতে দিবেন. . . ইত্যাদি।” ডাক্তারের পরামর্শ মতো আলিমের মা পরিবারের সকলের ভালোর জন্য তাই-ই করলেন। কিন্তু আলিমের বাবা এই আলাদা করার ব্যাপারটি টের পেয়ে ভয়ানক চটে গেলেন। রেগে গিয়ে চিৎকার করে আলিমের মাকে বলতে লাগলেন “কেন? আমি কি কুকুর যে, আমি মুখ দিলে সেই গ্লাসে কেউ পানি খেতে পারবে না?” কিংবা আরেকদিন বললেন, “তোমরা কি মনে করেছ আমার যক্ষা হয়েছে? একটু কাশি হয়েছে আর তাতেই এত ভয়, অ্যাঁ? আমাকে তোমরা সবাই এতই ঘৃণা কর?” এর কিছুদিন পর অবস্থা যখন আরও খারাপ হলো, পরীক্ষার পর যখন জানা গেল যে সত্যিই তার যক্ষা হয়েছে, সেদিন তিনি খুব অদ্ভুত এক কান্ড করে বসলেন। সারাদিন বারবার করে জোয়ান ছেলেটির দিকে অদ্ভুতভাবে, কেমন যেন একটা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাতে থাকলেন, আলিমের নাকি মনে হয়েছিল যে, চোখ দিয়ে তার বাপ তার নিখুঁত, নিটোল স্বাস্থবান শরীরটাকে টিপে-টুপে দেখতেছেন। আলিমের প্রচন্ড বিরক্ত বোধ হচ্ছিল। মাকেও আলিম বলতে শুনেছিল, ‘নিজের ছেলের দিকে মানুষ এমন করে তাকায়!?”

<

রাত্রের ব্যাপার আরও বিস্ময়কর। অনেক রাত্রে কিসের যেন শব্দে আলিমের ঘুম ভেঙ্গে গেল। অতি সন্তর্পণে চোখ খুলে আলিম যা দেখল তাতে সে হতচকিত হয়ে গেল। তার বিছানার পাশে যে পানির জগ আর গ্লাস থাকে, আলিমের বাবা সেই গ্লাসে ঢক্‌ ঢক্‌ করে পানি খাচ্ছে- চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি।

এটাকেও সাজিয়ে গুছিয়ে ‘গল্প’ করে তোলা যায়। অবশ্য আলিমের নিজ মুখে শুনেও গল্পে এই ঘটনা লিখতে আমি সাহস পাই না। কারণ অতি জটিল মনস্তত্ত্বের দোহাই দিয়েও অনেকের কাছে এর অস্বাভাবিকত্ব ঘুচাতে পারব না।

অথবা, অত মনস্তত্ত্বেরই বা কি দরকার। আমার নিজস্ব অনুভূতির অভিজ্ঞতা দিয়েও তো ‘গল্প’ হতে পারতো। আমার কৈশোর স্মৃতির ভান্ডার হতেই একটি বলি, যা আমি আজও বহু যত্নে অন্তরের মধ্যে লালন করতেছি এবং যা ক্ষমতাবান দরদী লেখকের হাতে একটি প্রথম শ্রেণীর গল্পে পরিণত হতে পারতো।

সে সময় মাত্র কয়েকদিন আগে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। মনের অবস্থা যে সবসময় কেমন থাকে তা প্রকাশ করে বলতে পারলে তো হতো. . . । যা হোক, কি একটা সামান্য কারণে আমার ছোট ভাইটাকে একটা চড় মেরে ফেললাম। আসলে কারণটা হয়তো এটাই ছিল যে, ‘আমার সেই ভাইটাকে মায়ের মৃত্যুর পর একদিনও বিচলিত হতে দেখি নি, দিনরাত আগের মতোই ঘরময় ছুটাছুটি-খেলাধুলা আর দুষ্টুমি করে বেড়াচ্ছে।’ যাই হোক, চড়টি মারার সঙ্গে সঙ্গে দুম্‌ দুম্‌ করে পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ঠিক তখনই আমার মনে পড়লো যে, মা বেঁচে থাকতে ওকে বকলে বা মারলে ও ঠিক এমনি করেই বের হয়ে গিয়ে মাকে নালিশ করে দিত। ব্যাপারটা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম অবুঝ শিশু অভ্যাস বশতঃ বের হয়ে গেল, কিন্তু মায়ের কথা মনে পড়ে গেলে নিশ্চয় বাইরে বসে কাঁদতে থাকবে। তাই আমিও বাইরে বের হলাম। দেখলাম ও কোথায় যেন যাচ্ছে। হঠাৎ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। পিছনে পিছনে আমিও চললাম অনেকটা ব্যবধান রেখে, যাতে ও টের না পায়। -একেবারে আমাদের বাড়ির পেছনের বাগান পেরিয়ে পারিবারিক গোরস্থান পর্য়ন্ত যেতে হলো। যে ছেলে ভয়ে কখনও বাগানের ধারে কাছে আসতো না সে কিনা একাকি আস্তে আস্তে বাগান পেরিয়ে গিয়ে মায়ের কবরটার পাশে চুপ করে বসে পড়লো। হাঁটুর উপর হাতের কনুইএ ভর দিয়ে গালে হাত দিয়ে কবরটার দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলো। আমি ধীরে ধীরে ওর পিঠের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই উঠে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। -এতক্ষণে ওর চোখে পানি এল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকটা নিঃশ্বব্দে কাঁদতে লাগলো। তখন টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। বললাম- ‘চল’, বাড়ি যাই। . . . আজ আমার সেই ভাইটাও নাই।

কিন্তু পারলাম না। আমার অনুভূতি, আমার অভিজ্ঞতা, আমার চিন্তা-ভাবনা কাগজে-কালিতে ধরে রাখতে পারলাম না।

Related Posts