আমাদের শরীরের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গই শরীরের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে চোখ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন দৃষ্টিহীন মানুষই বোঝেন চোখের আসল মর্ম। চোখ নাই তো আলো নাই, এটা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু জানার পরও অনেকেই কেয়ার করি না। বিষয়টা আসলে কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত তা দৃষ্টিশক্তি কমে গেলেই টের পাওয়া যায়।
এজন্য আজকে আমরা জানবো কিভাবে চোখকে সুস্থ রাখা যায়, দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর জন্য কি কি করা প্রয়োজন, চোখ ভালো রাখতে কি কি খাবার খাওয়া প্রয়োজন, চোখের ব্যায়াম, ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে।
তো চলুন প্রথমে জেনে নিই সাধারণত কি কি কারণে আমাদের চোখে সমস্যা সৃষ্টি হয় বা হতে পারে। চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া ও চোখে চশমা ব্যবহারের অনেক গুলো কারণ থাকতে পারে। যেমনঃ
- অধিক পরিমানে টিভি, ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদির ব্যবহার
- অল্প আলো এবং অত্যধিক বেশি আলোয় পড়াশোনা করা
- অন্ধকারে টিভি, ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদির ব্যবহার
- পরিবেশ দূষণ
- কম ঘুমানো
- চোখে কোনো সমস্যা দেখা দিলেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া চশমা ও ঔষুধ ব্যবহার
- পুষ্টিকর খাবারের অভাব
ইত্যাদি আরো বিভিন্ন কারণেই চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে, আবার অনেক সময় অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
এখন দেখা যাক কি কি উপায় অবলম্বন করলে চোখকে ভালো রাখা সম্ভবঃ
টিভি, ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি ডিভাইসের ব্যাবহার হ্রাস
ইলেক্ট্রনিক এসব ডিভাইস গুলোর অত্যধিক ব্যবহারের ফলে প্রতিনিয়ত অনেক মানুষের চোখের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। আমরা যখন ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি ব্যবহার করি তখন বেশির ভাগ সময়ই চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। যার ফলে চোখে জলীয় পদার্থ কমে গিয়ে চোখ শুখিয়ে যায় এবং চোখে ব্যথা অনুভূত হয়। এজন্য এসব ডিভাইস ব্যবহারের সময় প্রতি এক, দেড় ঘণ্টা অন্তর অন্তর চোখ স্বাভাবিক ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। এতে চোখে জলীয় পদার্থের পরিমাণ ঠিক থাকবে। এবং অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে চোখের পলক ফেলতে থাকুন।
টিভি দেখার সময় যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখুন, কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন। সম্পূর্ণ অন্ধকার কক্ষে টিভি দেখা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন।
অন্ধকারে যতটা সম্ভব ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি কম ব্যবহার করুন। কারণ অন্ধকারে এসব ডিভাইস ব্যবহারের সময় ক্ষতিকর ব্লু লাইট সরাসরি চোখে পড়ে যা চোখের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অন্ধকারে ফোন কম্পিউটার ব্যবহারের সময় আই প্রটেক্টর অ্যাপ বা সফটওয়্যার ব্যবহার করুন। এতে ক্ষতিকর ব্লু লাইট চোখের ক্ষতি করতে পারে না। তার মানে এই না যে আপনি অ্যাপ ইন্সটল করলেই চোখের সমস্যা হবে না। অন্ধকারে ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি ডিভাইস ব্যবহার না করাই সবচেয়ে ভালো আপনার চোখের জন্য। ফোনের জন্য এখান থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করে নিন, এবং কম্পিউটারের জন্য এখান থেকে সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করে নিন।
সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকুন
যতটা সম্ভব সবুজ গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবুজ গাসপালা দেখা চোখের জন্য খুবই উপকারি। এতে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে। আপনি আপনার ফোন, কম্পিউটারে সবুজ প্রকৃতির ওয়ালপেপার দিয়ে রাখতে পারেন ও কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।
অল্প আলো এবং অত্যধিক বেশি আলোয় পড়াশোনা
অল্প আলো এবং অত্যধিক বেশি আলো কোনটিই চোখের জন্য ভালো নয়। এজন্য চোখের জন্য আরামদায়ক স্বাভাবিক আলোয় পড়াশোনা করুন। অল্প আলোয় পড়তে চোখকে বেশি কষ্ট করতে হয় এবং অত্যধিক উজ্জ্বল আলো চোখে জ্বালার সৃষ্টি করে। এজন্য স্বাভাবিক আলোয় পড়ার চেষ্টা করুন।
ঘুমের ঘাটতি
বর্তমান সময়ে কম ঘমানো প্রায় সবার জন্য যেন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। রাতে ঘুমাতে গেলেই প্রথমে ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করা ছাড়া যেন ঘুমই আসে না। অনেকে তো আছে একদম গভির রাতে ঘুমাতে যায়। কিন্তু ঘুম কম হওয়া চোখ ও শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ঘুম কম হলে চোখের নিচে কালো ভাব, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে ভেঙে পরা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য প্রতিদিন সঠিক সময় মত কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম অত্যন্ত জরুরী।
সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি
সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি (Ultraviolet) চোখের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। এজন্য অতি বেগুনি রশ্মি থেকে চোখকে রক্ষা করতে দিনের বেলায় রোদে সানগ্লাস ব্যবহার করুন।
চোখে পানির ঝাপটা
প্রতিদিন স্বাভাবিক ঠাণ্ডা পানি দিয়ে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বার চোখে ঝাপটা দিন। এর ফলে চোখের লুব্রিকেন্ট বা জলীয় পদার্থের পরিমাণ ঠিক থাকবে এবং চোখ পরিস্কার হবে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও মাত্রাতিরিক্ত গরম পানি দিয়ে চোখ ধোয়া থেকে বিরত থাকুন।
চোখে হঠাৎ কিছু পড়লে করণীয়
হঠাৎ করে চোখে ধুলাবালি, পোকা-মাকড় ইত্যাদি পড়লে চোখ কচলানো বা চুলকানো থেকে বিরত থাকুন। তৎক্ষণাৎ কটনবাডস অথবা পরিস্কার তুলা ব্যবহার করে কাউকে দিয়ে পরিস্কার করে নিন এবং তারপর পরিস্কার পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে নিন। চোখে ময়লা পড়ার পর চোখ চুলকালে বা কচলালে চোখের কর্নিয়ায় ঘষা লেগে সমস্যা হতে পারে, এবং পরবর্তীতে বড় ধরণের চোখের সমস্যা হতে পারে।
নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করানো
চোখ অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এজন্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর চোখকে ডাক্তারের কাছ থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিন। বছরে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ বার পরীক্ষা করিয়ে নিন। এতে আপনার হঠাৎ কোনো ছোট খাট সমস্যা হলে সহজেই ঠিক করতে পারবেন। কিন্তু সমস্যাটি ঠিক মতো বোঝার আগেই যদি মারাত্মক হয়ে যায় তাহলে পরবর্তীতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হতে পারে। এজন্য নিয়মিত চোখকে পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এবং অবশ্যই চোখে কোনো সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া চশমা ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
চোখকে ভালো রাখতে ও দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে যেসব খাবার খাওয়া প্রয়োজন
চোখের সুস্থতা ও দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখার জন্য বেশ কিছু ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন। চোখের জন্য ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘ই’, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খুবই উপকারি। খাবারের মধ্যে ফল, সবুজ শাকসবজি, ডিম, লেবু জাতীয় ফল, মাছের তেল, বাদাম, সূর্যমুখীর বীজ, শিম, শুঁটি, কলাই, ভুট্টা, গাজর, টমেটো, রসুন, আখের রস, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই খাবার গুলো চোখের রাতকানা রোগ প্রতিরোধ সহ চোখকে ছানি পরার হাত থেকে রক্ষা, চোখের শক্তি বৃদ্ধি, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করা সহ আরো বিভিন্ন রকমের উপকার করে থাকে।
চোখের ব্যায়াম
চোখকে ভালো রাখার জন্য চোখের ব্যায়াম খুবই কার্যকরী। নিয়মিত কিছু ব্যায়াম করা চোখের জন্য উপকারী।
- চোখকে গোলাকার ভাবে ঘুরানোঃ চোখকে ঘড়ির কাটার দিকে 15 থেকে 20 বার এবং ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে 15 থেকে 20 বার গোলাকার ভাবে ঘোরানো। যতটা সম্ভব বেশি এরিয়া নিয়ে ঘোরাতে চেষ্টা করুন। এভাবে প্রতিদিন করার চেষ্টা করুন। নিচের চিত্রটি লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন।
- চোখকে উপরে নিচে লম্বালম্বি ভাবে এবং ডানে বামে কয়েকবার নড়াচড়া করাতে হবে। এভাবে দিনে বেশ কয়েকবার করতে হবে।
- চোখের পলক ফেলানো বা মিট মিট করা। এটি চোখের জন্য খুবই উপকারী। যেকোনো সময় বেশ কয়েকবার করতে থাকুন। এই ব্যায়ামটি চোখে জলীয় পদার্থের পরিমাণ ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
- হাতের তালু কয়েকবার ঘষে গরম করে ১০ সেকেন্ড দুই চোখের উপর রাখুন। বাইরের আলো যাতে না দেখা যায় সেভাবে চোখে হাত রাখুন। এভাবে দিনে ৫ থেকে ১০ বার করতে থাকুন।
আমরা এতক্ষণ জানলাম কি কি পদ্ধতি অবলম্বন করলে চোখকে ভালো রাখা যায়, চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়ানো যায়। আশা করি আর্টিকেলটি আপনার উপকারে আসবে। আর্টিকেলটি কেমন লাগলো নিচে কমেন্ট করে জানান এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। নিজে জানুন ও অন্যকেও জানতে সাহায্য করুন।