ঘটনাটি যখন ঘটে আমি তখন অনেক ছোট। স্কুলেও পড়তাম না । আমরা তখন যেই বাসাতে থাকতাম, সেই বাসাতে আমাদের সাথে অনেক ইঁদুরেরাও থাকতো। ইঁদুর গুলো দরজার নীচের ফাঁকা জায়গা দিয়ে আসা-যাওয়া করত। তাই আম্মু ঐ ফাঁকা অংশ মাদুর দিয়ে বন্ধ করে রাখতেন।
আমার বড় ভাই আমার থেকে তিন বছরের বড়। তাই সে নিজেকে অত্যন্ত সাহসী দাবি করত, এখন করে না যে তেমনটাও নয় । বিশ বছর বয়স হয়ে গেল আজও তেলাপোকা দেখলে মেয়েদের মতো চিৎকার করতে করতে সবার আগে সেই রুম ত্যাগ করে। ভীষণ সাহসের ব্যাপার বটে!
যেই দিনের ঘটনা, সেইদিন আমাদের বাসায় মেহমান বলতে এক মামাতো ভাই এসেছিল। আমাদের থেকে বয়সে বেশ অনেকটা বড় । সেও অনেক সাহসী, ঠিক আমার ভাইয়ের মতো। সেদিন আমরা বাসায় চারজন ছিলাম। আম্মু, ভাইয়া, মামাতো ভাই আর আমি। আমরা সবাই সন্ধ্যার নাস্তা করতে করতে গল্প করছিলাম, কেবল আমার ভাইয়া ছাড়া। সে হাতে ঝাড়ু আর ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে ইঁদুর শিকারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঐ সময়ে এটা ভাইয়ার রোজকার রুটিন ছিল। যদিও কোনোদিন কোনো ইঁদুর শিকার করতে পারে নি।
আড্ডার এক পর্যায়ে শুনতে পাই, দরজার নীচ থেকে কিছু একটা আটকা পড়ার শব্দ আসছে। যেহেতু আমাদের বাসার বাচ্চা-বাচ্চাদেরও ইঁদুর সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা ছিল, সেহেতু আমাদের কারোরই বুঝতে সমস্যা হলো না যে, এটা আর কেউ নয় বরং আমাদের প্রিয় ইঁদুর মশাই। তিনি দরজার নীচে দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলেন কিন্তু মাদুরে আটকা পড়লেন। সেটা বুঝতে পেরে আমার ভাইয়া আর মামাতো ভাই হাতে ঝাড়ু আর ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে ইঁদুরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথমে মামাতো ভাই গিয়ে হাতের ক্রিকেট ব্যাটটা দিয়ে দরজা থেকে মাদুরটা সরিয়ে ফেলল , যাতে ইঁদুরটি
পালিয়ে যেতে না পারে। এরপর শুরু হলো হত্যাকাণ্ড!
ভাইয়ারা উচ্চস্বরে চিৎকার করতে করতে বীর-বাহাদুরের মতো ইঁদুর টিকে গণধোলাই দিতে লাগল। এতো জোরে তারা একটা ইঁদুরকে ধোলাই দিচ্ছিল যে, শুনে মনে হচ্ছিল যেন আমাদের বাসায় একই সাথে ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, আর বিস্ফোরণ হচ্ছে। নীচতলার আন্টির এ সম্পর্কে কী ধারণা হয়েছে , সেটি আজও একটি রহস্য!
তবে আমি আর আম্মু বিস্ময়ের সাথে দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, বই-পুস্তকে পড়া বীর-বাহাদুরেরা যে এতদিন আমাদের চোখের সামনেই ছিল!
মারামারি শেষ হলে তারা মাদুরটা খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। মাদুরটা খোলার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না, কারণ আমরা আশঙ্কা করছিলাম, আমাদের বীর-বাহাদুরদের হাতে ঝাড়ুর বাড়ি – ব্যাটের বাড়ি খেয়ে ইঁদুর মশাইয়ের লাশটা এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে, সেটা দেখলে হয়তো আমাদের দশ দিনের ঘুম হারাম হয়ে যাবে।
সাহস করে আমাদের মামাতো ভাই তার হাতের ক্রিকেট ব্যাটটা দিয়ে খুব ধীরে ধীরে মাদুরটার ভাঁজ খুলে ফেলল। এরপর যা দেখলাম, তা দেখে আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করলাম। যা দেখলাম তার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না এমন নয়, বরং যা দেখলাম তা দেখব বলে আমরা আশা করি নি। আর সেই মজার ব্যাপার হলো, সেখানে কোনো ইঁদুর মশাই ছিলেনই না! হয় সে দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেই নি অথবা সবার চোখে ধুলো দিয়ে সে আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। ইঁদুর মশাই বটে!
আবারো আমার ভাইয়ের ইঁদুর শিকারের চেষ্টা ব্যর্থ। এই ঘটনা নিয়ে আমরা অতীতেও হাসতাম, বর্তমানেও হাসি আর ভবিষ্যতেও হাসব!
– সমাপ্ত
আমাদের সকলের জীবনেই এমন কিছু ঘটনা থাকে যেগুলো হঠাৎ মনে পড়ে আর মুখে একটা হাসি ফোটায়। এটাও তেমনি একটি ঘটনা।