চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাওয়া ক্রমশই লাগতে শুরু করেছে বাংলাদেশেও। সমগ্র বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপিত হয়েছে মহাকাশে। তাই আজ আমাদের স্বপ্ন আর প্রত্যাশাও বিস্তৃত হয়েছে মহাকাশ অব্দি। ইন্টারনেট অফ থিংস বা আইওটি প্রযুক্তি তাই আজ আমাদের জন্য আর কল্পনা নয়, নয় কেবল সায়েন্স ফিকশন বইয়ের কিছু উদ্ভট কর্মকাণ্ড। বরং সম্ভাবনার নতুন দুয়ারে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। ধারণা করা হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্থনীতি কে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে দেবে এই আইওটি প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার।
আইওটি বা ইন্টারনেট অফ থিংস হল এমন একটি নেটওয়ার্ক যেখানে মানুষের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ছাড়াই কতগুলো কম্পিউটার এবং ডিজিটাল যন্ত্রের মধ্যে ইন্টারনেটের সাহায্যে তথ্যের আদান প্রদান ঘটে এবং সেই প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী যন্ত্র নিজেই পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারে। বলা যায়, একটি যন্ত্র অপর একটি যন্ত্রের সাথে ইন্টারনেটের সাহায্যে যোগাযোগ করে ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে ঘর, অফিস কিংবা কারখানায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সমন্বয় ও যন্ত্রের নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। কি দারুণ, তাইনা? হ্যাঁ, আজ তাই আপনাদের জন্যে নিয়ে এসেছি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমনই পাঁচটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রের খোঁজ ।
১) বিদ্যুৎ সাশ্রয়ঃ সকালে অফিস কিংবা ক্লাস ধরতে সবারই মোটামুটি বেশ কষ্ট হয়। আপনি যত সকালেই ঘুম থেকে ওঠেন না কেন তাড়াহুড়া করে বাইরে যাওয়ার সময় ঘরের ফ্যান কিংবা লাইটের সুইচ বন্ধ করতে আমরা অনেকেই ভুলে যাই। এতে যেমন আপনার বিদ্যুৎ বিল বাড়িয়ে তোলে তেমনি দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ শক্তির অপচয় হয়।
কেমন হয় যদি কোনো সেন্সর ঘরে থাকে যা আপনি ঘর থেকে বের হবার সাথে সাথেই বুঝতে পারে এবং ফ্যান ও লাইটের সুইচে নির্দেশনা দিয়ে দেয় বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য? আবার আপনি অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই আপনাকে লাইটের সুইচ খুঁজে বের করার ঝামেলা না করতে হয়? হ্যাঁ, এটিই আইওটি প্রযুক্তির সুবিধা। আইওটি এর এই কনসেপ্ট ঘরের প্রায় প্রতিটি ডিজিটাল ডিভাইসের সাথে কাজ করে। এমনকি আইওটি ভিত্তিক অটোমেশন সিস্টেম ব্যবহার করে ব্যবহারকারীরা বিশ্বের যে কোনও জায়গা থেকে ঘরের যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
২) ফসল উৎপাদনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতেঃ কৃষি কাজে এ প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে দারুণ সম্ভাবনাময়। ফসলের মাঠের বিভিন্ন তথ্য যেমন তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা, বায়ুচাপ, মাটির আর্দ্রতা অর্থাৎ দৈনন্দিন আবহাওয়ার প্রতিমুহূর্তের অবস্থা ঘরে বসেই শুধুমাত্র মোবাইলের অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে জেনে নিতে পারেন। এজন্য তার প্রয়োজন হবে মাঠে বসানো একটি সেন্সর যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে কৃষকের হাতে থাকা স্মার্টফোনের সাথে। এসকল তথ্য জেনে খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের মাধ্যমে ফসলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। এমনকি এ ধরনের সেন্সর বায়ুর তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, পানি প্রবাহ ও পানির উচ্চতা পরিমাপ করে বন্যার সম্ভাব্য পূর্বাভাস দিতে পারে।
আবার একজন কৃষক যখন ফসলের মাঠের মাটি, পানি ও বায়ুর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত অবগত হবেন তখন কিভাবে এসবের উন্নতি ঘটিয়ে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো যায় সে সম্পর্কেও সচেষ্ট হতে পারবেন। এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি কিংবা বেসরকারি গবেষণার বিস্তৃত মাঠে পোকামাকড় ও রোগবালাই আক্রমণ এর তথ্য মাঠে উপস্থিত না থেকেই তাৎক্ষণিকভাবে জানা যেতে পারে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে ক্ষতির হার কমানো সম্ভব।
৩) দৈনন্দিন চেকআপ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাঃ স্বাস্থ্যই সম্পদ এ প্রবাদটি পড়ে পড়েই আমরা বড় হয়েছি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের কাজের চাপে কয়জন এ বাক্যটি মনে রাখি। নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে সমগ্র শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাও আমাদের পক্ষে যেন দুরূহ ব্যাপার। খুব বেশি অসুবিধায় না পড়লে আমরা ডাক্তারের কাছে যেতেই চাই না।
এ সমস্যার সমাধান করতে পারে আইওটি সুবিধা সম্বলিত নিরীক্ষণ সিস্টেম। একটি যন্ত্র যা আপনার সমস্ত শরীরের সার্বিক তথ্য সংগ্রহ করে এবং সংরক্ষণ করে রাখে যা প্রয়োজনে আপনি আপনার ডাক্তারকে প্রেরণ করতে পারেন তাহলে এর থেকে ভালো কিছু যেন আর হয় না। এছাড়াও প্রতিদিন আপনার রক্তচাপ, রক্তের শর্করার পরিমাণ কিংবা হার্টবিট রেট হয়তো মাপা সম্ভব হয়না। শরীরে যদি একটি সেন্সর থাকে যা কিনা নিত্যদিনকার এসব তথ্য সংগ্রহ করে রাখে এবং আপনি নিজেই তা দেখতে পারেন কিংবা অস্বাভাবিক মনে হলে ডাক্তার কে পাঠাতে পারেন তবে ঘরে বসেই যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে কিংবা পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে আপনার ব্যক্তিগত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। আর এটিই এখন সম্ভব আইওটি প্রযুক্তির কল্যাণে।
৪) নিরাপত্তা সহকারিঃ বর্তমান যুগে নিরাপত্তা আমাদের আর দশটি মৌলিক চাহিদার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা সহ দেশের যে কোনো মফস্বল শহরে যত অপরাধ সংঘটিত হয় তার অধিকাংশই হয় সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাতের মধ্যে।
সুতরাং আইওটি প্রকল্পটি এর এমন একটি সমাধান নিয়ে আসে যেখানে একটি টহল রোবট ও এর সাথে যুক্ত একটি নাইট ভিশন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। এই রোবট একটি পূর্বনির্ধারিত পথ ধরে টহল দেয় এবং উদ্বেগজনক অস্বাভাবিক শব্দ সনাক্ত করে। যদি পাওয়া যায়, তবে ক্যামেরাটি ৩৬০ ডিগ্রি কোণে পুরো এলাকাটি বা ঐ নির্দিষ্ট রাস্তাটি স্ক্যান করে এবং মানুষের মুখ সনাক্ত করার চেষ্টা করে। তারপর রোবটটি এই চিত্রটি কাছাকাছি ব্যবহারকারীর কাছে প্রেরণ করে যিনি এই পুরো আইওটি প্রকল্পটি পরিচালনা করছেন।ব্যবহারকারী রোবট দ্বারা প্রেরণে বিপজ্জনক সংকেত পেয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। সাধারণত শহরের নির্জন রাস্তায় ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ বন্ধ করতে পুলিশ এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের অন্যতম সহায়ক হতে পারে এ ধরনের একটি টহল রোবট।
৫) শিল্প কারখানায় আইওটি প্রযুক্তিঃ উৎপাদন শিল্পে আইওটি এর বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। আইওটি প্রযুক্তি সেই কারখানাগুলোতে লাভজনক যেখানে দ্রুত উৎপাদনের পাশাপাশি পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত। সেন্সরের মাধ্যমে শিল্পকারখানা গুলো তাদের পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং প্রতিটি ধাপে প্রত্যাশিত আউটপুট সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে।ডিজিটাল উপায়ে সংগৃহীত এ তথ্য একজন ম্যানেজারকে সমগ্র সিস্টেমের কার্যকারিতা, দক্ষতা এবং যথার্থতা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম করে।তারা তাদের পণ্যের সম্ভাব্য সমস্যা সনাক্ত করতে পারে যা তাদের পণ্যের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশ শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকের অভাব না থাকলেও দক্ষ জনবলের অভাব অনেক ক্ষেত্রেই প্রকট। সে ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম সংবেদনশীল কাজ করার জন্য এবং উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য অনেক সময় ভারত, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকদের অনেক বেশি টাকা বেতন দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। এর উ্ত্তম বিকল্প হতে পারে আইওটি প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার যেখানে আমাদের দেশীয় শ্রমিক কিংবা ম্যানেজারের কাজকে আরো সঠিকভাবে সম্পাদন করতে দারুন ভাবে সহায়ক হতে পারে আইওটি প্রযুক্তি।