জাপানিদের স্বেচ্ছায় কারাভোগ: কিন্তু কি কারণ লুকিয়ে আছে এর পেছনে?
জাপান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি সুন্দর দেশ। আমরা সবাই জাপানকে ভদ্র মানুষের দেশ হিসেবে জানি। যেখানে কিনা সবাই খুব আন্তরিক ও বন্ধুত্বপরায়ণ। এমনকি জাপান আমাদের বাংলাদেশেরও একটি ভালো বন্ধুরাষ্ট্র। যেখানে কিনা শিশুদের স্কুল জীবন শুরু হয় শিষ্টাচার ও ভদ্রতা শেখার মাধ্যমে। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই ভদ্র জাতির একাংশ ঝুকে পড়েছে অপরাধ জগতে। কিন্তু এই অপরাধ করার কারণটি শুনলে আপনি আরও চমকে উঠবেন। অপরাধে মূল কারণ হলো স্বেচ্ছায় কারাভোগ। আর এই অপরাধ করছে জাপানের সিনিয়র সিটিজেনরা।
বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বসবাস জাপানে। আর আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন যে জাপানিদের গড় আয়ু পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। জাপানে এখন মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ প্রবীণ ব্যক্তির বসবাস। শুধু এটিই নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রবীণ ব্যক্তি জাপানে যারা কিনা কারাগারে রয়েছে। বর্তমানে এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এই দেশটি। এতো বেশি প্রবীণ ব্যক্তিকে কারাগারে স্থান দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো তারা সবাই প্রায় ইচ্ছাকৃতভাবে দণ্ডিত হচ্ছে। একরকম পরিকল্পিতভাবেই তারা নানা রকম ছোট ছোট অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এবং নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে যাচ্ছে কারাগারে।
কিন্ত কেন? কেন একটি দেশের সিনিয়র সিটিজেনরা এমন করছেন?
একটি তথ্যে উঠে এসেছে জাপানে এখন প্রতি কারাগারে প্রতি ৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ১ জন হলো প্রবীণ ব্যক্তি। আর বড়ো কারাগারগুলোতে প্রতি ১০ জনের ৯ জনই সিনিয়র সিটিজেন। জাপানের জাতীয় অর্থনীতিতে এমনি প্রবীণ ব্যক্তিরা একটি বড়ো প্রভাব রাখছে তার উপর প্রবীণ জনগোষ্ঠী নিয়ে তারা আরও একটি সমস্যার সম্মুখীন।
এই সমস্যার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে একাকিত্ব। ১৯৮৫ এর পর থেকে জাপানে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০০ শতাংশ! আর এর অধিকাংশই ছোট ছোট অপরাধের সাথে জড়িত। যেমন চুরি। কারা কর্তৃপক্ষ থেকে জানা গিয়েছে যে, এই প্রবীণ ব্যক্তিদের মাঝে বেশিরভাগই একাকী বসবাস করে এবং তার মধ্যে ৪০ শতাংশ ব্যক্তির আবার পরিবার আছে, কিন্তু তারা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করছে।
প্রবীণ ব্যক্তিদের সম্পর্কে জাপানের এক ওয়ার্ডেন বলেন, ” তাদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, একটি সুন্দর পরিবারও আছে, কিন্তু তাদের সুখ নেই।”
যেহেতু জাপানিরা ভদ্রজাতি তাই তারা প্রবীণ ব্যক্তিদের প্রতি আলাদা যত্ন নিয় থাকে। এবং তাদের সুবিধামতো সব সুযোগ ও পরিচর্যা করা হয়। তাছাড়া এসব বন্দীদের পেছন প্রতি বছর জনপ্রতি ২০,০০০ ডলার খরচ করা হয়। আর প্রবীণদের চিকিৎসা সেবা ও অন্যান্য পরিচর্যা বাবদ আরও বেশি টাকা খরচ হয়। ফলে কারাগারের খরচ মেটাতে বেশ বিপাকে পরেছে জাপান সরকার।
কারাগার এমন একটি যায়গা যেখানে মানুষ বিনা খরচে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু তবুও সবচেয়ে গরিব মানুষটিও কারাগারে যেতে চাইবেনা। কিন্ত জাপানি প্রবীণ এখন প্রতিনিয়ত কারাগারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরছে। এবংকি তাদের মধ্যে বেশিরভাগরই অর্থ সমস্যা নেই। আসলে তারা তাদের একাকিত্ব ঘুচাতেই এ পথ বেছে নিয়েছেন। তারা যে বিষয়টির প্রতি বেশি আকৃষ্ট তা হলো, সঙ্গী লাভের জন্য।
মানুষগুলো যে ইচ্ছাকৃত ভাবেই জেলে যাচ্ছে তার একটি তথ্য প্রকাশ করেছে জাপানি এক সংস্থা। তাদের মতো যেসব প্রবীণ ব্যক্তি জেল খেটেছেন তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ আবার পুনরায় অপরাধ করে জেলে যাচ্ছে। এই ৪০ ভাগের প্রত্যেকই ৬ বার একই অপরাধ করে জেলে গিয়েছেন।
এদিকে পরিসংখ্যান বলছে ২০৬০ সাল নাগাদ দেশে আবার নতুন করে ষাটোর্ধ মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪০ ভাগ। আর বর্তমানে যে হারে কারাগারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে প্রবীণ ব্যক্তিদের তাতে ভবিষ্যতে কারাগারে স্থানসংকুলানই হবে একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু এ সমস্যার জন্য প্রবীণদের কিছুতে দোষী করা যায়না। সমাজবিদরা বলছে, এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বলে দিচ্ছে জাপানের সামাজিক সমস্যাগুলো কোথায়। তাছাড়া তাদের অপরাধ প্রবণতা এখন চক্রাকারে চলছে। যখনই তারা জেল থেকে বেড়িয়ে এসে দেখছেন তাদের কোনো সঙ্গী নেই, পরিবার নেই তারা এক, তখনি তারা নতুন করে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার অনেকের হয়তো থাকার মতো স্থানও নেই তাই তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
এদিকে এই সমস্যাকে একদম ছোট করে দেখছেনা জাপান সরকার। প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমুখী কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। কারাগারের পেছনে এতো অর্থ খরচ করাটা কোনো দেশের জন্যই সুখকর নয়। তাও আবার ইচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য। এর জন্য অবশ্য জাপান সরকার তাদের কম সময় সাজা দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এতে অপরাধ আরও বেড়ে গিয়েছে।
২০১৬ সালেই কেবল চুরি করে কারাগারে যাওয়া ষাটোর্ধ মানুষের সংখ্যা ২৫০০ জন।
এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান হয়ে পারে পারিবারিক বন্ধন দৃড় করা, যৌথ পরিবারে বাস করা। কিন্তু এর মাঝে তিক্ত সত্য হলো যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে ততদিন সমস্যা আরও বেড়েই চলবে। তবে জাপানের ক্ষেত্রে আপাতকালীন সমাধান হলো বৃদ্ধাশ্রম বানানো প্রচুর পরিমাণ। যেখানে তারা তাদের একাকিত্ব ঘুচাতে পারবেন।