জাহাজের দুলুনিটা ক্রমশই কমে আসছে এখন।একরকম থেমেই গেছে বলা চলে।একটা সিগারেট ধরালাম আমি।লক্ষ্য করলাম,একটু আগেই ডেকের যে মানুষগুলো আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ছুটোছুটি করছিল এদিক-ওদিক, এখন তারাই খোশগল্পে নিমজ্জিত পুরোপুরি।তাঁদের মুখ দেখে বোঝায় যায় না একটু আগেই ভীষণ রকমের একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে গেছে এখানে।
আমার হাতে বেশ দামি এবং ব্রাজিলিয়ান কফিতে ঠাসা একটা ফ্ল্যাক্স।যেহেতু জাহাজটা আর কাঁপছে না তাই সেটাকে রাখতে গেলাম ডেকের ফ্লোরে। তখনই চোখে পড়ল ব্যাপারটা।
জনৈক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন আমার দিকে।লোকটার গায়ের রং কালো হলেও কৃষ্ণাঙ্গ নন।অবশ্য শ্যামলা বলা যেতে পারে তাকে।লোকটা ইন্ডিয়ান কি? নাকি বাংলাদেশী?
কিছুক্ষণ আমায় আপাদমস্তক জরিপ করে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি,
– “এক্সকিউজ মি, তুমি কি আমেরিকান?” তাঁর কন্ঠে সংশয়।আমি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়তেই মুখটা আপনা থেকেই বিকৃত হয়ে এলো তাঁর। ঠোট আর জিহ্বার সমন্বয়ে একটা ব্যাঙ্গাত্মক আওয়াজ করলেন অদ্ভুতভাবে। মৃদু কন্ঠে বললেন,
-“আমেরিকাতে আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি এর আগে।কিন্তু সেই ভ্রমণে খুব একটা সুখস্মৃতি তৈরি হয়নি দেশটাকে ঘিরে।বিশেষ করে তোমাদের কফিটা…”কথা থামিয়ে আমার পায়ের কাছে রাখা কফির ফ্লাক্সটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকালেন তিনি।তারপর আবার বললেন,
-“বাই দ্যা ওয়ে, আমি প্রফেসর ইখওয়ানুল ইসলাম।পলিমারে পিএইচডি আছে।আপাতত এই বিশেষ প্রজেক্টের সাথে যুক্ত।তোমাদের বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান ম্যাথুয়েল ম্যাকের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলাম আমি।এখন অবশ্য বুড়ো আমাকে দেখতে পারে না।হিংসে করে।এতো কম বয়সেই ‘দ্যা মাস্টার থটস’ অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছি তো, তাই।“ মানুষটার পরিচয় পাওয়ার পর তাঁর প্রতি একটা অন্ধ সম্ভ্রমবোধ জেগে উঠল আমার।হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়াতে বাড়াতে বললাম,
-”আপনার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম,স্যার।“
– “এ বাবা,পরিচিত হলাম কখন?সবেতো নামটাম বললাম আমার।মানুষের পরিচয় বুঝি তার নামে লেখা থাকে?“ শান্ত অথচ শাণিত কন্ঠে বললেন প্রফেসর।তারপর সরু দৃষ্টিতে অবলোকন করতে চাইলেন আমার মনের অবস্থা।তাঁর কথায় আমি আহত হয়েছি বুঝতে পেরে নরম হয়ে এলো প্রফেসরের কন্ঠ,
-”অবশ্য তোমার সাথে পরিচিত হতে বিশেষ অসুবিধে নেই আমার।কিন্তু সেইজন্য আমাকে যে একটা কথা দিতে হবে, ভাই।“
-“কি কথা,স্যার?”ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-“প্রথমত, এসব স্যার-ট্যার ডাকা চলবে না আমাকে।‘স্যার’ নামটা শুনলেই মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া দশাসই চেহারার জাফর স্যারের কথা মনে পড়ে যায় আমার।ছোট্টবেলায় আমি আবার পড়াশোনার ব্যাপারে তেমন মনোযোগী ছিলাম না।রোজ রোজ টিফিন চুরি করতাম, হোমওয়ার্ক করে আসতাম না ঠিকমতো…। তো একদিন হলো কি, জাফর স্যার ক্লাসে ঢুকেই আমাকে দাঁড় করালেন।সম্ভবত, আমার গত কয়েকদিন একনাগাড়ে টিফিন চুরির বিষয়টা স্যারের নজরে এসেছিল।যাই হোক, আপমাকে দাঁড় করানোর পর কোন রকম ভূমিকা না করেই স্যার সরণ কাকে বলে জিজ্ঞেস করলেন।আমি তো একদম থ।গত একমাস ধরে ফিজিক্স বইটাই খুলিনি।অগত্যা মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।তারপর কি হয়েছিল সেসব কথা বলে আর লাভ নেই।শুধু বলব, শিক্ষক না হয়ে যদি জাফর স্যার বক্সিং প্র্যাক্টিস করতেন তাহলে নি:সন্দেহে বেশ নাম করতেন তিনি।”
কথা থামিয়ে একটা নস্টালজিক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ইখওয়ানুল।তারপর আবার বললেন, “তাই বলছিলাম কি এসব স্যার-ট্যার ডেকে আর কাজ নেই তার চেয়ে তুমি বরং আমাকে নাম ধরেই ডাকো,কেমন?”
আরো পনের মিনিট বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করার পর ইখওয়ানুলের সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হলো।শুরু থেকেই বিজ্ঞানীদের এই হঠাৎ আগমণ আমার কাছে মনে হচ্ছিল।তার উপর পাহাড় আকৃতির ওই বাক্সটা আমার আগ্রহকে কৌতুহলে পরিণত করেছিল।এইবার তাই সুযোগ বুঝে আসল কথাটা জিজ্ঞেস করলাম ইখওয়ানুলকে…
ক্রমশ…