সকাল থেকেই শুরু হয়েছে অঝোরে বৃষ্টি। আবহাওয়া দপ্তর জানালো এটা নাকি নিম্নচাপ। কম করে তিনদিন এভাবেই চলবে। গ্রামবাংলায় শীতের তীব্রতা খানিক বেশিই। তার উপর এই বৃষ্টির বহর একেবারে কাবু করে দিয়েছে ছোট – বড়ো সকলকেই। তাই চা টা কোনো রকমে খেয়ে ছাতা হাতে রওনা দিলেন রোজকার দিনের মতোই বাজারে। বাজার বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক। রিটায়ার্ড মানুষ, কাজ বলতে এখন এটাই।
বাজার ঢোকার আগে দেখলেন এক ফুল বিক্রেতা রং বেরঙের গোলাপ নিয়ে বসেছে। ঝট করে একটা গোলাপ কিনে লুকিয়ে রাখলেন পকেটে। এবার বাজার করার পালা। ছেলেরা কেউই খাবে না জেনেও বাজার থেকে কিনে আনলেন নীলার পছন্দের মৌরোলা মাছ, কচুর লতি, চিংড়ি মাছ। দোকান থেকে কিনলেন রং চঙে একটা গাদোয়াল শাড়ি। আজ যে একটা বিশেষ দিন সেটা ভোলে কি করে…।
বাজারের ব্যাগটা পলিচালিকা ঝিমলির হাতে দিয়েই হাঁক দিলেন গিন্নি নীলাকে। ভালো নাম নীলিমা রায়। বড়ো ছেলেটা হওয়ার পর থেকেই ওই নাম ভুলেছে সকলেই। কেউ বলে যোগেশ এর মা, কেউবা রাকার মা, কেউ বলে অবিনাশ বউ। এখন নতুন একটা নামকরণ হয়েছে রায় গিন্নি। বিয়ের পর এভাবেই হারিয়ে যায় প্রতিটি গৃহবধূর আসল পরিচয়গুলো। তবে অবিনাশ বাবু হারিয়ে যেতে দেয়নি নীলিমা দেবীর নামটি, তাইতো এখনও নীলা বলেই ডাকেন। পাঁচজনে এটাকে আদিখ্যেতা বললেও অবিনাশবাবুর কাছে এটা প্রিয় মানুষটির প্রতি ভালোবাসা।
— নীলা, এই নীলা। বলি, গেলে কোথায় ? শিগগির এসো একটিবার। জরুরী দরকার। দেরি করো না যেন..
— উফ, এমন নীলা নীলা করে বাড়ি মাথায় করছো কেন? তোমাকে কতো বার বলেছি ছেলেদের বিয়ে হয়েছে, আর নাম ধরে ডেকো না। তাছাড়া এই তো চা দিয়ে গেলাম তোমায়, বাজার থেকে আসতে না আসতেই আবার হলোটা কি শুনি …
— দেখো কান্ড! এমন ভাবে বললে, যেনো দরকার ছাড়া তোমার কথা মনেই পড়ে না। সত্যিই, সারাটা জীবন আমার ভালোবাসাটা দেখলে না..
— হয়েছে হয়েছে, কাজের সময় ঝগড়া করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই আমার। এখনও লুচি হয়নি, ছেলেরা কখন খাবে কে জানে! যতো দায় তো সেই আমারই…
— শোনো না আজকে চিংড়ি মাছ দিয়ে একটু কচুর লতি, মৌরলা মাছের ভাপা রান্না করো আমাদের জন্য। অনেক দিন এসব খাওয়ায় হয় না। এখন তো ছেলেদের পছন্দই আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। আর হ্যাঁ তোমার ছেলেদের পছন্দের কচি পাঁঠা এনেছি, নাহলে তো তাদের মুখে রুচবে না..!
হঠাৎ বুড়োর এমন কান্ড দেখে কিছুই বুঝতে পারলো না নীলা দেবী। হলো টা কি আজ! এ বাড়িতে শেষ কবে নিজেদের পছন্দের রান্না হয়েছে, মনেই করতে পারলো না। কথা না বাড়িয়ে বললেন — ঠিক আছে করবো ক্ষন।
কথাটি বলে আবারও রান্না ঘরের দিকে হাঁটা দিলে পিছন থেকে হাতটা ধরে অবিনাশ বাবু বলে ওঠেন
— যাচ্ছো কোথায়? আমি তোমাকে যেতে বলেছি কি!
— আহা, করছো কি? ছাড়ো। মেলা কাজ বাকি…
— আচ্ছা, নিজের দিকে একবারও দেখেছো! চুলগুলো যে পাক রং ধরেছে, সেই দিকে একটুও খেয়াল নেই তোমার। যে দিকটা মনে না করাবো, সেই দিকটাই ভুলে যাও। এইবার নিজের যত্ন নাও, অনেক তো হলো সংসার সংসার খেলা। তোমার এই আত্মত্যাগ এর মূল্য কেউ কি দেবে? ছেলেরাও নয় আর বৌমারাও নয়।
কথাটি শেষ করেই নীলাকে খাটে বসিয়ে দেয় অবিনাশ। দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে আসতেই নীলিমা দেবী বলে ওঠেন
— হচ্ছে টা কি? সাত সকালে এমন দরজা বন্ধ করছো কেন? ছেলে, বৌমা, নাতি, নাতনী চারিদিকে ঘুর ঘুর করছে। সকলে বলবেটা কি…!
— থামো তো, ছেলেরা যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। ওরা যখন কোনো খাবার অর্ডার করে নিজেরা রুমে বসে খায় তখন কি আমাদের কথা ভাবে? নাকি শপিং করতে যাওয়ার সময় আমাদের জন্য মনে করে কিছু কিনে আনে। বুঝতে শেখো নীলা ওরা এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে, নিজেদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আমাদের কথা ভাবার বা আমাদের সাথে কথা বলার ওতো সময় নেই ওদের।
তারপর নীলাকে সামনে বসিয়ে চুলে কালো রং লাগাতে থাকলো অবিনাশ রায়। এক ঢাল চুল নিমেষে কুচ কুচে কালো ভ্রমর হয়ে উঠলো। দেখে বোঝার উপায় নেই মেঘে মেঘে নীলার বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। এখনও সেই অষ্টাদশী যুবতীর মতো এক পিঠ চুল। রূপের ঝলকে যে কাউকে কাবু করতে এখনও সমর্থ। অবিনাশবাবু এখনও সেই আগের মতোই প্রাণোচ্ছল, রোম্যান্টিক। বয়স ৬৫ হলেও রোম্যান্স এ এক চুলও ভাটা পড়েনি। বয়সের স্বভাবে চামড়ায় কুঁচ পড়লেও মনের বয়স একই আছে।
আয়নার সামনে নীলাকে দাঁড় করিয়ে পকেট থেকে লাল গোলাপটা বের করে হাঁটু মুড়ে বলেনন
— I Love you নীলা। কোনো দিন তো এসব বলায় হলো না। সারাটা জীবন সংসার আর সন্তানদের মাঝে আমাদের নিজেদের জীবনটাই হারিয়ে গিয়েছে কখন বুঝতেই পারিনি…
এতো খুশির মাঝেও নীলার চোখে জল। হয়তো এমন জীবন সঙ্গী পাওয়ার ভীষণ গর্বে। কজন মেয়ের ভাগ্যে থাকে এতো সুখ, এতো ভালোবাসা। এ যে প্রতিটি মেয়ের কাছে অহংকার।
চোখের জল মুছে দিয়ে অবিনাশ বাবু বলে ওঠেন
— কৈ আমার উপহার কোথায়? নির্ঘাত ভুলে গিয়েছিলে আজকে দিনটার কথা।
— কিচ্ছুটি ভুলিনি মশায়, আর এতো সহজে কি সব ভোলা যায়। বাবা পণ দিতে পারেনি বলে তোমার বাবা যখন বিয়েতে আপত্তি দিলো তখন সব বাধা ভেঙে, গরীব এর মেয়েকে পরিবারের সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করলে। তোমার বাবা বাড়িতে না ঢোকার হুকুম দিয়ে চলে গেলেন। সেই থেকেই শুরু হলো দুজনার পথ চলা। সেই দিনটা কেউ কি ভুলতে পারে!
পুরনো স্মৃতি ভাবতে ভাবতে আনমনে নীলিমা দেবী আলমারি থেকে হাতে বোনা একটা সাদা সোয়েটার, আর কারুকার্য করা একটা রুমাল বের করে বললেন
— এই নাও, এগুলো তোমার জন্য। নিজের সামর্থ্য মতো যেটুকু পেরেছি…
— কি দারুন। এমন হাতের কাজ দেখে পছন্দ হয়নি বলবে, এমন বোকা কেউ নেই। তবে আমার এসব চাই না। অন্য একটা আবদার আছে। যদি পূরণ করো..
— কি আবদার শুনি ?
— ওহ নীলা, আমাকে আর অভি বলে ডাক না কেন? কতো দিন শুনিনা তোমার মুখে প্রিয় ডাক নামটা। হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতে। কথা দাও এবার থেকে আগের দিনগুলির মতো অভি বলেই ডাকবে…।
হো হো শব্দে হেসে ওঠে দুজনেই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরনো সব মধুর স্মৃতি…। কাছে এসে নীলাকে জড়িয়ে ধরে অবিনাশ। অস্ফুট স্বরে নীলা বলে ওঠে – “অভি…” । দুজনে ভেসে যায় ভালোবাসার বন্যায়। বাইরে তখনও বৃষ্টির মরশুম।