আনন্দ মাঝির মন ভালো নেই। সারাদিন সাগরে জাল ফেলেও সে তেমন মাছ ধরতে পারেনি। যাকিছু মাছ ধরেছিলো তাও মহাজন নিয়ে গেছে। এখন সে খালি হাতে কিভাবে বাড়ি যাবে ভেবে কূল পাচ্ছে না। ঘরে চাল নেই, ডাল নেই, তরিতরকারি নেই। রাতে ছেলেমেয়েরা কি খাবে, তার কোনো ঠিক নেই। বউয়ের মুখঝামটার কথা ভাবতেও সে বাড়ি যেতে ভয় পাচ্ছে। তাই সে সাগরপাড়ে মন খারাপ করে বসে আছে। এমন সময় সাগরপাড়ে কি যেন একটা ভেসে আসতে দেখলো সে।
সাথে সাথে সাগরে নেমে সে এগিয়ে যায় ভেসে আসা বস্তুটির দিকে। কাছে এগিয়ে এসে হাতে তুলে নেয় বস্তুটিকে। মৌমাছির চাকের মত ধূসর একটি আশ্চর্য বস্তু! নাকের কাছে বস্তুটিকে নিতেই তীব্র একটা সুগন্ধ তার নাকে ঝাপটা মারে। সাথে সাথে সে বুঝতে পারে এটা তিমির বমি। যার এক কেজির মূল্য এক কোটি টাকারও বেশি। আর এখানে তিমির বমি দুই কেজি হবে। নিজের সৌভাগ্যে আনন্দে অভিভূত হয়ে ভাবলো সে— যাক, এতদিনে তাহলে স্রষ্টা আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন। তিমির দুই কেজি বমি আমার জন্য দুই কোটি টাকার এক মহাসৌভাগ্য বয়ে নিয়ে এনেছে!
হ্যাঁ, আনন্দ মাঝি সাগর পাড়ে যে বস্তুটি পেয়েছে, সেটার নাম “অ্যাম্বারগ্রিস” — সোজা কথায় তিমি মাছের বমি। বিশাল আকারের স্পার্মহোয়েল বা শুক্রাণুতিমির এই বমি স্বর্ণের চেয়েও দামী। কেননা, এক কেজি স্বর্ণের দাম মাত্র পঞ্চাশ লাখ টাকা। আর এক কেজি অ্যাম্বারগ্রিস তথা তিমির বমির দাম এক কোটি টাকারও বেশি। সবচেয়ে বড় কথা হলো— এক কেজি স্বর্ণ টাকা থাকলে যেকোনো সময় পাওয়া যায়। কিন্তু এক কোটি টাকা থাকলেও যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে অ্যাম্বারগ্রিস বা তিমি মাছের বমি পাওয়া যায়না।
যদিও তিমি মাছ সাগরের গভীরে থাকে তবুও সব সময় অ্যাম্বারগ্রিস বা তিমি মাছের বমি গভীর সাগরে পাওয়া যায় না। কেননা তিনি মাছ গভীর সাগরে থাকলেও বমি করে সাধারণত অগভীর পানিতে। তাই অগভীর পানিতেই বেশিরভাগ সময় অ্যাম্বারগ্রিস বা তিমি মাছের বমি পাওয়া যায়। তাছাড়া অ্যাম্বারগ্রিস পানির চেয়ে অনেক হালকা তাই পানির উপরে ভেসে থাকে। অনেকটা স্পঞ্জের মত। অ্যাম্বারগ্রিস দেখতেও অনেকটা স্পঞ্জ, বড়সড় পাথর কিংবা মৌমাছির চাকের মত অনেক হালকা। তাই অ্যাম্বারগ্রিস পানির উপর ভেসে থাকে। আর ভাসতে ভাসতে সাগর উপকূলে চলে আসে।
অ্যাম্বারগ্রিস বা তিমি মাছের বমি কেন এতো দামী?
অ্যাম্বারগ্রিস বা তিমি মাছের বমি একটি আশ্চর্য প্রাকৃতিক সুগন্ধি! শুধু তাই নয়, অ্যাম্বারগ্রিস বা তিমি মাছের বমি কস্তুরি হরিণের কস্তুরির চেয়েও অনেক বেশি তীব্র সুগন্ধিযুক্ত পদার্থ। তিমি মাছ স্কুইড এবং এই জাতীয় সামুদ্রিক খাবার খাওয়ার পর পাকস্থলী ও আন্ত্রিক বিশোষণের পর যে বমি করে সেই বমিতেই মহামূল্যবান অ্যাম্বারগ্রিস নির্গত হয়। নির্গত হওয়ার সময় অ্যাম্বারগ্রিস থাকে গলিত মোমের মতো সেমিসলিড উষ্ণ পদার্থ। পরে সমুদ্রের শীতল পানির সংস্পর্শে এসে তা মৌমাছির চাক বা বড়োসড়ো পাথরের মতো কঠিন আকার ধারণ করে।
নির্গত হওয়ার সময় তিমির বমি অ্যাম্বারগ্রিসে এক ধরনের কটূ গন্ধ থাকে, কিন্তু যতই সমুদ্রের পানিতে ভাসতে থাকে; ততই এর মধ্যে সুগন্ধি সৃষ্টি হতে থাকে। আর এই সুগন্ধির জন্য সারা পৃথিবীর সুগন্ধি তথা পারফিউম উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো পাগল। অ্যাম্বারগ্রিস থেকে শুধু পারফিউম নয়, শরীরের শক্তিবর্ধক নানারকম যৌনউত্তেজক মূল্যবান ওষুধপত্রও তৈরি হয়। কিন্তু এর জন্য যে পরিমাণ অ্যাম্বারগ্রিসের প্রয়োজন, সেই পরিমাণ অ্যাম্বারগ্রিস প্রকৃতিতে সচরাচর পাওয়া যায় না; অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় যোগান খুবই কম। তাই তিমির বমি বা আশ্চর্য অ্যাম্বারগ্রিস মহামূল্যবান! এতো দামি বিস্ময়কর এক রহস্যময় আশ্চর্য বস্তু!!
সাইফুল হক : লেখক, সম্পাদক, গবেষক।
সাগর, তিমি, বমি, অ্যাম্বারগ্রিস, আশ্চর্য বস্তু!