তোমার প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিল না আমার। অথচ একসাথেই আমরা বেড়ে উঠেছি সাত আটটি বছর ধরে। দুজন মিলে চড়ুইভাঁতি খেলেছি। জুটি কিংবা বর কনে সাজায় সেইসময় ছোটদের মাঝে আমরা প্রায় কিংবদন্তীর মত। অন্য মেয়ের সাথে জুটি বাঁধতে কিংবা অন্য কারো বর হতে আমার কোনরকম আপত্তি ছিল না। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে আমাকে ছাড়া চলতই না তোমার। বর কিংবা জুটি হিসেবে আমাকে তোমার চাই ই চাই।
একদিন খেলতে গিয়ে দেখি তুমি কাঁদছ। বললাম, কাঁদছিস কেন রে?
আমাকে দেখে তোমার কান্না বেগ পেল। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অনেকক্ষণ ধরে যে দুচারটি কথা বললে তার অর্থ ছিল এরকম যে, রন্টি তোমায় খারাপ কথা বলেছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বললে, ও আমাকে বউ বানাতে চেয়েছিল।
-ওমা, তাতে কি হয়েছে?
-আমি ওর বউ হব না।
-কেন?
-রন্টির সবসময় সর্দি হয়।
-তোরও তো হয়। ঐ যে এখনো নাক দিয়ে গলগল করে পড়ছে। ছ্যা!
তুমি ভীষণ রেগে গেলে। মাটিতে পা দাপিয়ে বললে,
তবু আমি রন্টির বউ হব না। হব না। হব না।
-কিন্তু রন্টি তোকে খারাপ কথা বলল কেন? তুই কি ওকে ওর সর্দির কথা বলেছিলি?
-না।
-তাহলে?
-আমি তোমার কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম,তিতুল ভাইয়া ছাড়া আর কারো বউ হব না। শুনেই রন্টিটা খারাপ কথা বলল।
বলে তুমি আবার কাঁদতে লাগলে। আমি অনেকবার করে জানতে চাইলাম, রন্টি কি বলেছে। তুমি বলতেই চাইছিলে না। আমি রেগে চলে আসছিলাম, তুমি আমায় টেনে ধরে বসালে। তারপর লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে কথাটি বললে। তোমায় আমায় জড়িয়ে রন্টি যে কথাটি সেদিন বলেছিল তার অর্থ সেসময় আমার জানা ছিল না। শুধু জানতাম, এগুলো খারাপ কথা। কিন্তু এখন বুঝি, কী ভয়াবহ কথাই না রন্টি সেদিন বলেছিল।
রন্টির বাবা পুলিশের চাকুরী করতেন। গ্রামের মধ্যে একমাত্র ওদেরই একটা মোটর সাইকেল ছিল। রন্টির একটি বোন ছিল। পুতুলের মত দেখতে। কিন্তু খুব অহংকারী। আমাদের সাথে মিশত না। দেখা যেত রন্টি আমাদের সাথে খেলছে, সে এসে রন্টিকে বলত, ভাইয়া, এদের সাথে খেলতে আম্মু তোমাকে মানা করেছে না? তারপরও খেলছ? এই আমি যাচ্ছি , আম্মুকে বলে দেব। রন্টি তখন ভয় পেয়ে উঠে যেত বোনের সাথে।
রন্টির যে আমাদের সাথে খেলার খুব আগ্রহ ছিল, তা নয়। আমরাই ওকে চুপি চুপি গিয়ে ডেকে আনতাম। কারণ ওর অনেক খেলনা ছিল। যার সিঁকি ভাগও আমাদের কারুর ছিল না। সম্ভবত এই কারণেই রন্টিটা আমাদের ওপর কর্তৃত্ব খাটাত। আর আমরাও পারতপক্ষে ওকে ঘাঁটাবার চেষ্টাও করতাম না।
কিন্তু তোমাকে খারাপ কথা বলাতে আমি কেন জানি, খেপে গেলাম। আমার হাড় জিড়জিড়ে শরীরে হঠাত্ ই যেন একপালা ক্রোধ এসে জড় হল। রন্টির বাবা যে একজন পুলিশ অফিসার তা জেনেও আমি রন্টিকে মারতে ছুটলাম।
রন্টি তখন বারান্দায় বসে রেলগাড়ি চালাচ্ছিল। আমি বারান্দায় উঠেই জামায় হ্যাঁচকা টান মেরে ওকে দাঁড় করালাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই পেটে একটা রাম ঘুষি খেল রন্টি। ওর মুখ দিয়ে কোঁক করে একটা শব্দ বেরোল শুধু। আমি হিসহিস করে বললাম, ফের যদি আমাদের সাথে খেলতে আসিস তবে এক খামচে তোর চোখ তুলে নেব। বলে ওকে ধাক্কা মেরে বারান্দায় ফেলে দিয়ে দ্রুত চলে আসছিলাম। শুনলাম রন্টির বোন চিত্কার করছে, আম্মু, দেখে যাও। ভাইয়াকে একটা ছেলে মেরে পালাচ্ছে।
কিন্তু আমি পালাচ্ছিলাম না। আমার খালি একটাই তাড়া ছিল, দ্রুত গিয়ে তোমাকে বলব, রন্টিকে আমি মেরে এসেছি। এখন কান্না থামা।
একদিন আমি তোমাকেও মেরেছিলাম। চড়ুইভাঁতি খেলছি। এবং যথারীতি তুমি আমার বউ হয়েছ। সারাদিন মাঠে কাজ করেছি। ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে তোমাকে ভাত দিতে বললাম। তুমি মাটির প্লেটে করে ভাত নিয়ে এলে। আমার ডায়লগ ছিল, আমাকে বলতে হবে, তরকারীতে এত লবণ দিয়েছ কেন? উফ! খেতেই পারছি না। তখন দুজনের ঝগড়া বাধবে।
খেলা শুরু হল। আমি মুখের কাছে ভাত(বালু) তুলে খাবার ভান করে মুখ বিকৃত করে বললাম, এহ! এত্ত লবণ দিয়েছ কেন? মুখটাই জ্বলে গেল। তুমি বললে, কোথায় লবণ হয়েছে শুনি? কতদিন থেকে লবণ আন না তুমি। ঘরে এক চিমটি ছিল তাই দিয়েছি।
-তাই দিয়েছি! বললেই হল। ভাল করে তরকারী তুমি কখন রেঁধেছ শুনি? আজ লবণ বেশি হয়ত কাল হলুদ। প্রতিদিন কিছু না কিছু হবেই।
-কি বললে? আমি তরকারী রাঁধতে পারি না? তাহলে যাও যে ভাল তরকারী রাঁধতে পার তাকে নিয়ে এসো গে, যাও।
-হ্যাঁ, তাই নিয়ে আসব। আমি এখুনি তিন্নিকে নিয়ে আসছি।
তিন্নির কথা ডায়লগে ছিল না। আমি ভুল করে বাড়িয়ে বলেছিলাম। তুমি তিন্নিকে একদমই পছন্দ করতে না। কারণ তোমার মত তিন্নিও বার কয়েক আমার বউ সেজেছিল।
তিন্নির কথা শুনেই তুমি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলে। পা দিয়ে মাটির প্লেটটাই দিলে ভেঙে। প্লেটটা আমার ছিল। আমিও ধা করে রেগে গেলাম। তারপর তোমার পিঠে চড় বসিয়ে দিলাম চার পাঁচটি। জোরেই দিয়েছিলাম। তুমি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছিলে। পরে শুনেছি, আমার সবকটা আঙুলের দাগ তোমার পিঠে উঠে গিয়েছিল।
সেদিনের পর থেকে তুমি আর আমার বউ সাজ নি। আমার সাথে জুটিও বাঁধ নি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমি অন্য কারো সাথে জুটি বাঁধা কিংবা অন্য কারো বর হওয়াটা একদম ছেড়ে দিয়েছিলাম।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। আমি পড়াশুনা শেষ করে দুবছর বাপের ঘাড়ে ঝুলে আছি। সন্ধে বেলা ঝুপড়িতে বসে সিগারেট খাই। ঝানুদার দোকানে মেলা বাকি পড়ে গেছে।
রন্টির সাথে প্রায় দেখা হয়। মাঝে মাঝে কথা হয়। মাঝে মাঝে হয় না। দুজনই বেশিরভাগ সময় না দেখার ভান করি। তোমার কথা আমি ভুলেই গিয়েছি। শুধু হঠাত্ হঠাত্ যখন রন্টির বাইকে চেপে, তার কাঁধে হাত রেখে তোমাকে বেরোতে দেখি তখন কোথায় যেন চিনচিন করে ওঠে একটু। অস্বস্তিকর অনুভূতি।
শুনেছি, রন্টি ভাল চাকুরী করে। মাসে অন্তত একবার হলেও তোমাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যায়। শুনেছি, গতমাসে তোমরা শিলিগুড়ি গিয়েছিলে। আবারো হয়ত কোথাও ঘুরতে যাবে। কুয়াকাটা, দার্জিলিং, মরিশাস বা অন্যকোথাও।
আমি জানি, তুমি সুখে আছো।