ভোর 5টা বাজে আমি বাস স্ট্যান্ড এ অনিকের জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু অনেক আসছে না বলে ওকে আমি বার বার কল করছি কিন্তু ওর ফোন অফ ছিল টেনশন এ আমি ঘেমে একাকার। সাথে অনেক ভয় ও লাগছে অনিক যদি না আসে তাহলে আমি একা একা কি করবো আর কোথায় বা যাবো। ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে এলো অনিক আর আসলোনা নিস্তব্ধ আমি একা দুচোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে শুধু বার বার মনে হচ্ছে অনিক আমাকে এভাবে ঠকাতে পারলো। যে মানুষ টা আমি এত বেশি ভালোবাসতো আমাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না সে আজ এভাবে আমাকে ঠকালো। একটা মানুষ যে এত সুন্দর করে কাউকে ঠকিয়ে চলে যেতে পারে সেটা অনিক কে না দেখলে হয়তো আমি বুঝতেই পারতাম না। অনিক কিভাবে তার নীল পড়ি কে এভাবে ঠকাতে পারলো?
আমার তো এখন বেশি ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অনিক ও আসলোনা স্বার্থপর এর মতো আমাকে ঠকালো। আমার তো আর যাওয়ার সেরকম কোনো জায়গা নেই। আস্তে আস্তে চারিদিক আলোয় আলোয় ভোরে উঠলো সকাল হয়ে গেল কত মানুষের আনা গোনা শুরু হয়ে গেল কিন্তু আমার নিষ্পাপ দুটি চোখ যাকে খুঁজছে তাকে আর দেখতে পেলো না। অবশেষে আমি এক রাস কষ্ট বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
অনিকের সাথে আমার ছাড় বছরের সম্পর্ক। ও আমাদের কলেজেই পড়তো। মাঝে মাঝে টার সাথে দেখা হলে কথা বললাম কিন্তু ছেলেটার প্রতিদিন অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করতো মনে হতো ও যেন আমার কত দিনের চেনা কেউ।
ও আমার সাথে কথা বললে মনে হতো আমি জানো অন্য এক জগতে চলে গেছি। খুব ভালো লাগতো।
আর অনিক ও যে আমাকে মনে মনে পছন্দ করতো সেটা আমি খুব বুঝতাম। সুযোগ পেলেই আমার সাথে কথা বলতে চলে আসতো। বসে বসে কি সব আজে বাজে কথা বলতো যেই কথার কোনো মানে নেই। বুঝতে পারতাম টার ও আমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে।
একদিন আমাদের ফ্রেন্ড সাদমানের বার্থডে তে গিয়েছিলাম একটা নীল শাড়ী পরে সেদিন ও আমার দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারছিলো না।
সেদিন ই ও আমাকে প্রপোস করে। আর সেদিন থেকে ও আমাকে নীল পরী বলে ডাকে। আমাকে নাকি একদম নীল পরীর মতো লাগছিলো।
আমাদের রিলেসন শুরু হয় সেদিন থেকেই। অনেক ভালো ছিলাম কলেজ শেষ এ মাঠ এ বসে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা হাতে হাত রেখে হারিয়ে যেতাম অচেনা এক জগতে।
ও রোজ আমার সাথে দেখা করতে আসতো বকুল ফুলের মালা নিয়ে।
বকুল ফুল আমার প্রিয় ছিল।
কিন্তু ও সবসময় আসতো আমার থেকে দেরি করে। সবসময় আমি আগে যেতাম কিন্তু কখনো আমি ওকে বলিনি তুমি প্রতিদিন দেরি করে আসো কেন।
অথচ অনিক ই মাঝে মাঝে আমাকে জিগ্যেস করতো আমি যে প্রতিদিন ওর জন্য অপেক্ষা করি আমার খারাপ লাগে না?
তাহলে আমি ওর উপর রাগ করি না কেন?
আমি বলতাম এই যে আমি প্রতিদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করি সেটা আমার কাছে অনেক বেশি সুখের সবসময় এটা মনে হতে থাকে আমি এমন একজনের জন্য অপেক্ষা করছি যার জীবনে আমি ছাড়া অন্য আর কিছু নেই কেউ নেই।.
তার জন্য যেন আমি অনন্ত কাল অপেক্ষা করে থাকতে পারি।
ও শুধু আমার কথা শুনে হাসতো। কত ভালো ছিল সুখের ছিল সেই দিন গুলো।
অনিক অনেক চেষ্টা করছে একটা চাকরি নেওয়ার কিন্তু কিছুতে হচ্ছে না। ও মাঝে মাঝে ভেঙে পড়তো বলতো আমাকে দিয়ে কিছু হবে না আমি বার বার ওকে সাহস জুগিয়েছি বার বার বলেছি তুমি চেষ্টা করে যাও অবশ্যই একদিন পারবে। ও আমাকে বলতো তুমি এত মনের জোর কোথায় পাও আমি কিছু বলতাম না শুধু মুচকি হাসি দিতাম। এদিকে বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পাত্র খুঁজছে।
মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে পড়া শুনা শেষ করেছে আর দেরি করলে ওর জন্য আর পাত্র পাওয়া যাবে না। আরো কত চিন্তা বাবার তার মেয়ে কে নিয়ে।
কিন্তু অনিক চাকরি পায় নি বলে বাবা কে কিছু বলতে পারছিনা।
এদিকে অনিক ও অনেক চেষ্টা করছে একটা চাকরিরি জন্য। হয়তো হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে।
. কিন্তু আমার বাবার যেন আর তর সয় না।প্রতিদিন বাড়িতে বর
পক্ষ আসে আমাকে দেখতে।
এভাবে দেখতে দেখতে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফরহাদ এর সাথে। ফরহাদ অনেক ভালো একটা চাকরি করে।
কিন্তু আমি যে অনিক কে ভালোবাসি। অনিক কে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে যে সম্ভব না সেতো কেউ বুঝতে চায় না।
অনিকের আজ একটা ইন্টারভিউ আছে। ও আমার সাথে দেখা করতে এসেছে আমি ওকে বলে দিয়েছি আজকের চাকরিটা হোক আর না হোক আমরা দুজনে মিলে পালিয়ে যাবো অনেক দূরে কোথাও যেখানে আমাদের কেউ চিনবেনা কেউ জানবেনা। যেখানে কেউ আমাদের ভালোবাসার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াবেনা। অনিক ও বলেছিলো ঠিক আছে তাহলে তাই হবে। সে ছোট খাটো একটা চাকরি জোগাড় করে নিবে আর আমি ও সুযোগ করে কোথাও একটা চাকরির খোঁজ করে নেবো তাতে আমাদের দুজনের ভালোই দিন কেটে যাবে।
তাতে হয়তো আমাদের অনেক কষ্ট করতে হবে কিন্তু দিনশেষে আমরা একে ওপরের সাথে থাকতে পারবো পাশে থাকতে পারবো। তার থেকে বেশি আমরা আর কিছু চাই না।
আমার বিয়ের দিন প্রায় ঘনিয়ে আসছে। বাড়িতে কাউকে কিছু বলতে পারছিনা। অনিক ও চাকরিটা পায় নি।
খুব চিন্তা হচ্ছে। অনিক কে ফোন দিলাম অনিক বললো আর দেরি করা যাবে না আমরা কালকে সকলকে উঠে বেরিয়ে পড়বো অজানা উদ্দেশে।
আমিও তাই করবো বলে ঠিক করলাম।
ভোর 5টায় আমি ঘুম থেকে উঠে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো ঠিক তখন বাবা মা ঘুমিয়ে ছিল ঘুমের মধ্যের বাবা মায়ের চেহারা কত নিষ্পাপ লাগছিলো।
ছোট বেলা থেকে বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসতো আদর করতো আমার কোনো ইচ্ছা অপূর্ন রাখে নি। যখন যেটা বলেছি সেটাই এনে দিয়েছে আমাকে। আর আজ আমি স্বার্থপরের মতো ওদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। ভাবতে ভাবতে দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
আমি বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে।
অনিক সেই মানুষ যে আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। ভরসা করতে শিখিয়েছে। আর আজ সেই আমাকে এভাবে একা করে দিলো। কি দোষ করেছিলাম আমি। অন্য সবার মতো সারাটা জীবন ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। সে যদি সারাজীবন আমার পাশে নাই থাকবে তাহলে আমাকে আসা দেখালো কেন আমাকে ভরসা দিলো কেন।
আমি যেন আর কিছুই ভাবতে পারছিনা।
অনিক কথা দিয়ে কথা রাখলোনা। কেন সে আমার সাথে এমন করলো। আমি ওর কি ক্ষতি করেছি?
ভাবতে ভাবতে কখনো যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।
হঠাৎ আমার বড়ো খালার গলার আওয়াজ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল।কি রে বিয়ের কনে এত বালা পর্যুন্ত ঘুমালে চলবে। আজ তোর গায়ে হলুদ আর কালকে বিয়ে তোর মনে আছে তো? বাসায় আত্মীয় স্বজন গোমগম করছে।
কিন্তু আমার নিষ্পাপ মন যেন সবার মাঝে সেই অনিক কে খুঁজে পেতে চাইছে। যাকে ভালোবেসে আমি সারা জীবন কাটিয়ে দিয়ে চেয়েছিলাম।
অনিক কে ভালোবেসে অন্য কাউকে আমি কিভাবে বিয়ে করবো কিভাবে অন্য কারো সংসার করবো ভাবতে ভাবতে আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি
কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিনা অনিক কেন আমার সাথে এমন করলো। ওকে আমি কতবার ফোন করেছি তার হিসেব নেই কিন্তু ওর ফোন সমানে অফ দেখাচ্ছে। আমি যেন আর কিছু ভাবতে পারছিনা।
সন্ধ্যায় সবাই মিলে আমাকে মেহেন্দি পরিয়ে দিলো। গায়ে হলুদ হলো। আমার বাবা মা থেকে শুরু করে সবাই আজ কত খুশি কিন্তু আমি যেন এক মুহূর্তের জন্য শান্তি পাচ্ছিনা। ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে অনিক কে জিগ্যেস করি ও কেন আমার সাথে এমন করলো। বর যাত্রী চলে এসেছে।
সবাই বর এসেছে বর এসেছে বলতে বলতে আমার রুম থেকে চলে গেল।
আমি একা রুম এ ভাবছি এভাবে অন্য একজনকে বিয়ে করার থেকে আমার মরে যাওয়া অনেক ভালো। বাবার ঘুমের ওষুধের বোতল টা নিয়ে এসেছিলো সবগুলো ওষুধ হাতে নিয়ে বসে আছি আর ভাবছি এভাবে অন্য কারো জীবনে সাথে হয়ে বেঁচে থাকার থেকে আমি মরে গেলেই হয়তো শান্তি পাবো। কিন্তু মুহূর্তেই আবার মনে হলো একজন প্রতারকের জন্য আমি কেন আমার জীবনে টা এভাবে নষ্ট করছি। বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাইকে কেন এভাবে কষ্ট দেবো একজন প্রতারকের জন্য।
ওষুধ গুলো আবার বোতলে রেখে বসে আছি।
ফরহাদের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
আমি বাসর ঘরে বসে আছি পুরো রুম অনেক সুন্দর করে সাজানো। আমি যেন মুগ্ধ হয়ে দেখছি। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেলাম বুঝতে পারলাম ফরহাদ এসেছে।
ও এসেছে বিছানায় বসতেই আমি বলে উঠলাম খবরদার আমার দিকে আর এক পা আসবেন না। ভালো হবে না কিন্তু। আপনাকে আমি বিয়ে করেছি বলে এই না যে আমি আপনাকে আমার সবকিছু দিয়ে দিবো।আপনি ভুলেও এমন ভাববেন না।
ফরহাদ অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সব কথা এক নিঃশাস এ বলে যখন আমি হাপিয়ে উঠেছি ফরহাদ তখন এক গ্লাস পানি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো আগে পানি টা খেয়ে নেন তারপর কি বলার আছে বলেন।
আমি গ্লাস টা হাতে নিয়ে এক চুমুকে পানি খেয়ে নিলাম।
আমি অবাক হয়ে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে আছি কেমন মানুষ ও আমি এভাবে ওকে অপমান করলাম অথচ তার মধ্যে কোনো রাগ বা অভিমান নেই।
হঠাৎ ফরহাদ বলে উঠলো কি হয়েছে আপনার কি সমস্যা এবার আমাকে খুলে বলুন আমি শুনছি।
আমি একজন কে ভালোবাসি।আপনাকে আমি আমার ইচ্ছার বাইরে গিয়ে বিয়ে করেছি শুধু মাত্র আমার বাবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে। ঠিক আছে এটা কোনো সমস্যা না আমরা বাইরে সবার সামনে অন্যান্য স্বামী স্ত্রীর মতোই থাকবো কেউ কিছু জানতে পারবেনা তাহলে তুমি খুশি তো। হ্যা। আমি যেন এক রাস শান্তি পেলাম। সাথে অবাক ও হলাম একটা ছেলের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া তো এত সহজ না তবে ফরহাদ কিভাবে এত সহজে মেনে নিলো।
তুমি ঘুমিয়ে পড়ো আমি সোফায় ঘুমাবো বলে ফরহাদ বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লো।
ফরহাদ আর আমার বিয়ের 2মাস হয়ে গেছে আমি একদিনের জন্য ওকে স্বামীর অধিকার দেই নি। ফরহাদ ও আমাকে এই বিষয়ে কখনো কিছু বলে নি।
কিন্তু মানুষ টা আমার কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখে না। আমি যখন যেটা বলে সাথে সাথে সেটা করে। আমি আস্তে বললে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হলেও সাথে সাথে আমার সামনে হাজির হয়ে যায়।
ও মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে বাইরে যায় আমিও বেশি উপভোক করি। একসাথে পার্কে গিয়ে হাঁটা। নদীর পারে যাওয়া। লং ড্রাইভ এ দাওয়া থেকে শুরু করে আরো কত কি।
বুঝতে পারতাম মানুষ টা আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে।এতদিনে আমরা আমাদের সংসার নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছি।
এই এত দিনের মধ্যে আমি যেন অনিক কে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন আর অনিক কে আগের মতো মনে পরে না আগের মতো ওর জন্য কাঁদতে ইচ্ছা করে না ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে ওকে বলি আমি এখনো তোমার জন্য অপেক্ষা করি। ইচ্ছা করে না। সব স্মৃতি যেন মন থেকে মুছে দিয়েছে ফরহাদ এর ভালোবাসা।
বুঝতে পারছি আস্তে আস্তে আমিও ফরহাদ কে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু ওকে কখনো বলা হয় নি।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নীলার গলার আওয়াজ।
নীলা আমার ছোট বেলার বন্ধু। ওর সাথে সব শেয়ার করতাম অনিক এর বিষয় টাও ও জানে।
কি রে কেমন আছিস?
হঠাৎ এত দিন পরে আমার বাসায়।
প্রিয়া তোকে একটা খবর দেওয়ার আছে।
কি খবর নীলা বল।
নীলা আমার হাতে একটা ডাইরি দিয়ে বললো প্রিয়া অনিক তোকে ঠকায় নি রে।
ও সত্যি তোকে অনেক বেশি ভালোবেসেছে।
এই ডাইরি টা পড়লে তুই সব জানতে পারবি।
অনিক ভাইয়ার ক্যান্সার ধরা পরে তাই ও সেদিন তোকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে নি। তবে একটা অনিশ্চিত জীবনের মুখে ফেলতে পারবেনা বলে।
তাই ও আর তোমার সাথে কোনো যোগাযোগ করে নি তাতে তুমি আরো অনেক বেশি ভেঙে পড়বে তাই।
ও চেয়েছিলো তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও। এই ডাইরি টাতে সব লেখা আছে।
গতকাল অনিক ভাইয়া মারা গেছে রে প্রিয়া।
কথাটা বলেই নীলা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
নীলার কথা শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে আমি যেন কিছু শুনতে পাচ্ছি না।দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে।
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম এই আমি।