রানীর দীঘির পাড়। বেশ বড় এবং প্রাচীন একটি দীঘি। পাশেই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটি। হঠাৎ আকাশ থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি দীঘিতে আছড়ে পড়ছে। ছেলে বুড়ো যারা গোসল করছিল দ্রুত গোসল সেরে বাড়ির পথ ধরে। দীঘির সাথেই চওড়া রাস্তা সাথেই অনেক গুলো ফ্ল্যাট বাড়ি। উত্তর দিক থেকে প্রথম ফ্ল্যাট বাড়িটির নাম ইন্টেক্স ভিক্টোরিয়া। ৮ তলা বাড়িটিতে ৫৪ টা পরিবারের বসবাস। বুঝতেই পারছো কত বড় বাড়ি? ছাতা বন্ধ করে ইন্টেক্স ভিক্টোরিয়া বাড়িটিতে দাড়িওয়ালা এক লোকের প্রবেশ। নিচে দারোয়ান আলামিন বসা ছিল। দাড়িওয়ালা লোকটিকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।
-“কোন ফ্ল্যাটে যাবেন?”
-“ইয়ামিন সাহেবদের ফ্ল্যাটে”।
আলামিন মাথা চুলকিয়ে বলল – “আপনার পরিচয়?”
-“আপনি ইয়ামিন সাহেবকে বলেন রাশেদ এসেছে”।
আলামিন টেলিফোনে ইয়ামিন সাহেবদের বাসায় ফোন দেয়। ইয়ামিন সাহেব আলামিনকে বলে রাশেদকে যেন উপরে পাঠিয়ে দেয়। রাশেদ লিফটে ঢুকে এইট বাটনে চাপ দেয়।
-“বাসা চিনতে অসুবিধা হয়নি তো?” বলেই ইয়ামিন সাহেব চায়ের কাপটা হাতে নেন।
-“না স্যার, চিনতে পেরেছি”। রাশেদ বলল।
-“আচ্ছা, কাজের কথায় আসি। তোমাকে ছেলে দেখতে বলেছিলাম। দেখেছ নাকি?” ইয়ামিন সাহেবের জিজ্ঞেস।
রাশেদ চা শেষ করে টেবিলে রাখে। মুচকি হেসে বলে, “স্যার, ভালো ছেলে তো আপনার বাসার নিচেই আছে”।
ইয়ামিন সাহেব চমকে উঠেন –“বাসার নিচে মানে?, ফকির মিসকিন নয় তো?”
-“স্যার কি যে বলেন, বাসার নিচে মানে ৪ তলার কথা বলছিলাম”।
-“বল কি? আমাদের ৪ তলায়?” ইয়ামিন সাহেবের আগ্রহ বেড়ে যায়।
-“তবে আর বলছি কি স্যার! ৪ তলায় ফিরোজ স্যারের ছেলে, আবরার নাম”।
-“ফিরোজ? কি করেন উনি? মানে পেশা কি?”
-“স্যার, সহযোগী অধ্যাপক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ”।
-“বাহ! ছেলের নাম কি বললে?”
-“আবরার”।
-“কি করে ছেলে?”
-“ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, নারায়ণগঞ্জের একটা প্রোজেক্টের দায়িত্বে আছে, অফিস চট্টগ্রাম”।
-“আচ্ছা, তাহলে তুমি বিস্তারিত বায়োডাটা আমাকে কালকে পরশুর মধ্যে দাও”।
-“জি স্যার”। বলেই রাশেদ উঠে দাঁড়ায়। “আসি স্যার”। বলেই দরজা খুলে রাশেদ চলে যায়।
লিফটে ঢুকে ফোর বাটনে চাপ দেয়। ওদিকে মেয়ের রুমের দিকে তাকিয়ে আছেন ইয়ামিন সাহেব। কপালে চিন্তার ভাজ।
উত্তর দিকের রুমটা বেশ বড় হলেও রুমে সূর্যের আলো খুবই কম ঢুকে। রুমে ২টা জানালা আর ছোট্ট একটা বারান্দা। রুমের কোনায় খাট তাতে বিষণ্ণ মনে বসে আছে ইয়ামিন সাহেবের মেয়ে। রুমের দরজা আটকানো। অন্ধকার রুম।
-“আদিব! তুমি ব্যাপারটা গুরুত্ব কেন দিচ্ছ না? বাবা এবার খুব সিরিয়াস আমার বিয়ে নিয়ে।
-“সব সময় যা করেছ তা করবা!”
-“বাবা এবার ঘটক ঠিক করেছেন”।
-“আমি কি করব?”
-“আদিব! তুমি কি ছোট ছেলে? এটাও আমাকে বলে দিতে হবে? পার্টটাইম একটা চাকরি দেখ”।
-“ওসব আমাকে দিয়ে এখন হবে না। আমি আমার পড়া-লেখায় ফোকাস করতে চাচ্ছি”। ফোনের ওপাশ থেকে আদিব বলল।
-“তুমি কি আমাকে হারাতে চাও?”
-“না”।
-“তাহলে?”
-“তুমি এবারো বিয়েটা ভেঙ্গে দাও”।
– “এবার মনে হয় না সেটা সম্ভব হবে”।
-“নীলা মা! আসবো?” দরজায় টোকা দিয়ে বাইরে থেকে ইয়ামিন সাহেবের জিজ্ঞেস।
সাথে সাথে নীলা ফোনটা কেটে দিল। “আসো বাবা!”
ইয়ামিন সাহেব রুমে প্রবেশ করলেন। “কি ব্যাপার রুম অন্ধকার কেন?” বলেই লাইট জ্বালালেন। নীলাকে দেখে মুচকি হাসলেন। “কি রে মা! কি করিস?”
-“এই তো বাবা একটু শুয়ে ছিলাম”।
-“ভার্সিটি গিয়েছিলি?”
-“হ্যাঁ বাবা, গিয়েছিলাম”।
কিছুক্ষণ দুজনই চুপচাপ। ইয়ামিন সাহেব নীরবতা ভাঙলেন। বললেন, “ঘটক এসেছিল”।
-“ওহ, আচ্ছা”।
-“জানতে চাইবিনা কি বলল?”
-“কি বলল?”
-“একটা ছেলের কথা বলল”।
-“কি নাম? কিসে জব করে?”
-“ছেলের নাম আবরার, নারায়ণগঞ্জের কি একটা প্রোজেক্টের দায়িত্বে আছে বলল, অফিস চট্টগ্রাম”।
-“চট্টগ্রামের ছেলে আমার পছন্দ না”।
-“কেন?”
-“চট্টগ্রামের ছেলেরা ভালো না”।
-“এভাবে বলে না মা! সব জায়গায় ভালো খারাপ আছে”।
-“আচ্ছা বাবা বুঝেছি”।
-“একটা মজার ব্যাপার কি জানিস?”
-“কি?” নীলার আগ্রহ প্রকাশ।
-“ছেলেটা আমাদের বিল্ডিং এ থাকে, ৪ তলায়”।
-“বল কি?”
-“হ্যাঁ, ঘটককে বলেছি বিস্তারিত বায়োডাটা নিতে”।
-“বাবা আসলে….”
-“কি মা? তোর কোন পছন্দ আছে? আমি আগেও বলেছি পছন্দ থাকলে বল”।
-“না বাবা মানে আমি বিয়ের জন্য…”
-“দেখ, আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না। এর আগেও অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিস। এই ছেলে যদি তোর জন্য উপযুক্ত হয় আমি কিন্তু এগবো বলে দিলাম”।
নীলার চোখে মুখে হতাশার ছাপ। কি করবে সে? আদিবের কথা বলবে? কি বলবে? ওর সাথে একই ক্লাসে পড়ে নাকি বলবে ছেলে কিছু করে না, বেকার। বাবাকে সে বলতে পারল না কিছুই। চুপ করে বসে রইল।
-“এই! নীলার আব্বু! টেবিলে ভাত দিয়েছি, খেতে এসো”। নীলার মা জাহানারা বেগমের রুমে প্রবেশ।
-“আসছি। চল্ মা খেয়ে নে”। বলেই ইয়ামিন সাহেব উঠে দাঁড়ায়।
-“বাবা! লাইটটা নিভিয়ে দাও কষ্ট করে”।
-“খাবি না?”
-“আসছি, তোমরা শুরু কর”।
নীলার বাবা ইয়ামিন সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। নীলার চোখ ছল ছল করে উঠল। খুব অসহায় অনুভব করছে সে। কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে। আদিবের সাথে পুরাতন স্মৃতি মনে পড়ছে নীলার। ভার্সিটির প্রথম দিনটার কথা। নীলা এমনেও একটু চাপা স্বভাবের। সহজে কারো সাথে ফ্রি হতে পারে না। টি ব্রেক টাইমে ক্যান্টিনের স্টল থেকে সিঙ্গারা নিয়ে যেই না পিছে ঘুরল অমনি এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে ধাক্কা লেগে প্লেট থেকে সিঙ্গারা পড়ে যায়। নীলা ঐ সিনিয়র ভাইকে সরি বললেও ঐ সিনিয়র ভাই ওর সাথে কড়া ভাষায় দুএক কথা বলে। বিষয়টা খেয়াল করে আদিব। নীলা মন খারাপ করে ক্যান্টিনের এক পাশে বসে থাকে। আদিব ২টা পেপসি আর ২ প্লেট সিঙ্গারা নিয়ে নীলার সামনে বসে পড়ে। নীলা একটু অবাক হয়।
-“আমি আদিব, তোমার ক্লাসের। নাও তোমার জন্য”। মুচকি হেসে পেপসি আর সিঙ্গারা নীলার দিকে এগিয়ে দেয়।
-“না না ঠিক আছে”।
– “আরে! তুমি আমার ফ্রেন্ড, আর ফ্রেন্ডের জন্য এইটুকু করতে পারি না?” আদিবের মুখে হাসি।
আদিবের হাসি ভরা মুখের কথা শুনে নীলা একটু স্বস্তি বোধ করে, ভাবে যাক কেউ তো ওকে ফ্রেন্ড ভাবল, আপন ভাবল। নীলা সিঙ্গারার প্লেটটা আর পেপসি নিজের দিকে এগিয়ে নিল। এভাবেই আদিবের সাথে বন্ধুত্ব। এরপর ফাস্ট ইয়ার শেষ করে সেকেন্ড ইয়ার। সেকেন্ড ইয়ার শেষ করে থার্ড ইয়ার। বছর গেল তার সাথে এই বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে ভালোবাসায় পরিণত হল।
-“কিরে খাবি না?” নীলার মা জাহানারা বেগমের ডাকে স্মৃতিময় অতীতের দেয়াল ভেঙ্গে বাস্তবে ফিরে নীলা।
-“আসছি”। চোখ মুছে নীলা। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এল। বৃষ্টি থেমে মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কলেজের কাছে একটা ট্রাকের কারণে জ্যাম সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাকের পিছনে রিক্সায় অবস্থানরত যাত্রীরা ট্রাকওয়ালাকে গাল মন্দ করছে। সেই রিক্সা গুলোর মধ্যে একটি রিক্সায় বসে আছে আবরার। কাল শুক্রবার। অফিস বন্ধ। তাই নিজ শহর কুমিল্লা চলে এলো।
-“এখানে জ্যাম! রানীর দীঘির পাড়ে? অবিশ্বাস্য। আবরার বলল।
-“হ ভাই, আমি তাই ভাবতাসি, এই হানে তো এমন হইবার কথা না”। রিক্সাওয়ালা বলল।
৫ মিনিট পরই জ্যাম ছুটে গেল। আবরারের রিক্সা এসে থামল ইনটেক্স ভিক্টরিয়া ফ্ল্যাট বাড়িটির সামনে। ভাড়া দিয়ে ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পড়ল নিজ ফ্ল্যাট বাড়িতে। এরপর লিফট দিয়ে সোজা নিজ বাসার দরজার সামনে দাঁড়াল আবরার। ডোর বেল চাপল। ভেতর থেকে আবরারের ছোট বোন নাদ্রাতুন বলে উঠল –“কে?”
-“এটা কি নাদ্রাতুন বুড়ির বাসা?”
নাদ্রাতুন বুঝে গেল এ আর কেউ নয় তার বড় ভাই। দরজা খুলে দিল।
-“কিরে কেমন আছিস?”আবরারের জিজ্ঞেস।
-“ভালো ভাইয়া”। হাসি ভরা মুখে নাদ্রাতুনের উত্তর। “মা! বাবা! দেখ! ভাইয়া এসেছে”।
রুম থেকে বেরিয়ে এলেন ফিরোজ সাহেব এবং লাকি বেগম। “কিরে!আসতে সমস্যা হয় নি তো?” ফিরোজ সাহেবের জিজ্ঞেস।
-“না বাবা, সমস্যা হয়নি”।
-“যা, গোসল সেরে ফেল, এখন পরিস্থিতি ভালো না। করোনা ভাইরাসের ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্ট বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে”।
-“ঠিক আছে মা, আমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হচ্ছি, তুমি খাবার রেডি করো। খুব খিদে পেয়েছে। আবরার বলল।
মা লাকি বেগম মৃদু হাসলেন –“ঠিক আছে, ফ্রেশ হয়ে আয়”।
আবরার রুমে যাওয়ার আগে মাস্ক ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। সার্জিকেল মাস্ক ৬ ঘন্টার বেশি ব্যাবহার করা ঠিক না। তাই সতর্কতা বশত ফেলে দেওয়া। হ্যান্ড সেনিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে রুমে প্রবেশ করে আবরার। চির পরিচিত রুম। ডান পাশে আলনা, বাম পাশে খাট আর প্রিয় পড়ার টেবিল। টেবিলে তার প্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন আর হুমায়ুন আহমেদের বই। গুছানো রুম দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল আবরারের। ব্যাগ রেখে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে গোসল সারল।
খাবার টেবিল। মাঝারি আকারের এই টেবিলে ভাতের বোল, মুরগির মাংসের বাটি আর লাল শাকের বাটি। নীলার প্লেটে অল্প কিছু ভাত, ছোট্ট এক পিস মুরগির মাংস আর অল্প ঝোল।
-“কিরে মা! তুই যে কিছুই খাচ্ছিস না, কি হয়েছে?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল নীলার বাবা ইয়ামিন সাহেব।
-“বাবা, খেতে ইচ্ছে করছে না”। নীলার উত্তর।
-“শাকটা নে! নে ধর! বলেই জাহানারা বেগম এক চামচ শাক নীলার প্লেটে উঠিয়ে দিল”।
-“বললাম তো মা খেতে ইচ্ছে করছে না, কেন জোর করছো?”
-“আহা! নীলার মা, ও খেতে যেহেতু চাচ্ছে না কেন জোর করছো?” ইয়ামিন সাহেব বললেন।
-“না খেতে খেতে মেয়েটার শরীরের কি অবস্থা হচ্ছে দেখেছ?” রাগান্বিত কণ্ঠে নীলার মা জাহানারা বেগম বললেন।
-“আমি খাব না”। বলেই নীলা খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়ে। বেসিনে হাত ধুয়ে সোজা নিজের রুমে প্রবেশ করে রুমের দরজা আটকে দেয়।
-“সব তোমার দোষ। মেয়েকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছ”। জাহানারা বেগমের কণ্ঠে রাগের স্ফুলিঙ্গ বইল।
-“সব ঠিক হয়ে যাবে নীলার মা, নীলার বিয়েটা হোক, সব ঠিক হয়ে যাবে। ইয়ামিন সাহেব নীলার মাকে আশ্বস্ত করলেন।
অন্ধকার রুমে নীলা শুয়ে আছে। চোখের কোণে ভাসছে আদিবকে নিয়ে স্মৃতি। রূপসাগর পার্ক, ধর্ম সাগর পাড়, নানুয়ার দীঘির পাড়ে তাদের কত্ত স্মৃতি। ধীরে ধীরে নীলা ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। প্রবেশ করে স্বপ্নের রাজ্যে। সে দেখে একটা ব্রিজের উপরে ও আর আদিব দাঁড়িয়ে। ব্রিজের নিচে পানি থৈ থৈ করছে। হঠাৎ আদিব ওকে ধাক্কা দিয়ে ব্রিজ থেকে ফেলে দিল। নীলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। রীতিমত সে ঘামছে। এমন স্বপ্ন দেখার মানে কি? তবে কি সে আদিবকে হারাবে? বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে।
বড় খাবারের টেবিল। তাতে একটি বাটিতে চিংড়ি মাছ, আরেকটিতে মুরগির ফ্রাই, আর বোলে খিচুড়ি। আবরার আর তার পরিবারের সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে।
-“বাবা! আগামী মাসে আমার প্রমশন”।
-“বাহ, সেলারি কত হবে তাহলে?”। আবরারের বাবা ফিরোজ সাহেবের জিজ্ঞেস।
– “সব মিলিয়ে ৩৫,৯৯০ টাকা”।
-“বেশ”। ফিরোজ সাহেব বললেন। খাওয়া শেষ করে সবাই যে যার রুমে চলে যায়। আধা ঘন্টা পর হঠাৎ ডোর বেল বেজে উঠল। ফিরোজ সাহেব দরজা খুললেন।
-“কাকে চাই?”
-“আপনি ফিরোজ স্যার?”
-“হ্যাঁ”।
-“আমার নাম রাশেদ, আমি পেশায় একজন ঘটক”।
-“ঘটক আমার বাসায়?”
রাশেদ তার আইডি কার্ড বের করে দেখায়। কার্ড দেখে ফিরোজ সাহেব নিশ্চিন্ত হলেন।
-“আপনার ছেলের জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম। বসতে পারি? একটু কথা ছিল আপনার সাথে”। রাশেদ বলল।
-“আচ্ছা ভিতরে আসুন”।
রাশেদ ভিতরে প্রবেশ করল। দরজা দিয়ে ঢুকতেই বেতের সোফা। শৌখিন মানুষরা বেতের তৈরি সোফা ব্যাবহার করে। রাশেদ সোফায় বসল।
-“বলুন, কী বলতে চাচ্ছেন?”
-“আপনার ছেলের নাম খুব সম্ভবত আবরার”। রাশেদ বলল।
-“হ্যাঁ, আমার ছেলের নাম আবরার”।
-“ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আসলে, আপনারা কি এখন ছেলেকে বিয়ে দিতে রাজি আছেন?”
-“মেয়ে কি করে?”
-“মেয়ে বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ে”।
-“কোন ডিপার্টমেন্টে আছে?” ফিরোজ সাহেবের জিজ্ঞেস।
-“ট্রিপল ই তে”। রাশেদ বলল।
-“মেয়ের বাসা কই?”
-“এই ফ্ল্যাটের ৮ তলায়”।
-“বলেন কি?”
-“হ্যাঁ”।
-“বাবার পেশা কি?”
-“উনি এনার্জি প্যাক কোম্পানির ম্যানেজার”।
-“আচ্ছা। মেয়ের ছবি আছে?”
-“এই যে”। আপনি এটা রাখতে পারেন”।
-“মেয়ে তো দেখতে সুন্দর মাশাল্লাহ”।
-“তাহলে স্যার এগুবো বিষয়টা নিয়ে?” রাশেদ হাসি ভরা মুখে বলল।
-“হ্যাঁ এগুতে পারেন”।
-“কিন্তু স্যার, ছেলের একটা ছবি আর বায়োডাটা তো লাগবে”।
-“ আচ্ছা আপনার ইমেল এড্রেস আছে?”
রাশেদ পকেট থেকে তার ভিসিটিং কার্ড বের করে ফিরোজ সাহেবের হাতে দিয়ে বলল – “এই যে স্যার”।
-“আচ্ছা, আপনার ইমেল এড্রেসে বায়োডাটা আর ছবি পাঠিয়ে দিব”।
-“আচ্ছা স্যার, আপনার নাম্বারটা যদি পেতাম ভালো হত”।
-“০১৭১….”
-“মেয়ের বাবার নাম্বার আপনার কাছে আছে?”।
-“জ্বী স্যার, আছে। “০১৮৭….”
-“ঠিক আছে”।
-“আচ্ছা স্যার আমি তাহলে উঠি”। রাশেদ উঠে দাঁড়ায়।
-“এক কাপ চা খেয়ে যান?”
-“না স্যার, আরেকদিন”। বলেই রাশেদ দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল।
পরদিন। ক্লাস শেষ করে বাসে বসে আদিবের জন্য অপেক্ষা করছে নীলা। বাসে সামনের সিটে ২টা মেয়ে বসা। নীলা একটু পিছনের দিকে বসেছে। দশ মিনিট পর আদিব উঠল বাসে।
-“কোথায় ছিলা?” নীলার জিজ্ঞেস
-“এই তো, সামিয়াকে একটা ম্যাথ বুঝাচ্ছিলাম”।
-“তোমাকে না নিষেধ করেছিলাম ওর সাথে কথা বলতে! এরপরেও….”
-“আচ্ছা ও এত করে রিকোয়েস্ট করছিল, আমি কিভাবে না করি?” আদিব বলল।
-“আচ্ছা ভালোই। ওর রিকোয়েস্ট তুমি রাখলা। আর আমার রিকোয়েস্টটা? আমি যে এত করে রিকোয়েস্ট করলাম ওর সাথে কথা না বলতে সেটা?”নীলা রাগ দেখিয়ে ডান পাশে বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল।
-“আচ্ছা, আমি কানে ধরলাম”। আদিব কানে ধরল। “আর কখনো ওর সাথে কথা বলব না হেল্প করবো না। সরি, প্লিজ মাফ করে দাও”।
অতীতে আদিবের উপর নীলা কখনই বেশিক্ষন রাগ করে থাকতে পারেনি। আজও পারল না।
-“ঠিক আছে, মাফ করে দিলাম”।
নীলার কথা শুনে আদিব মুচকি হাসে। নীলাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। নীলা বাঁধা দিয়ে বলে, “আদিব! কি করছো? এটা ভার্সিটি বাস”।
-“বা রে, আমি আমার বউ কে জড়িয়ে ধরতে পারবো না?” আদিব নীলার হাতটা ধরে বলল।
-“বিয়ে করতে পার কি না দেখ আগে”।
-“মানে!” আদিবের বিস্ময় প্রকাশ।
-“মানে ছেলে ঠিক করে ফেলসে। আমাদের ফ্ল্যাটের ৪ তলায় থাকে”। নীলা বলল।
-“কী বল? কবে ঘটে গেল এত কিছু?” আদিবের জিজ্ঞেস।
-“ গত কাল”।
-“এত কিছু হয়ে গেল আর আমাকে একবার জানালাও না”।
-“এই যে এখন বললাম”। নীলা বলল।
-“বিয়ের পরই বলতে একেবারে”। আদিব নীলার উপর রাগ ঝারল।
কিছুক্ষন দু’জনই চুপচাপ। বাস ছাড়ল।
-“ঐ ছেলের নাম্বারটা দাও”। আদিব বলল।
-“আমার কাছে কোন নাম্বার নেই”। নীলা বলল।
-“তুমি না বললে ছেলে ঠিক করে ফেলসে?”
-“হ্যাঁ, কিন্তু নাম্বার এখনো হাতে পাইনি”।
-“ভাগ্যিস পাওনি, পেলে তো….”
-“পেলে কী হ্যাঁ? পেলে কী? নীলা রেগে যায় আদিবের উপর।
-“পেলে সারা রাত চব্বিশ ঘণ্টা কথা বলতে, প্রেমে হাবুডুবু খেতে”।
-“আদিব! তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো”। নীলা উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
-“ঠিক আছে, ফেসবুক আইডি দাও”।
-“আদিব! মাত্র কথা বার্তা চলছে, তুমি বাচ্চা ছেলেদের মতো এমন করছো কেন?”
-“ও আচ্ছা? আমি এখন বাচ্চা ছেলে আর ঐ ছেলে মহাপুরুষ?”
-“ধ্যাত! তোমার সাথে কথা বলাই উচিত না”। নীলা রাগ করে জানালার দিকে তাকায়।
-“আমার কথা তোমার এখন বাচ্চামি লাগছে, পাগলামো মনে হচ্ছে। কিন্তু তুমি কি বুঝো এই পাগলামো একটা ছেলে কখন করে?” বলেই আদিব বাসের সিট থেকে উঠে পিছনের সিটে গিয়ে বসে। পিছনের সব সিট খালি। নীলা আনমনে জানালার দিকে তাকিয়ে। আদিবের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ওর অশান্ত মন কষ্টে জর্জরিত। ভিতরটা ছিড়ে যাচ্ছে আদিবের। নীলার কি সে খেয়াল আছে?
-“বাবা! ঘটক তোমাকে ঐ ছেলের নাম্বার দিয়েছে?” নীলার জিজ্ঞেস।
-“হ্যাঁ, কেন?” ইয়ামিন সাহেবের জিজ্ঞেস।
-“আমি ছেলের সাথে কথা বলতে চাই”। নীলা বলল।
-“কেন মা? কী কথা বলবি?”
-“ওমা! ছেলে কেমন তা আমার জানতে হবে না?”
-“ঠিক আছে, এই যে নাম্বার”। ইয়ামিন সাহেব মোবাইল থেকে নাম্বার বের করে মোবাইলটা নীলার হাতে দিল। নীলা তার বাবার মোবাইল থেকে নাম্বারটা নিজের মোবাইলে সেইভ করে নেয়। অতঃপর নিজ রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। বিছানায় বসে ভাবতে থাকল। এখন সে কি ফোন দিবে নাকি রাতে দিবে। নাহ রাতে দিলে যদি আবার ঘুমের ডিস্টার্ব হয়। ঠিক হবে না। এখনি কল দেই। কল দিয়ে বলি ছাদে আসতে। কী ভাগ্য আমার? সবাই হবু জামাইয়ের সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করে। আর আমি দেখা করবো ছাদে তাও একই ফ্ল্যাটের ছাদে। হবু জামাই? এমন ভাবছি কেন আমি? নীলা ভাবে। সেভ অপশন থেকে নাম্বারটা বের করে নীলা কল দেয় আবরারকে। ৪ তলায় আবরার তখন শুয়ে শুয়ে ইমদাদুল হক মিলনের “প্রিয়” উপন্যাসটা পড়ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল অপরিচিত নাম্বার। ফোন রিসিভ করল।
-“হ্যালো! কে বলছেন?”
-“৮ তলা থেকে নীলা বলছি”।
-“কোন নীলা?”
-“যার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে আমিই সে”।
আবরার নিজের বিয়ের কথা শুনে অবাক হলো। বুঝতে পারল তাকে না জানিয়েই তার বাবা মা বিয়ের বন্দোবস্ত করেছে।
-“আচ্ছা বলুন”।
-“আপনি একটু কষ্ট করে ছাদে আসবেন প্লিজ!” নীলার অনুরোধ।
-“ছাদে কেন?” আবরারের জিজ্ঞেস।
-“আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল”।
-“এখনি আসতে হবে?”
-“হ্যাঁ কারণ আরেকটু পর তো সন্ধ্যা হয়ে আসবে”।
-“আচ্ছা আমি আসছি”।
-“আচ্ছা”। বলেই নীলা ফোনটা রেখে দেয়।
৮ তলার উপরেই ছাদ। বিশাল ছাদ। চারপাশে রেলিং। ছাদ থেকে পুরো শহরটা দেখা যায়। পড়ন্ত বিকেল। আকাশ সাদা মেঘে ছেয়ে আছে। ছাদের দক্ষিন দিকে এক কোণে নীল সেলোয়ার কামিজ পড়া এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। আবরার ছাদে এসে এই মেয়েটাকেই দেখল। এই মেয়েটাই কি নীলা? আবরার ভাবল। মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়াল।
-“আপনি নীলা?” আবরারের জিজ্ঞেস।
-“না ভাইয়া, আমি মিতা। নীলা আপুর ছোট বোন”।
-“ও আচ্ছা। আপনার আপুর আসার কথা ছিল”।
-“জ্বী ভাইয়া, কিন্তু আপুর হঠাৎ মাথা ব্যথা শুরু করে, মাইগ্রেন আছে তো তাই”।
-“ও আচ্ছা”।
-“ভাইয়া আপনার প্রিয় রং কী?”
-“হঠাৎ আমার প্রিয় রং?”
-“না, আপু জিজ্ঞেস করতে বলেছিল আমাকে”।
-“নীল”। বলেই আবরার মুচকি হাসল।
-“আপুর প্রিয় রং সাদা”। মিতা বলল। “ঘুমাতে পছন্দ করেন নাকি রাত জাগতে?”
-“রাত জাগতে পছন্দ করি”। আবরার বলল।
-“কী করেন রাত জেগে?” মিতার প্রশ্ন।
-“রাত জেগে সাধারণত বই পড়ি, লেখালিখি করি”। আবরারের উত্তর।
-“বাহ লেখক মানুষ। কিন্তু আপু লেখক মানুষদের পছন্দ করেন না। যারা গান গায় তাদের পছন্দ করে”।
-“তাই নাকি? আমি গানও গাইতে পারি”। বলেই আবরার হেসে ফেললো।
– “বাহ আপনি তো দেখছি অলরাউন্ডার”। মিতাও হেসে ফেললো।
-“লজ্জা দিচ্ছ?” মুচকি হেসে আবরার জিজ্ঞেস করলো।
-“না না কি যে বলেন!”। মিতা মুচকি হেসে নিচের দিকে তাকালো। আবার আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা ভাইয়া আমি আসি, আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো”। বলেই
মিতা চলে যায়। আবরার রেলিং ধরে দূরে তাকিয়ে থাকে। নীলা কি খুব আসুস্থ? ফোন দিব একবার? আবরার ভাবে।
-“এই যে মিস্টার আবরার!”
ডাক শুনে আবরার পিছনে তাকিয়ে দেখে মিতা। কিন্তু ও এভাবে ডাক দিল কেন? আস্ত পাজি মেয়ে তো?
-“আমি মিতা নই, আমিই নীলা”। বলেই নীলা হাসতে থাকে।
আবরার বোকার মত তাকিয়ে থাকে। নীলা হাসতে হাসতে ছাদ থেকে দৌড়ে নিচে নেমে যায়।
আবরার তখনো বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। সূর্য পশ্চিম দিকে অস্ত যাচ্ছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে।
-“বাবা! তুমি ৮ তলার নীলার মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছ?” ফিরোজ সাহেবকে আবরারের জিজ্ঞেস।
-“না তো, বিয়ে ঠিক করিনি কিন্তু বিয়ে নিয়ে কথা হয়েছে। কেন বল তো?
আবরার এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেল। গ্লাসটা রেখে বলল –“মেয়ে তো আজ আমাকে ফোন দিল”।
-“তাই নাকি, কী বলল?”
-“কিছু না। কেমন আছি জিজ্ঞেস করলো”।
-“আমি দেখি আজকে আমি আর তোর মা নীলাদের বাসায় যাব”।
-“কেন?”
-“মেয়েকে দেখতে!”
-“তোর কোন আপত্তি আছে?”
-“আমি যেতে পারি তোমাদের সাথে?” আবরার জিজ্ঞেস করলো।
ফিরোজ সাহেব খুশি হলেন। বললেন, “অবশ্যই চল”।
-“ঠিক আছে”। বলেই আবরার তার ছোট বোনের রুমে চলে যায়।
-“আবরারের মা! ও আবরারের মা!” স্ত্রী লাকি বেগমকে ডাকলো ফিরোজ সাহেব।
-“কি হল?” লাকি বেগম রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
ফিরোজ সাহেবের হাতে পত্রিকা। ওটা রেখে বললেন –“৮ তলায় চলো। নীলা মেয়েটাকে দেখে আসি”।
-“আজই যাবা?”
-“হুম। কাল সারাদিন ব্যস্ত থাকবো”।
-“কয়টায় যাবা?”
-“মাগরিবের পর পরই চলো”।
-“তোমার ছেলে যাবে?” লাকি বেগমের জিজ্ঞেস।
-“ফিরোজ সাহেব চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন। অতঃপর বললেন –“যাবে তো বলল”।
হঠাৎ ৫ তলা থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ এল। এই বাচ্চাটা একটু বেশিই কান্না করে।
-“আপনারা এসেছেন খুবই খুশি হলাম ভাই”। নীলার বাবা ইয়ামিন সাহেব বললেন।
ফিরোজ সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন –“কাল একটু ব্যস্ত থাকবো। তাই ভাবলাম আজই না হয় নীলা মা কে দেখে যাই”।
-“একদম ঠিক করেছেন ভাই”। জাহানারা বেগম বললেন।
-“আবরারের বায়োডাটা দেখেছিলাম আর এখন ওর সাথে সরাসরি কথা বললাম। আমার খুব পছন্দ হয়েছে আবরারকে”। ইয়ামিন সাহেব বললেন। “কী নীলার মা? তুমি কিছু বল?”
-“হ্যাঁ ভাই, আবরারকে আমাদের পছন্দ হয়েছে”। নীলার মা জাহানরা বেগম বললেন।
-“কই মেয়ে কই? মেয়েকে দেখছিনা যে?” আবরারের মা লাকি বেগম বললেন।
-“ভাবি, একটু আমি মেয়েকে নিয়ে আসি”। বলেই জাহানারা বেগম ভিতরে চলে গেলেন।
খানিক বাদে মেয়ে নীলাকে নিয়ে জাহানারা বেগম ফিরে এলেন। নীলা খুব সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি। মুগ্ধ চোখে আবরার তার দিকে কিছুক্ষন পর পর যে তাকাচ্ছিল নীলা তা খেয়াল করল। নীলার সাথে চোখাচোখি হতেই আবরার অন্যদিকে তাকায়।
-“মাশাল্লাহ ভাবি! মেয়ে তো পরীর মত মিষ্টি”। লাকি বেগম বললেন। “মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কী? তুমি কিছু বল?” লাকি বেগম তার স্বামী ফিরোজ সাহেব কে বললেন।
-“নীলার বায়োডাটা আমি দেখেছি। আর সরাসরিও দেখলাম ওকে। আমার কোন আপত্তি নেই”। ফিরোজ সাহেব দৃঢ় কণ্ঠে বললেন।
-“তাহলে বেয়াই সাহেব! শুভ কাজে দেরি কিসের?” বলেই ইয়ামিন সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। তার এই হাসির সাথে তাল মিলাল বাকিরা।
-“ঠিক আছে, আগামী মাসের ১ তারিখ কি বলেন?”হাসি ভরা মুখে ফিরোজ সাহেব বললেন।
-“আচ্ছা, আমি আপনাকে কালকের মধ্যেই তারিখ কনফার্ম করছি”। ইয়ামিন সাহেব বললেন।
-“ঠিক আছে, তাহলে আজ আমরা উঠি। কষ্ট দিয়ে গেলাম”।
-“না,না, কি যে বলেন!”
আবরারের পরিবার ঘর থেকে বেরিয়ে লিফটে প্রবেশ করল। তখনি ইয়ামিন সাহেব ঘরের দরজা আটকে দিলেন।
রাত ১২টা ১০ মিনিট। হঠাৎ আবরারের মোবাইল ভাইব্রেট করে উঠে। মোবাইল অন করে দেখে
নীলার মেসেজ। তাতে লেখা –“জেগে আছেন?” আবরার উত্তরে লিখে –“হুম”।
এরপর মোবাইল বেজে উঠলো। নীলা কল দিয়েছে। আবরার কল রিসিভ করলো।
-“হ্যালো”।
-“হ্যালো আমি মিতা বলছি”।
-“তাই!” আবরার হাসল। আবার বলল, “আমার নাম মিতা, চুলে বাঁধি ফিতা। কানে পরি দুল, ভালোবাসার ফুল, পাশের বাড়ি নীলা, তার সাথে খেলিনা, তার সাথে আড়ি। যাব না তাদের বাড়ি”।
নীলা কথাটা শুনে হো হো শব্দ করে হেসে ফেলে। অতঃপর বলে,”আপনি ভারি মজার মানুষ”।
-“তুমিও কম কিসের, আজকে যেভাবে বোকা বানালে!”
নীলা আবারো হাসে। হাসি থামিয়ে বলে, “আপনার চেহারাটা দেখার মত ছিল”।
-“এভাবে বোকা বানানো ঠিক না”।
-“তাই বুঝি?”
-“হুম”।
-“আপনার সাথে কিছু কথা ছিল, জরুরী”।
-“ঠিক আছে কাল বিকেলে ছাদে আসবো”।
– “না, কাল বিকেলে ভিক্টোরিয়ান্স রেস্টুরেন্টে”। নীলা বলল।
-“আচ্ছা ঠিক আছে”। আদিবের সম্মতি প্রকাশ।
-“ঠিক আছে তাহলে ঘুমান। কাল ঠিক সাড়ে ৪টায়”। নীলা বলল।
-“আচ্ছা। গুড নাইট”।
-“ওকে”। বলেই নীলা কল কেটে দিল।
রবিবার। সকাল গড়িয়ে দুপুর। এরপর বিকেলের সূচনা। বিকেল ৪টা ২০ মিনিট। জম জমাট রানীর দীঘির পাড়। খুব সম্ভবত জিলা স্কুলের মাঠ থেকে ফুটবল খেলে এক দল কিশোর রানীর দীঘির পাড়ের ঘাটে নেমে গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের শরীরে কাঁদা দৃশ্যমান। ঘাটের অপর পাড়ে কিছু মেয়ে ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। করোনার কারণে এখন ভিক্টোরিয়া কলেজ বন্ধ। তাতে কি? কোচিং এর ভাইয়ারা তো ঠিকই তাদের কোচিং সেন্টার খোলা রেখেছে। এক রুমে ৪০ জন, ৫০ জন যে যেভাবে পারে ওভাবে পড়ায়। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। ঠিক ৪ টা ২৫ মিনিটে “ইন্টেক্স ভিক্টোরিয়া” ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে বের হল আবরার। সোজা “গৌরীপুর” ফ্ল্যাট বাড়ি পেরিয়ে ভিক্টোরিয়ান্স রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো। ভিক্টোরিয়ান্স রেস্টুরেন্ট ভিক্টোরিয়া কলেজের গেটের পাশেই অর্থাৎ রানীর দীঘির পাড়েই। ঠিক ৪ টা ৩০ মিনিটে ঘর থেকে বের হয় নীলা। আর তা গৌরীপুর ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে দেখে ফেলে আদিব। আদিব দেখল নীলা ভিক্টোরিয়ান্স রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করছে। দেখা মাত্রই রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
ভিক্টোরিয়ান্স রেস্টুরেন্ট মাঝারি আকারের রেস্টুরেন্ট। খাবারের মান ভালোই। রেস্টুরেন্টের বাম দিকের একটা টেবিলে বসে আছে আবরার আর নীলা। ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে চলে গেল।
-“তোমার কিছু কথা ছিল বলেছিলে”। আবরার বলল।
-“হ্যাঁ, আসলে কিভাবে যে বলি”। নীলা সংকোচ বোধ করলো।
-“বলে ফেল”।
-“আসলে, আমার একটা রিলেশান আছে, আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি”।
-“ও আচ্ছা”। শুনে আবরারের মনটা খারাপ হয়ে গেল। “বল,তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
-“আপনি বাসায় বলে দিন আমাকে বিয়ে করবেন না”। নীলা বলল।
আবরার চুপ হয়ে রইল কিছুক্ষন। অতঃপর বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে বলব। কিন্তু কথাটা তো তুমি আমাকে ছাদেও বলতে পারতে?”
-“না, ভাবলাম এক কাপ কফি খেতে খেতে না আপনাকে সব বলি। এখানকার কফি বেস্ট”।
-“তাই নাকি?”
-“হ্যাঁ”।
ওয়েটার কফি নিয়ে এনে টেবিলে রাখলো।
-“নিন, কফিটা নিন”। নীলা বলল।
আবরার কফির কাপ নিয়ে কফি এক চুমুক খেল।
-“কেমন?” নীলার প্রশ্ন।
-“অসাধারণ”। আবরার বলল।
-“দেখেছেন? বলেছিলাম!”নীলা মৃদু হাসে।
কফি শেষ করে বিল দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হল আবরার আর নীলা।
-“বাসায় যাবেন না?” নীলার জিজ্ঞেস।
-“আমি একটু নিউ মার্কেট যাবো”। আবরার বলল।
-“ঠিক আছে”। বলেই আবরার মাস্ক পড়ে নিউ মার্কেটের উদ্দেশ্য রওনা দিল।
এদিকে পুরো দৃশ্যটাই নিজ চোখে দেখে আদিব। রাগে তার মাথা বিগড়ে যায়।
পরদিন সকাল ৮টা। আবরারের কাঁধে ব্যাগ। ছুটি শেষ। নারায়ণগঞ্জ প্রজেক্টে চলে যাচ্ছে সে।
-“আব্বু আম্মু! আসি”।
-“সাবধানে যাবি”। আবরারের মা বললেন।
-“আচ্ছা”। বলে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে এসে গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়ল আবরার। গৌরীপুর ফ্ল্যাট বাড়ি পেরিয়ে কলেজ গেটের সামনে আসতেই একদল বখাটে তাকে ঘিরে ধরে। তাদের প্রত্যেকের হাতে হকি স্টিক। এদের মধ্যে লম্বা একটা ছেলে আবরারকে ঘুষি মেরে ফেলে দেয়। এরপর একের পর এক হকি স্টিকের আঘাত। রক্তে রঞ্জিত রানীর দীঘির রাস্তা। আশে পাশের মানুষ দেখছে কিন্তু কেউ সাহস করে এগিয়ে আসছে না। কেউ কেউ গোপনে ভিডিও করছে। প্রায় আধা মরা অবস্থায় আবরারকে ফেলে দিয়ে মোটর বাইক করে বখাটেরা চলে যায়। অতঃপর। কি অতঃপর? অতঃপর কি হল? বল?
একটা স্ট্রেচার। অনেক মানুষ। এ্যাম্বুলেন্স। বাবা মায়ের আর্তনাদ। অতঃপর আইসিঊ। স্তব্ধ পৃথিবী। নির্বাক নীলার চোখে অশ্রু। আবরার কি বাঁচবে ??
আদিব সহ সকল বখাটেদের পুলিশ ধরে নিয়েছে। নীলাই ধরিয়ে দিয়েছে। কারণ সে জানত এ কাজ আদিব ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। আসলে ভালোবাসা কোন অপরাধ না। কিন্তু ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে ক্রাইমে জড়িয়ে যাওয়া অপরাধ। একটা সুখবর দিব? কি? বল? বলে ফেল? আবরার সুস্থ আছে।
আজ নীলার বিয়ে। তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে বিয়ে। মানুষটাকে সে যে কখন ভালোবেসে ফেলেছে সে নিজেও জানে না। অপূর্ব মিষ্টি লাগছে। আজ নীলার বিয়ে। শুরু হবে এক নতুন পথ চলা। আবরারের সাথে। নীলার হাত আবরার শক্ত করে ধরবে আর বলবে –“ছেড়ে যাবো না কোন দিন যতদিন এই দেহে আছে প্রাণ”। আজ নীলার বিয়ে। নীলা আবরারের বুকে আজ মাথা রাখবে আর বলবে –“আজীবন আমাকে তোমার করে রেখো। আজ থেকে আমি শুধুই তোমার”। আজ নীলার বিয়ে। আজ দুটি হৃদয় এক হবে। আজ নীলার বিয়ে।
(সমাপ্ত)