একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি । অথচ সুশিক্ষার আলোকেই জাতীয় ও সামাজিক সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান করা সম্ভবপর । কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে কার্যক্ষেত্রে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারিনি শিক্ষা-ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমরা যে শিক্ষা পাচ্ছি তাতে পরিকল্পিতভাবে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ সম্ভবত হচ্ছে না । দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলো খুললেই দেখতে পাই শুধু মুল্যবোধের দারুণ অবক্ষয় সুস্পষ্ঠভাবে দেখা দিয়েছে । মানুষ পূর্বের তুলনায় চিন্তা-চেতনায়, ধ্যান-ধারণায়, দক্ষতা, মেধা, পরিশ্রম শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও প্রযুক্তিতে উন্নত হলেও আজকাল মার্জিত ও উচিৎসম্পন্ন, উদার, সচেতন ও মুক্তবুদ্ধির প্রযুক্তিতে উন্নত হলেও আজকাল মার্জিত ও রুচিসম্পন্ন, উদার সচেতন ও মুক্তিবুদ্ধির লোকের সন্ধান পাওয়া দুস্কর । কেননা আমরা বর্তমান যুগে শুধু নিজেকে চিনি । সক্রেটিসও তাই বলেছেন, আগে নিজেকে জান । কিন্তু আমরা মনের দিক দিয়ে কতখানী উদার হতে পেরেছি ? আমরা এতো বেশি আত্নকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, লোভী, নির্দয়, পরস্পরের প্রতি আস্থাহীন ও অপরাধপ্রবন হয়ে পড়েছি তুলানাহীন । সর্বক্ষেত্রে পরচর্চা ও সমালোচনা করেই চলেছি । ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক কর্মকান্ড, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে তাঁর উপলদ্ধি সহজ হবে ।
জীবনের জন্য আসল শিক্ষা অর্জন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি । কাজেই বেঁচে থাকতে হলে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে আমাদের অবশ্যই এসব মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ নির্ণয় করতে হবে এবং প্রতিকারের প্রকৃত উপায় বের করতে হবে । আজ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তারা তাদের শিক্ষাকে উন্নত করে দেশেওকে অনেক দূর অগ্রসর করেছে । তাদেরকে দেখেও আমরা শিক্ষা নিতে পারছি না । পাশ্চাতের কথা বাদই দিলাম-ভারত, চীন, কোরিয়া, জাপানের কথা উল্লেখ করে বলতে চাই, তাদের শিক্ষা মেধা, পরিশ্রম, দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তারা একবিংশ শতাব্দিতে বানিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায় । তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এখনও বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ২২০ ডলারের উপরে নয় । এর প্রধান কারণ হিসেবে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অশিক্ষা, দারিদ্র এগুলোই বেশি দায়ী । প্রসঙ্গক্রমে বিশ্বের ক’টি ছোট দেশের নাম যেমন-সিঙ্গাপুর, দুবাই, হংকং ও তাইওয়ানের কথা উল্লেখ করতে চাই । সিঙ্গাপুর ছিল নিছক জেলের ও বস্তির জায়গা । তাদের জীবন অনেক কষ্টের ছিলো । বর্তমানে এদেশ প্রকৃতিক সম্পদে ও স্বয়ং সম্পূর্ণ বাণীজ্যিক শহর হিসেবে পরিচিত ।
দুবাই ছিল আরব আমিরাতের একটি দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য । ২৫/৩০ বছর পূর্বে দেশটি একটি পল্লী এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিলো । অথচ সেখানে আজ সাড়া এশিয়ার-মধ্যে এবং ইউরোপের মার্কেটে পরিণত হয়েছে । হংকং এখন সেরা বাণীজ্য- নগর হিসেবে পরিচিত । তাইওয়ান চীন থেকে মাত্র ৫০ মাইল দূরে অবস্থিত । ১৯৪৯ সালের আগে দু’টোই গণচীন ভূ-খন্ডের অংশে ছিলো । এরপর ১৯৪৯ সালে জেনারেল জিয়াং ২০ লাখ লোক নিয়ে একটি দ্বীপে গিয়ে ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন । এরপর ৪৭ বছরে তাইওয়ান হয়েছে শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিখ্যাত । এমনকি ভিয়েতনাম তাঁর অর্থনীতির স্থবিরতা কাটিয়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রে গতিবেগ সঞ্চার করতে শুরু করেছে । অতি স্বল্প কথায় বলার চেষ্টা করছি তারা আমাদের তুলনায় অনেক ছোট দেশ অথচ তাদের স্বয়ং সম্পূর্ণতা ও সমৃদ্ধির ফলে তাদের মাথা পিছু আয়, প্রবৃদ্ধির হাড় কোথায় চলে গেছে । আমরা অনেক নিম্নসীমায় পড়ে আছে । জনসংখ্যা সমস্যা আমাদের অনেক বেশি । বাংলাদেশের একটি মারাত্নক সমস্যা । লোকসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি । শিক্ষার হাড় ৭২.৯ শতাংশ হলেও অর্ধেকের ব্বেশি দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে ।
২০০০ সালের মধ্যে ‘সবার জন্যে শিক্ষা ও সুসাস্থের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এখনো দেশে অনেক যায়গায় প্রথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা সম্ভপর হয়নি । চিকিৎসার ক্ষেত্রে একই করুণ অবস্থা । দেশের হাসপাতালগুলোর নাজুক অবস্থা । তারপর রয়েছে খাদ্য, বন্যা, খরা, পানি ও সার সংকট । এরপরও রয়েছে দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ । এতে করে দেশের প্রচুর পরিমাণ, অর্থ খরচ করতে হয় । এমনকি খাদ্যও আমদানি করতে হচ্ছে বিদেশ থেকে । তাঁর মানুশের জীবনের জন্য অপরিহার্য মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে হবে-শিক্ষা, স্বাস্থ্য,বাসস্থান, চিকিৎসার ক্ষেত্রে । কারণ জীবন হচ্ছে মানুশের কাছে সবচেয়ে প্রিয় । জীবনের অর্থ কবি সাহিত্যকগণ এক একভাবে লিলিপিবদ্ধ করে গেছেন । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে’ । সেক্সপিয়ার বলেছেন, জীবন মানেই অনিশ্চিতি ভ্রমণ । সক্রেটিস বলেছেন, মৃত্যুর চেয়ে কঠিন হচ্ছে জীবন । কেনোনা দুঃখ, কষ্ট, বিপদ-আপদ কেবল জীবনেই ভোগ করতে হয়, মৃত্যু তা থেকে মুক্তি দেয় । যাই হোক জীবন কারো কাছে রং তামাসা, কারো কাছে অনেক মাহাকাব্য, আবার কারো কাছে দুঃখ, বেদনা যন্ত্রণা ইত্যাদি । আবার কারো কাছে সুখময়। মানুষের কাছে আজকের বাস্তবতা হচ্ছে জীব্বন মানে উন্নয়ন নিজের অবস্থার উন্নতি । সেদিকে লক্ষ্য রেখে মানুশ জীব্বনকে নতুন করে শুরু করতে যাচ্ছে । তাঁর জলন্ত প্রমাণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের শোচনীয় অবস্থা ।
পরিশেষে বলতে চাই, যে জাতি যতো শিক্ষিত এবং যে সমাজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যতো বেশি অগ্রসর সে সমাজ ততো বেশি উন্নত । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি ব্যতিত দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভবপর নয় । বর্তমান যুগে উন্নতি ও সমৃদ্ধি হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রসুক্তির উপর নির্ভরশীল । যারা যতো বিজ্ঞান্সম্মত ও প্রযুক্তিতে উন্নত, তারা অর্থনৈতিকভাবেও ততো সমৃদ্ধ । বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো যখন উন্নতির মুখ দেখছে, তখন আমরা বসে না থেকে কিভাব্বে পারস্পারিক সংঘাত ও রক্তপাত এড়িয়ে দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেয়া যায় সে ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি প্রয়োজন । কারণ দেশের সবাই শান্তি চায়, সুখ চায় । জীবনকে ভালবাসে বলেই মানুষ এতো দুঃখ, কষ্ট ও সংগ্রামের মধ্যেও মানুষ বেঁচে থাকতে চায় ।
(মোহাম্মদ শামসুল কবির )