একজন উপস্থাপক শুধু তার বাচনভঙ্গি ও কন্ঠস্বর দ্বারা সহজেই নিজের উপস্থাপন দক্ষতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি জটিল বৈশিষ্ট্য হলো কোনো সময় উপস্থাপককে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় যে যখন তাকে উপস্থাপনার জন্য উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য দুইটির বাইরে আরও কিছু অতিরিক্ত দক্ষতা দেখানোর প্রয়োজন হতে পারে। ধরা যাক কোনো উপস্থাপনা সভায় যদি শ্রোতাদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি থেকে থাকে যারা প্রতিবন্ধী (মূক ও বধির) অথচ বিশেষ পদ্ধতিতে ঐ উপস্থাপনা সভায় অংশ নেবার যোগ্যতা অর্জন করেছে, সেক্ষেত্রে উপস্থাপকের এই জটিল দক্ষতা ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও সাধারণভাবে উপস্থাপনাকে প্রানবন্ত করার জন্য নিজের ইশারা – ইঙ্গিত মুখভঙ্গি, দৃষ্টির ব্যবহার এবং শারীরিক অবস্থানকেও অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়। একজন দক্ষ ও পেশাদার উপস্থাপক তার উপস্থাপনাকে এমনভাবে সাজাবে যেন সে তার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে উপস্থাপনার বক্তব্যের সাথে একীভূত করতে সক্ষম হয়। অবশ্যই এর জন্য সুনির্দিষ্ট অভ্যাস ও চর্চা প্রয়োজন যা উপস্থাপনার সময় সমগ্র অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে তার উপস্থাপনার পক্ষে স্বতস্ফুর্ত সহায়ক হিসেবে ব্যবহার দক্ষতা গড়ে তোলে। যখন উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যক্তি উপস্থাপক হিসেবে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা পাবে, তখনই উপস্থাপনাটি প্রাণবন্ত হবে এবং তা সাধারণ শ্রোতা বা প্রতিবন্ধী সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। উপস্থাপন দক্ষতায় শারীরিক ইঙ্গিত ও মুখভঙ্গির স্বতঃস্ফূর্ত প্রণোদনার জন্য উপস্থাপনার সময় নিম্নোক্ত কৌশলগুলো আয়ত্ব করা উচিত।
শ্রোতার সঙ্গে দৃষ্টি সংযোগ ঘটানো : অনেক উপস্থাপকের একটি সাধারণ দুর্বলতা হলো উপস্থাপনার সময় আত্মবিশ্বাসের অভাবকে আড়াল করতে সরাসরি শ্রোতার চোখে চোখ রাখা থেকে বিরত থাকা। এক্ষেত্রে উপস্থাপক তার পুরো উপস্থাপনার সময় ব্যয় করে শ্রোতার পা, ঘাড়, পেছন কিংবা পার্শ্বদেশে দৃষ্টি রেখে যেন সে নিজের সাথে কথা বলে চলেছে। সর্বদা উপস্থাপনাকে প্রাণবন্ত করার জন্য উপস্থাপকের চোখের উপর সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এমনভাবে উপস্থাপনা করতে হবে যেন প্রতিটি শ্রোতা ঐ উপস্থাপনকে তাকে উদ্দেশ্য করে করা হচ্ছে বলে মনে করতে সক্ষম হয়। উপস্থাপক যদি তার দর্শক শ্রোতাদের বাসের পাশের সিটে বসা অজানা ব্যক্তির ন্যায় জ্ঞান করে উপস্থাপনা করে চলে তবে শ্রোতার পক্ষেও ঐ উপস্থাপনায় মন সংযোগ কঠিন হয়ে ওঠে।
স্বতঃস্ফূর্ততা এবং উৎফুল্লতা বজায় রাখা : উপস্থাপনার পুরো সময় জুড়ে একজন উপস্থাপককে তার তরতাজা মনোভাব বজায় রাখতে হবে। উপস্থাপনায় নিজের স্বতঃস্ফূর্ততা বা এনার্জি লেভেলকে কখনো এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না যা দেখে শ্রোতার কাছে অন্য অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে যে বক্তা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এজন্য পুরো উপস্থাপনে নিজের ইশারা – ইঙ্গিত, দৃষ্টি, মুখভঙ্গি স্বতঃস্ফূর্ত এমন হতে হবে যে বক্তা তার উপস্থাপনাকে প্রতি মুহুর্তে উপভোগ করছে এবং সে তার উপভোগ্য অনুভূতিটি শ্রোতার মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
উপস্থাপনের সময় হাঁটা চলা করা : একজন বক্তা যদি একস্থানে স্থির বা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে উপস্থাপনা করে চলে তবে সেটি অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। যদিও ক্ষেত্র বিশেষে স্থানের সীমাবদ্ধতা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে বাধ্য করে। তবে উপস্থাপকের যদি সুযোগ থাকে স্টেজ কিংবা শ্রোতাদের মাঝে চলাফেরা করার, তবে সে এই টেকনিককে তার উপস্থাপনাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সহজেই ব্যবহার করতে পারে। একজন শ্রোতা তার বক্তব্যের সাথে তাল রেখে যখন স্টেজ কিংবা শ্রোতামন্ডলীকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রদক্ষিণ করতে সক্ষম হয় তখন শ্রোতারা তার উপস্থাপনার ডাইনামিক দিকটিকে উপভোগ করে এবং উপস্থাপনা যথার্থই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
বক্তব্যের সাথে হাতের ব্যবহার : পেশাদার উপস্থাপক তার বক্তব্যের সাথে নিজের দুই হাতকে নাটকীয় ভাবে ব্যবহার করে উপস্থাপনাকে প্রাণবন্ত করে তুলতে সক্ষম হয়। বক্তব্যের সাথে তাল রেখে দুই হাতের ব্যবহার আসলে একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রণোদনা যা দীর্ঘদিন পেশাগত উপস্থাপনার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব হয়ে থাকে।
মুখমণ্ডলীকে স্বাভাবিক রাখা : মানুষের সকল আবেগ তার মুখাবয়বে প্রতিচ্ছবি ফেলে। সুতরাং উপস্থাপনার সময় অপ্রয়োজনে মুখমণ্ডলে কোনো বিরক্তি, রাগ, বিষাদ, কিংবা অতি খুশির ছাপ ধরে রাখা যাবে না। মুখমণ্ডলকে স্বাভাবিক রেখে উপস্থাপনার প্রয়োজনে মুখমন্ডলে প্রয়োজনীয় আবেগের ছাপ ফুটিয়ে তুলতে হবে যা শ্রোতার আবেগকে প্রয়োজনীয় ভাবে সংক্রমিত করতে পারে। অনেকের উপস্থাপনার সময় নানা বদভ্যাস দেখা যায় যেমন জিহবা দিয়ে বারবার ঠোঁট চাটা, বারবার গিলা বা ভ্র বা চোখকে অপ্রয়োজনে সংকুচিত করা প্রভৃতি। ভালো উপস্থাপককে এই সব বদভ্যাস যত্নের সাথে পরিত্যাগ করতে হবে।