আমি আর ইমন কলেজের বারান্দা দিয়ে হাঁটছি। আজ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের বড় ভাইদের সর্বশেষ ক্লাস। আজকের পর তাদের আর অফিশিয়ালি কলেজে কোন ক্লাস হবে না। সবাই আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত। একে অপরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করছে। সবাই সবাইকে অভিবাদন জানাচ্ছে। বন্ধুরা বন্ধুদের সাথে কোলাকুলি করছে। সবাই যার যার টি-শার্টে তাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে সাইন নিচ্ছে।
শিক্ষকরাও আনন্দ সহকারে সবার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও করছে এবং সাইন করছে। কারও মনে আজ বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। সবাই খুশি এবং যার যার কাজে ব্যস্ত। আমরা দুইজন প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। বড় ভাইদের কার্যকলাপ শুধু দেখছিলাম। সেদিন দুপুরে টিফিনের সময় হঠাৎ খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হল বজ্র সহকারে। কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। সকালের দিকটা ভালোই রৌদ্রদীপ্ত ছিল। আকাশে মেঘের কোন নাম গন্ধ ছিল না।
যাইহোক টিফিন করা শেষে আমি আর এমন কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। এমন সময় দ্বিতীয় বর্ষের একজন বড় ভাই দৌড়ে আসছিল তার পছন্দের দুজন শিক্ষকের কাছ থেকে তার টি-শার্টে সাইন নেওয়ার জন্য। ঘটনাটি ঘটলো আমাদের চোখের সামনে। সে দৌড়ে কাছে আসতেই হঠাৎ করে থেমে গেল। আমরা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
কলেজের স্যার দুটো তার সামনে এগিয়ে আসতেই দেখলাম ছেলেটির চোখ, নাক, কান এবং মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। স্যার দুটো তাড়াতাড়ি বাকি ছাত্রদেরকে ডাকলো এবং ওই ছেলেটিকে ধরাধরি করে পাশেই থাকা একটি বেঞ্চে শুইয়ে দিল। আমরা সবাই দৃশ্যটি দেখে অবাক হয়ে পড়লাম। কিছুই বুঝতে পারলাম না যে কি হচ্ছিল। তার বন্ধুরাও বুঝতে পারছিল না যে কি হচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগেই ছেলেটির ছিল সম্পূর্ণ সুস্থ।
দুজন স্যার নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ছাত্রদেরকে বলল, চিন্তার কোন কারণ নেই, ছেলেটি আগে থেকেই অসুস্থ ছিল। যার কারনে এরকম হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি আপনা আপনি সুস্থ হয়ে গেল। আমরা এবং তার বন্ধুরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি ইমনকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে ঘটনা কি! সেও তেমন কিছুই বলতে পারলোনা। সেদিন আমরা মোটামুটি আশ্চর্য এই কলেজ থেকে ফিরে আসলাম । আমি কলেজের বাইরে একটি হোস্টেলে থাকতাম। সেখানে আমাদের কলেজের অসংখ্য ছাত্র থাকতে। ঘটনাটি কিছু বন্ধুর সাথে শেয়ার করলাম। পরে একজন বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারলাম আমাদের কলেজের ইতিহাস।
আমাদের কলেজ থেকে প্রায় প্রতিবছরই পিকনিকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো। বেশ কয়েক বছর আগে ঠিক একইভাবে কলেজ কর্তৃপক্ষ পিকনিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করল। সবাই পিকনিকে যেতে চাইতো না। একটি ছেলের খুব শখ ছিল সে একটি বাই সাইকেল কিনবে। কিন্তু মা-বাবা তাকে কিনে দিতে চাইতো না। তাই সে পরিকল্পনা করেছিল যে সে পিকনিকে যাওয়ার টাকা বাঁচিয়ে সাইকেল কিনবে। বাড়ি গিয়ে সে তার মা বাবাকে বলব যে বন্ধুদের সাথে সেও পিকনিকে যাবে। মা বাবাকে রাজি করাল সে। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে একটি সাইকেল কিনে ফেলল। পিকনিকে যায়নি সে। অতি শীঘ্রই বাসায় এই ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে গেল। কলেজ কর্তৃপক্ষের কানেও কথাটি পৌঁছেছিল।
এই ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে তার মা বাবার সাথে মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল। পুরো ঘটনাটি স্পষ্ট নয়। আমি বুঝিনা আমরা ছোটখাটো বিষয় কে অনেক বড় করে ফেলি। ছেলেটি একদিন হঠাৎ করে কলেজের ছাদে গিয়ে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। সেই থেকে কলেজ এর ছাদ সবার জন্য বন্ধ ছিল। কোন ছাত্র ছাদে যেতে পারত না। সমস্যা শুরু হয় এরপর থেকে। কলেজ ছুটি হওয়ার পর অনেকেই যারা কলেজের বারান্দা দিয়ে হাত অথবা টয়লেটের আশেপাশে তারা প্রায়ই ওই ছেলেটির উপস্থিতি টের পেত। কেউ তেমন ভালো করে বুঝতে পারত না।
আস্তে আস্তে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। তাই যারা পরবর্তীতে উপস্থিতি টের পেত তারা বুঝে উঠতে পারতোনা যে কি হচ্ছে। হয়তো সেই বড় ভাইও ওই ছেলেটিকে দেখতে পেয়েছিল। কারণ যখন সে সুস্থ হয়ে তার বন্ধুদের এবং শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছিল সে বলেছিল যে তার কিছুই মনে নেই যে একটু আগে কি হয়েছে।
আমাদের চারপাশে এরকম অনেক ঘটনাই ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা দিতে আমরা সক্ষম হই না। এটা ছিল আমার চোখের সামনে দেখা এরকম একটি ঘটনা।