“হায় খোদা!” বলে একরকম চিৎকার করে উঠলাম। টেবিলের উপর তাকে রাখা ঘড়িতে আটটা বাজে। মনে হয় দু’এক মিনিট কমবেশি হবে। ঘড়ির বামপাশের অংশে নৌকাকৃতি ফ্রেমে বরফে ঢাকা পাহাড় আর তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নীল সমুদ্রের ঢেউয়ের ছবি রয়েছে। বাস্তবে মনোরোম দৃশ্য হলেও এই মূহুর্তে সেটা দেখে আমার শুধু বিরক্তিই বাড়ছে। আমার রুমমেট খুব খোঁজ করে বড় সখে আমার জন্যে কিনেছিল। কিন্ত যতবারই আমি ঘড়িতে সকাল আটটা দেখি প্রতিবারই আমার ঘড়ি আর ছবিটি আলাদা করতে মন চায়। সাড়ে আটটায় বিখ্যাত স্যার মশায়ের ক্লাস। ক্লাসে ঢোকার টাইম মহান স্যার আবার সেকেন্ডে হিসাব করে থাকেন। কাজেই আমার তৈরি হবার সময় মাত্র দশ মিনিট।
ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালাম। এখাতে চিরুনি আর এক হাতে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলি(এখন এর নতুন নাম গ্লো এ্যান্ড লাভলি) এর খানিকটা নিয়ে আমি হয়ে গেলাম সব্যসাচী। হিজাবটা টান মেরে মাথায় তুলে একই জায়গায় গুনে গুনে ৪টা পিন গুজে নিলাম, আর গুনগুন করে গান জুড়ে দিলাম, “যেতে যেতে পথে…” অর্থাৎ যেতে যেতে পিনগুলোকে যথাসম্ভব ঠিক জায়গায় গুজে নেয়া যাবে। এক হাতে বয়্যাম থেকে দুটো বিস্কুট মুখে পুরে নিলাম, অন্য হাতে মোবাইল আর পার্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরোবার মুখে বিস্কুটের বয়্যামটার মুখ কোনরকমে লাগিয়ে হাটা দিলাম, দরজা থেকে আবার ফিরে এসে পানির বোতল আর রুমের চাবিটা হাতে বাধিয়ে চললাম। আড়চোখে ঘড়িতে দেখলাম “আটটা একুশ”।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবলাম, “নাহ!, এবারে ঘড়ি আর ফ্রেমটা রুমে এসেই আলাদা করেই দেব”। নিচতলায় নেমে জানালা লক্ষ্য করে রুমমেটকে একটা হাঁক দিলাম, “রুমমেট, আমার বিস্কুটের বয়্যামটায় একটা টাইট দিও”। উপর থেকে উত্তর এল “অকা(ওকে এর বিবর্তিত রুপ) আপু”।
মহান সৃষ্টিকর্তার রহমতে ভ্যানের চতুর্থ এবং শেষ যাত্রী আমি। নিজেকে একটা বাহবা দিতে মন চাইছে। কিন্তু উপায় নাই, আমি বাদে বাকি তিন জন আমার ফ্যাকাল্টি ভবনের উলটো দিকের দিকের যাত্রী। কাজেই কমপক্ষে দুই মিনিটের একটা দেরি কপালে রয়েছে। অরা যখন নামলো, আমার হাতের ঘড়ি তখন বলছে, “আটটা বাইশ”। মুখে একটূ হাসি নিয়ে তাকাতেই চোখের সামনে সরিষা ফুল দেখার মত করে এক শত টাকার নোট দেখলাম।
“খালা সকাল বেলা, কেবলই আইছি, ভাংতি নাই।” একগাল তৃপ্তির হাসি নিয়ে ভ্যানওয়ালা মামা ওয় তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলল। সাথে সাথেই একজন দৌড়ে ছুটে গেল কিছুদুরের ফটোকপি মামার দোকানে ভাংতি করে আনতে। ছুটের উপর থাকায় মিনিটের রাস্তা সে আধা মিনিটে গেল। মেয়েটির মামার হাতে ভাড়ার পনের টাকা দেবার সময় মামার মুড এত ভাল কেন সেটা ভেবে আর এক দফা বিরক্তি মনে মনে প্রকাশ করে নিলাম।
ভ্যান নব্বই শতাংশ থামতেই লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে, ভ্যানের উপরই পাঁচ টাকার একটা চকচকে কয়েন রেখে ছুটলাম চার তলার উদ্দেশ্যে। চার তলায় উঠে আমার দম যায় যায়। হালকা উবু হয়ে হাত দিয়ে পায়ের উপর ভর করে কোনরকমে দমটা মানিয়ে চারশ আঠারো নং রুমের দিকে তাকাতেই আমার চিরচেনা সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে আমি হতাশ হলা নাকি খুশি হলাম, বুঝলাম না।
আমার আগেই পৌছে যাওয়া আরো তিনজনকে ক্লাসে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়নি। আজকের মত আমরা চারজন মহান ক্লাসটি পেলাম নাহ। ঘড়ি বলল, “ আটটা বত্রিশ”।
সকালে চা টা খাওয়া হয়নি। দিনের মধ্যে বার পাঁচেক চা না হলে কেমন জানি পেট খালি খালি লাগে। তাই আর কিছু না ভেবে হাটা দিলাম ক্যাফেটেরিয়ার দিকে। ক্যাফের দরজার বাইরে টিউবও্য়েল থেকে পানি নিচ্ছিল রাজু মামা।
“মামা, এক কাপ চা, সাথে দুইটা টি-ব্যাগ, চিনি ছাড়া”, বাইরে থেকেই অর্ডার করে দিলাম। বেশিরভাগ সবায় ক্লাসে, তাই কিছটা ফাঁকা এই সময়টা। ডানের এক টেবিলে দুজন বেশ উচ্চশ্বরে আক্ষেপ করছে, তারাও আমার মত ক্লাস মিস করছে। “মামা, ডাল দিলানা এখনও?”, বলে একটা ছেলে চিৎকার করছে। চা বানানো চলছে তুমুল দমে, সেটা পঁচিশ টাকা দামের কাচের গ্লাসের সাথে দশ টাকার চামচের টুংটান সজোড় আয়োয়াজ জানান দিচ্ছে। সিঙ্গারা আর পুড়ির একটা সুগন্ধ আসছে রানান্র পাশ থেকে।
একটা একদম ফাঁকা টাবিলের দিকে গেলাম। পাশের চেয়ারে ব্যাগটা বিরক্তি নিয়ে রাখলাম, ক্লাসটা ধরতে পারলামনা, কিন্তু এক কেজি একশ’ গ্রাম বইটা ঠিকই সারাদিন বয়ে বেড়াতে হবে। আনমনে আমার ঘড়ি আমাকে জানান দিল, “আটটা সাতচল্লিশ”। দাঁতে দাতঁ চেপে রাগটা গিলে প্রকাশের মুহুর্তে চা চলে এল, চায়ের রঙ দেখে দাঁতের ফাঁক দিয়ে সকাল থেকে সব বিরক্তির অবসান করে হাসি বেড়িয়ে এল।
কাপটা হাতে নিয়ে এক চুমুক দিতে দিতে পাশের চেয়ারটায় বসলাম, চায়ের আর এক চুমুক। কিন্তু মুখে চায়ের গরম অনুভূত হলেও হঠাৎ পশ্চাৎদেশে ঠান্ডা অনুভূত হল।
“কেমনটা লাগে। চেয়ারে ক্যামনে এমন পানি থাকতে পারে! পেছনটা পুরা ভেজা। লোকে দেখলে কি বলবে!!!” শোকে, আতঙ্কে আমার মুখ থেকে আর কিছু বের হলনা। চেয়ার ত্থেকে উঠে, একটু ঘুরে কাপটা রেখে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করছি। হুট করে দ্রুততার সাথে এক ছেলে এসে সেই ভেজা চেয়ারে বসে পড়ল, যদিও চেয়ারটা এখন আর ভেজা নেই।
আমার চোখের মাত্র একটি পলক পড়েছে, ছেলেটি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমারই চায়ের কাপে, আমারই মুখ লাগানো পাশ থেকে সরাৎ সরাৎ শব্দে পরপর চুমুক দিতে লাগলো।
কতক্ষন কেটে গেল জানিনা। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি, আমার ঘোর ভাংলো অই ছেলেরই ডাকে।
“হ্যালো আপু, কিছু বলবেন?” চায়ের কাপ টেবিলে রেখে, আমার মুখের সামনে হাত নেড়ে ছেলেটি বলল। আমি শুধু মাথা নেড়ে “না” প্রকাশ করলাম। ব্যাগটা কোলে নিয়ে ব্যাগ রাখা চেয়ারে বসে পড়লাম। টেবিলের মুখোমুখি দু’পাশে আমি আর অচেনা ছেলে।
“আসলে আপনাকে দোষ দেইনা, এমন ঘটনা আগেও আমার সাথে ঘটেছে, কেন জানি মেয়েরা আমার দিক থেকে নজড় সরাতেই পারেনা।” মোটামুটি বিশটা দাঁত বের করে দিয়ে ছেলেটি হাস্তে হাস্তে বলতে লাগলো, সেই মুহুর্তে দু’টো সিঙ্গারা আর এক কাপ চা নিয়ে রাজু মামা আমার আর ছেলেটির সামনে টাবিলে রাখলো, আমি একভাবে তাকিয়ে আছি ছেলেটির দিকে। এবারে ছেলেটি চা মুখে নিয়ে, দু’বার আমার দিকে তাকাল, তারপর বিষম খেল। মুখে হাত দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে খকখক করে কাশছে, আমার দৃষ্টি এখনও তারই দিকে।
থতমত খেয়ে বলল, “আহ, আমি আসলে আমার চা ভেবে আপনার চা’টা না বুঝেই আমার মনে করে খেয়ে নিয়েছি, আপনি আমার চা টা নিন না!” বিনয়ের সাথে কেবল এনে দেয়া চা টা আমার দিকে এগিয়ে দিল।
“বিলটা কে দেবে?” আমার এই কথায় মনে হয় ছেলেটির গর্ব খর্ব হয়ে গেল। আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে, একটা ঢোক গিলে নিয়ে বলল, “অবশ্যই আমি, আমিই দেব, আপনি আরো কিছু খাবেনকি??”, বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করল। আমি কিছু না বলে চায়ে চুমুক দিলাম। কাকতালীয়ভাবে আমার আর তার চা একই, চিনি ছাড়া, দু’টো টি-ব্যাগ।
চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ তুলতেই দেখি আমাকে আড় চোখে দেখছে ছেলেটি। কোন ভনিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলাম, “যা বলার বলে ফেলুন”। আর এক দফা বিষম খেলো বেচারা। এবারে মনে হল, ছোট করে ছাঁটা ঘন চুল, শ্যামলা গায়ের রঙ আর খাড়া নাকের অধিকারী এই ছেলেটাড় চোখে অদ্ভুত এক মায়া জড়ানো রয়েছে। কিছুক্ষণের মদ্ধেই মনে হল, ক্যাফেটেরিয়াতে শুধু আমি, অচেনা ছেলে আর রাজু মামা রয়েছে।
ছেলেটি বিষম সামলে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
দু’জন দু’জনকে কিছু বলতে চাইছি, পাশ থেকে রাজ মামা বলছে, “মামা, আর কিছু দেব?” “খালা, বিলটা কে দেবে?”
“কিরে, চা টা খেয়ে নে, আর কত দেরি করে উঠবি? ঠান্ডা হয়ে গেলতো!” অচেনা ছেলেটির গলা এখন মেয়েদের মত শোনাচ্ছে কেন? না না, মেয়ে নয়, আমার মায়ের মত…
চোখ খুলতেই দেখি মা টেবিলে চা রেখে গেছেন। টলতে টলতে ঊঠে চেয়ারে বসে পা দু’টো টেবিলে তুলে দিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিলাম। আট মাস হয়ে গেছে, ক্যাম্পাস বন্ধ। কিন্তু স্বপ্নে আমি তাকে দেখেছি। ভাবতে ভাবতে চায়ের দিকে তাকালাম।
অদ্ভুতভাবে চায়ের রঙ সেই চায়ের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে।