অনেক বছর আগের কথা। এক গ্রামে বাস করত অনেকগুলো শেয়াল। রাত হলেও বের হতো শিকারে। কারো বাড়ির হাস তো কারো বাড়ির মুরগী। খুব ভালো ভাবেই চলে যেত এদের জীবন। একবার সেই গ্রামে দুর্ভিক্ষ আসলো। কারো বাড়িতেই হাস, মুরগী, গরু, ছাগল কিছুই নেই। থাকবেই বা কিভাবে? গ্রামের লোকেরাই তো না খেতে পে়য়ে মারা যাচ্ছে। গ্রামের মানুষের অবস্থা খুব খারাপ। শেয়ালদের খাবার আর মেলে না। শেয়ালদের মধ্যে একজনের নাম শনি। একদিন সঙ্গী সাথীদের কাউকে কিছু না বলে সেই গ্রাম ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেল।
সেখানে সে দেখল খাবার-দাবারের কোনা অভাব নেই। লােকজন হেসে-খেলে দিন কাটাচ্ছে। রাত হতেই সুযােগ বুঝে সে পথের পাশের একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ল । দরজা টা খোলাই ছিল। শনি ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক উকিঝুঁকি মেরে দেখল। দেখল বাড়িটা একটু ফাকা ফাকাই আছে। সাহস করে গোয়াল ঘরে ঢুকে গেল।
সেখানে দেখলো একদিকে গরু একদিনে ছাগল আর এক কোনায় কয়েকটা মুরগী বাধা। তারপর আর কী! অনেক দিন পরে পেট ভরে ভালােমন্দ খেয়ে মুখ চাটতে চাটতে বেরিয়ে এল। রাস্তায় বেরিয়ে আসতেই পড়ল এলাকার শেয়ালের দলের মুখে।তারা জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগল। । বেচারি একাই একজন এতগুলা শেয়ালের সঙ্গে পারবে কিভাবে? সে পালানোর আগেই শেয়ালের দল তাকে আক্রমণ করলো। আঁচড় কামড় খেতে খেতে তার অবস্থা নাস্তানাবুদ। কোনো মতে লেজ গুটিয়ে দৌডে একটা ভাঙা ঘরে ঢুকে প্রাণ বাঁচাল।
দেখা গেল সেই দেশের বউ-ঝিয়েরা তেমন সাবধানী নয়। কুকুর-শেয়ালের দিকে খুব একটা খেয়াল রাখে না। গোয়ালে গরু-ছাগল,হাস-মুরগী আছেও তাদের অঢেল। কিন্তু এতো কিছু থাকলে কী হবে। খাবার জুটলেও দু এক দিন পর পর শনিকে এলাকার শেয়ালদের পাল্লায় পড়ে নাস্তানাবুদ হতে হয়। কপালে জোটে শুধু আঁচড় ও কামড়। মাঝো মাঝে এলাকার কুকুর গুলাও তাড়া করে। মানে বিষয়টা এমন হয়ে গেছে যে খাবার দাবারের মাথে আঁচড় আর কামর পুরাই ফ্রি। বরং গুনলে দেখা যাবে যে কয়টা মুরগী ধরেছে তার চেয়ে বেশি আচড় আছে তার গায়ে। এভাবে আর পারা যায় না।
শেষ কিনা জাত-ভাইদের হাতেই তাকে মার খেতে হয়। শনি একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। তার সারা শরীর ব্যথা। এখানে ঘা, ওখানে রক্তের দাগ। শেষমেশ একদিন ভালো খাবারের নিকুচি করি বলে সেই দেশ ছেড়ে আবার নিজের দেশে ফিরে যেতে চাইল। সে ভাবল, দুর্ভিক্ষ হােক আর যাই হােক। নিজের দেশে নির্ভয়ে থাকাই অনেক ভালাে। নিজের দেশের জাত-ভাইয়েরা সবাই তাে তাকে চেনে, জানে। অন্তত রাত্রে বেলা তাে আর তেড়ে কামড়াতে আসবে না? আর তেমন হলেও কেউ না কেউ তার দলে থাকবেই, তার পক্ষ নেবেই। এতোকিছু ভেবে একদিন রাতে সে নিজের দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েই দিলো।
শনিকে ফিরে আসতে দেখে পুরনো সাথিদের মধ্যে যারা বেঁচেছিল তারা ছুটে তাকে দেখতে এল। সে বেঁচে আছে জেনে সবাই খুশিতে চিৎকার করতে লাগলো। শনিও মুখ তুলে ওদের সঙ্গে প্রাণ খুলে চিৎকার করল। বুকটা হালকা হয়ে গেল। এত দিনে বুঝতে পারল স্বাধীনতার অর্থ কী!
তারপর সঙ্গীরা জানতে চাইল নতুন দেশটা কেমন, কত দূরে। আর খাবার-দাবার কেমন পাওয়া যায়? আর জাতভায়েরাই বা কেমন?
অনেকগুলা প্রশ্ন শুনে শনি চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলল, রাখো রাখাে। বিদেশের কথা আর কি বলব! খাবার-দাবার অঢেল । বউ-ঝিয়েরাও ভালাে, একদম অসাবধান। ঘরবাড়িতেও দরজা জানালা তেমন নাই বললেই চলে। ঘরে ঢুকে দিনের বেলা হাস মুরগী ধরলেও কেউ তেমন খেয়াল করে না। আমি তাে তাজ্জব।
কিন্তু এতো কিছু হয়ে কী লাভ? সেখানকার জাতভায়েরা হল শত্রু। শুধু শক্র না, মহাশত্রু। সেখানে জাতভাইদের জালায় টিকতে না পেরেই তো ফিরে আসলাম। এখানে দুবেলা যা জুটে তাই খাবো। দরকার হলে উপোষ করে রাত কাটাবো। পেটে ক্ষিধে থাকলে কি হবে? অন্তত দেশের মাটিতে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়।