শেষবিকেলের সূর্য হয়ে উঠেছে রক্তরাঙ্গা, রাস্তাগুলো হয়ে গেছে নীরব।এমন সময় পারতপক্ষে কেউই বের হতে চায় না। কিছুক্ষণ, পরই সবকিছু হয়ে উঠবে কর্মচঞ্চল। হরেক রকমের লাল-নীল আলোয় সেলুনগুলো ঝিঁকঝাঁক করতে থাকে। লোকজনে গিজগিজপূর্ণ অবস্থা। “রোলস এন্ড রিম ক্যাফে”। কালো হ্যাট আর কোর্ট পরিহিত একজন সমানে বিয়ার খাচ্ছে। মাঝে মাঝে হিঁচকিও তুলছে। লোকজন চিৎকার আর টেবিলে শব্দ করে হৃদ-পুষ্ট কালো কোর্ট পরা লোকটাকে বাহবা দিচ্ছে। লোকটার খানিক দূরে বসে আছে ঘন দাঁড়ি-গোঁফওয়ালা একজন গম্ভীর লোক। তিনি খুব গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছেন। কোমড়ে আছে রংচটা সিক্সশ্যুটার ঝোলানো। লোকটার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে বারটেন্ডারের পনেরো-বিশ বছরের ছোট্ট ছেলেসহ আরো কয়েকজন। কিন্তু, অস্বস্থি হচ্ছে না লোকটার মাঝে। খানিকটা কফি খাওয়ার সাথে সাথে সে পুরো ক্যাফেটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর সেলুনের ব্যাটউইং এর কাছে আবির্ভূত হলো শহরের শেরিফ । চোখ বুলালো চারিদিকে।সাথে সাথে থেমে গেল হট্টগোল, কার্ড খেলা আর মদ্য-পান।
বারটেন্ডার হাসিমুখে বলে উঠল, “সবকিছু একদম ঠিক আছে শেরিফ।”
“শুনে ভালো লাগল, রবার্ট।”
বার কাউন্টার অতিক্রম করার সময়ে বলে উঠল শেরিফ, “আমি শুধু একটা ড্রিঙ্কের জন্য এসেছিলাম।”
“এখনি দিচ্ছি।”
আবার শুরু হল কথাবার্তা আর কার্ড গেম খেলা। শুধু মদ্যপানকারীদের উত্তেজনা বাতাসে মিইয়ে গেল। শেরিফ এসে স্ট্রেইঞ্জারকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। চোখে তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি।
“তোমাকে একটা ড্রিঙ্ক কিনে দেই, স্ট্রেঞ্জার?”
“ওটা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি, শেরিফ।” শ্রাগ করল আগুন্তক।
“আমি শহরে কোন নতুন ঝামেলার উৎপত্তি দেখতে চাইনা?”- চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বলল শেরিফ।
আগুন্তক লোকটি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্য অন্য দিকে তাঁকিয়ে রইল। খয়েরী হ্যাটের কারণে তার চেহেরা কেউ দেখতে পাচ্ছিলনা। কিন্তু, সে সকলের চেহারাই দেখতে পাচ্ছিল। ব্যাপারটা খুব মজা দেয় আগুন্তককে। শেরিফ তার ড্রিঙ্ক শেষ করে চলে যায়। সকলের দৃষ্টিতে আগুন্তক নিয়ে কৌতুহূলের রেশটা তবুও কেঁটে যায়না। হৃদ-পুষ্ট একজন এসে আগুন্তকের কাঁধে তার আধ-মন ওজনের কব্জি রাখে। পেছন ফিরে মোটাতাজা লোকটাকে দেখার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই জোরালো এক ঘুষিতে টুল ছেড়ে পড়ে যায় আগুন্তক। চারপাশে মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ে যায়। সকলে তখন নতুনসুরে বাহবা দিতে থাকে। এসময় হুড়মুড় করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে দুই পতিতা। এ্যামিলি আন্ডারসন ও রোজ ইভ। স্বল্পবসন ও কটু সুগন্ধির ঘ্রাণে সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে ফেরে। আগুন্তকে মেঝেতে ফেলে সবাই হুড়মুড়িয়ে কোলে তুলে নেয় তাদের। হৃদ-পুষ্ট লোকটাকে কমবয়সী রোজ ইভকে কাঁধে করে জোরপূর্বক রূমে নিতে চায়। রোজ আপত্তি জানায়। সে জানায়, মনসিমাং এর কারণে গত সপ্তাহের পর সে ঠিকমত উঠে দাঁড়াতে তিনদিন লেগেছিল। এ্যামিলি তাকে নেওয়ার জন্য মনসিমাংকে অনুরোধ জানায়। মনসিমাং তবুও তার কথা থেকে নড়চড় হয়না। রোজ ইভ হাত-পা ছুড়োছুড়ি করে প্রচন্ড চিৎকার করতে থাকে। রোজের চিৎকার শুনে সকলে আরেক দফা মজা নেওয়ার জন্য তৈরী হয়।
শিষ দেওয়ার শব্দ শুনে সকলে দেওয়ালের দিকে ফিরে তাকায়। হেলান দেয়া অবস্থায় কাঁত হয়ে দাড়িয়ে আছে সদ্য মার খাওয়া আগুন্তক। কিছুক্ষণের জন্য সকলের চোখে বিস্ময় কাজ করে। পুরো ক্যাফেজুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান। কোমড় থেকে তুলে নিল সিক্স শ্যুটার রাইফেল, টিপে দিল ট্রিগার! রাইফেল মাযল থেকে মুক্ত হয়ে দরজার দিকে ছুটল বুলেট, দরজায় সৃষ্টি হল বিশাল এক ফুটো, তারপর জায়গা করে নিল বিশাল বপুর অধিকারী মনসিমাং এর বুকের গভীরে। অস্ফুট গোঙ্গানির শব্দে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল মনসিমাং। সকলের চোখে এখন বিস্ময় ছাড়িয়ে গেছে। রোজ ইভ, মনসিমাং-এর মৃতদেহের নিচে চাঁপা পড়ে আছে। তার বিকট চিৎকারে সকলে সম্ভিত ফিরে পায়। এ্যামিলি ভয়ার্তকণ্ঠে বলে উঠলো, কোন খুনোখুনি তো এখানে হওয়ার কথা ছিলো না !
শেরিফ খুনো-খুনির সংবাদ পেয়ে দ্রুত চলে আসে। আগুন্তক তখনো ঠায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে থাকে। এরিক কর্বাতোস। শহরের নামজাদা শেরিফ। দুর্নীতিবাজ আর অবৈধ কার্যকলাপ করতে করতে এখন ডান হাতটা অবশ হয়ে গেছে। নিন্দুকেরা বলাবলি করে ওটা পাপের ফসল। এরিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বন্দুকের বাটের দু-চার ঘাঁ বসিয়ে দেয় আগুন্তকের দেহজুড়ে। এরিক আগুন্তকের কাঁধে হাত রেখে ক্যাফের বারটেন্ডার ও অন্যান্যদের বলতে থাকে, দ্বিতীয়বার কোন আগুন্তক দেখা মাত্রই তার শিরচ্ছেদ কর ফেলতে। কাঁধ থেকে ঝুলতে থাকা এরিকের অকেজো ডান হাত ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ ওর গলা পেঁচিয়ে ধরল আগুন্তক। হঠাৎ আগুন্তকের হাতে একটা ছোট্ট,ধারাল ক্ষুর দেখে তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে শিউরে উঠল লোকজন। রোজ আর এ্যামিলিসহ দুর্বলচিত্তের তারা তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করল কিংবা অন্যদিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা এড়িয়ে গেল। আগুন্তকের কালো কোর্টের হাতার নিচে লুকিয়ে রাখা ক্ষুরের এক পোঁচে মুহূর্তে দুই ফাঁক হয়ে গেল এরিকের গলা। কাটা কন্ঠনালী দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। রোজ দৃশ্যটা দেখে চিৎকার দিয়ে মুখ ঢাকল। দেহটা ফ্লোরে ফেলে দিল আগুন্তক। প্রবল আক্ষেপে তড়পাচ্ছে এরিকের শরীরের নীচের অংশ। মনসিমাং এর ফুঁটো হয়ে থাকা নিথর লাশটার দিকে তাকাল আগুন্তক,পকেট থেকে হলদে নোটবুকটা বের করে তালিকার নীচের দিকের একটা নাম কেটে বাদ দিল। আগুন্তক মেঝে থেকে তার কালো হ্যাটটা ঝাড়-পোছ করতে করতে টুলে গিয়ে বসল। সকলেই প্রচন্ড ভয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। আগুন্তক আবার এক কাপ কফি অর্ডার করলো। বারটেন্ডার কাঁপাকাঁপা হতে কফি দিল। আগুন্তক এর পর ধীর পায়ে সেলুনের বাইরে এসে দাঁড়ালো।
বাইরে ফুরফুরে বাতাস। আকাশটা গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে আছে। তারাগুলো মিটি মিটি করে জ্বলছে। আগুন্তক হাঁটতে শুরু করে, হঠাৎ পেছন থেকে বাঁধা পেয়ে ফিরে দাঁড়ায়। চাঁদের আলোয় দেখল একজন অপ্সরী তার দিকে হাসিমুখে তাঁকিয়ে আছে। সম্পূর্ণ অচেনা এক তরুণী।
“হ্যালো, জেন্টলম্যান। আশা করি , আপনি কিছু ভুলে ফেলে আসেননি কোথাও”
ত্রস্তব্যাস্ত হয়ে আগুন্তক তার সিক্সশ্যুটার, নাইফ ও আরও কিছু যন্ত্রাদির দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। এরপর, সে মাথা নাড়িয়ে না-সূচক সম্মতি জানিয়ে বলে, দুঃখিত,ম্যাম! আমার এমন কোন জিনিষ হারায়নি !
ভদ্রমহিলা মিচমিচে কালো এক ধরনের চামড়ার বস্তু ধরিয়ে দেয় আগুন্তককে। চামড়ার থলে অর্থাৎ মানিব্যাগ। চাঁদের আলোয় প্রথমবারের মতন ভদ্রমহিলার চেহেরা দর্শন করতে পারলো আগুন্তক। লালাভ হলদে ফর্সা চেহেরার ভদ্রমহিলা, নাক উঁচু, লম্বাটে চেহেরা। এক কথায় অসাধারণ। ভদ্রমহিলার রূপ-মহিমা দেখে আগুন্তক চমকে উঠে। হ্যাট খুলে ভদ্রমহিলার সামনে নড করে আগুন্তক। এডগার হেনরি। নাটালিয়ান তোরেস। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল- বলল নাটালিয়ান। ধন্যবাদ- গাঢ় অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে সেলুন ছেড়ে বাদামী রঙের ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল হেনরি। এ শহরে আসার আগে সে একটা নতুন কাজ যোগার করে নিয়েছে। কাল সকালে তাকে র্যাঞ্চার বব এর সাথে দেখা করতে হবে।পরদিন গরুর পাল নিয়ে তাকে ক্যাটল ড্রাইভে যেতে হবে।
শহরে গরুর পাল ঢোকার শব্দ মিলিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে।মধ্যদুপুরের সূর্য অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছে তাপ, রাস্তাগুলো হয়ে গেছে নীরব।গাছের ডাল-পালার ফাঁক-ফোঁকড় দিয়ে রোদ এসে পড়েছে হেনরির মুখমন্ডল জুড়ে।
রংচটা স্যুট। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে যাওয়া হ্যাট আর শতবর্ষীয় পুরোনো জুতোটা তুলে নিল মাটি থেকে। রাতটা শেরিফদের থেকে অহেতুক ঝামেলা থেকে বাঁচতে করালের পিছনে শুইয়েই কাঁটিয়ে দিয়েছিল হেনরি। ঘুমটা ভালোই জমেছিল। আরেকটু ঘুমোতে পারলে মন্দ হত না। কাল রাতের খুনোখুনির ঘটনা চারদিকে বেশ ভালোভাবেই ছড়িয়ে পড়েছিল। বব ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি কথা বলছিল যার কারণে মাথার খুলি বরাবর দু’টো বুলেট চালিয়ে দিয়েছে হেনরি। আপতত এখন কেউ আর জ্ঞান দিতে আসবেনা !
হাজার খানেক গরু প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে পরস্পরের সাথে ঠেলাঠেলি আর গুঁতোগুঁতি করছে। অবিরাম ক্রুদ্ধ, অসহিষ্ণু চিৎকারে কান ঝালাপালা। খুরের আঘাতে শক্ত মাটি চূর্ণ বিচূর্ণ। বাতাসে ধুলোর চাদর। শেষ গরুর পালটি করালে ঢুকতে অফিসে ফিরে চলল র্যাঞ্চার নেবুলা এরমিন। নেবুলা এরমিন। ওর সাথে আছে আরো ছ’জন র্যাঞ্চার। করাল গেট পেরোনোর সময় হেনরির ওপর চোখ পড়ল ওর। আন্তরিক এক টুকরো হাসি উপহার দিল ও ছেলেটিকে।গরুর পাল করালে ঢোকানোর সময় বেশ কয়েকবার ছেলেটাকে দেখেছে ও। ধুলোবালি উপেক্ষা করে বেড়ার অপর পাশে শুয়েছিল। বড় বড় চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকা হেনরির শুষ্ক মুখের দিকে তাঁকিয়ে থেকে নেবুলা কেন যেন নিজের ভেতর একধরনের টান অনুভব করেছিল।
নিজের সঙ্গীদের দিকে চাইল ও।”কথাবার্তা শুরু করার আগে,একটু গলা ভিজিয়ে নিলে মন্দ হয় না, কী বলো?”
“ওটা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি, নেবুলা।” শ্রাগ করল হেনরি। মরমনদের তরফ থেকে কোন উত্তর পাওয়া গেল না। একটু হতাশ হলো নেবুলা। আমন্ত্রণটা ফের জানাল।
চওড়া কাঁধের দাড়িওয়ালা চার্লি নামের একজন জবাব দিল এবার, ‘আমন্ত্রণের জন্যে ধন্যবাদ।কিন্তু ব্যাবসার দিন আমরা মদ খাই না। শাস্ত্রে নিষেধ আছে। এরই মধ্যে দু’জন তরুণ এসে যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে। ঘোড়ার পিঠ থেকে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে করালের বেড়ার ওপর দিয়ে গরুগুলোকে দেখছিল ওরা।এক তরুণ ঘাড় ফেরাল নেবুলার দিকে।
“তুমি যদি পান করানোর জন্যে কাউকে চাও, তাহলে আমরা দু’জন তোমার সাথে বসতে রাজি আছি, ব্রাদার।”
দু’জনই সুদর্শন, তবে দু’জনের চেহারায় কঠিন ও শয়তানি ভাবটাও নজর এড়াল না নেবুলার। আলগোছে কাঁধ ঝাঁকাল ও। হালকা গলায় বলল,”বেশ তো ভায়েরা। একটু অপেক্ষা করো। এক্ষুনি আমার বন্ধুদের সাথে ব্যবসায়িক কাজ সেরে তোমাদের নিয়ে সেলুনে বসব।”
সশব্দে গলা পরিষ্কার করল হেনরি। ‘তুমি কী করবে, সেটা নিশ্চয় তোমার নিজেরই সিদ্ধান্ত, বন্ধু। তবে আমি হলে এ-ধরনের লোকের ব্যাপারে সাবধান থাকতাম।’
“তাই?” জিজ্ঞাসু চোখে হেনরির দিকে চাইল নেবুলা।
‘তুমি চেন ওদের?’
“না, চিনি না।”
‘ক্যারিভাইলে এরা নতুন। তবে তুমি হয়তো রেড ক্ল্যাশারের-এর নাম শুনে থাকবে…’
“কে শোনেনি বলো?” হাসল নেবুলা।
‘তুমি এখন রেড ক্ল্যাশার-এর সীমানায় ঢুকে পড়েছ,’ হেনরি বলে চলল। ‘এখানে এমন অনেক লোক আছে, যারা স্বেচ্ছায় না-হলেও গার্বিস জর্জা ও তার লোকদের পক্ষে কাজ করে, প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা দেয়। তুমি একজন গরুক্রেতা, যেভাবে সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছ, তাতে রেড ক্ল্যাশার তোমার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবেই। তোমার প্রতিটি পদক্ষেপের খবর নেবে।’
“তুমি এত কিছু জান কিভাবে”- সোজাসাপটা প্রশ্ন করল নেবুলা। ততক্ষণে বিরক্ত হয়ে নেবুলার ছয়জন সঙ্গী স্থান ত্যাগ করেছে।
‘আমরা যখন যেখানে অবস্থান করি তখন চারপাশ দেখে-শুনে,খোঁজ-খবর নিই’- মৃদু হেসে বলল হেনরি।
“তুমি বলতে চাইছো, ওই দুই তরুণ রেড ক্ল্যাশার- এর হয়ে কাজ করছে? ওদের চেলা?”
‘হতে পারে।’
“ঠিক আছে, ধন্যবাদ। আমি সাবধান থাকব।”
নেবুলা বাকি সঙ্গীদের সঙ্গে ব্যবসা শেষ করে অফিস থেকে বেরোল। রাস্তা পেরিয়ে ওপাশের সেলুনে গিয়ে ঢুকল। সকাল থেকে গরু কেনা আর সেগুলো করালে ঢোকানোর কাজ তদারক করতে গিয়ে গাধার মত খেটেছে। একগাদা ধুলোও হজম করতে হয়েছে। তৃষ্ণায় গলা ফাটার উপক্রম।সারা দিনে আরও কয়েকবার পান করে গেছে নেবুলা। বারটেণ্ডারের সঙ্গে মোটামুটি ভাব জমিয়ে ফেলেছে। এখন ঢুকতে দুই তরুণকে দেখতে পেল। বসে আছে ওরা। হেনরি নামের ছোঁকড়া-টা এদের ব্যাপারে সতর্ক করতে চেয়েছে ওকে। বলেছিল গ্লাস ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারেও হুশিয়ার থাকতে।ওকে দেখে দু’তরুণ বার থেকে দুটো গ্লাস সশব্দে নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। তারপর এক সাথে স্বাগত জানাল,
“ঠিক সময় মত পৌঁছে গেছ তুমি, তুমি। তোমার জন্যে কী বলব?’
“বীয়ার।” মৃদু হাসল নেবুলা অভ্যর্থনার জবাবে।
নিজেদের গ্লাসে মদ ঢালল ওরা। পান করতে শুরু করল। ইভান দাম দেবার আগেই দু’জনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি কথা বলা তরুণ পকেট থেকে এক টুকরো সোনা বের করে টেবিলের ওপর রাখল।
“গরু কিনছ, না?”- জিজ্ঞেস করল নেবুলাকে।
“বলতে পার,” স্বীকার করল নেবুলা । মাঝে মধ্যে এখানে ওখানে সুযোগ পেলে কিনে ফেলি। গ্লাস খালি করে বলল,
‘পরের বার আমাকে দাম দেয়ার সুযোগ দাও। কী খাবে তোমরা?’
“হুইস্কি” -জবাব দিল একজন। অন্যজন হাসল।
পান শেষ করে সিগারেট অফার করল নেবুলা । একজন বলল,
“মিস্টার, তুমি যদি গরু কিনতে চাও, তাহলে বলব ঠিক জায়গাতেই এসেছ। তবে তার আগে তোমার সাথে পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলি। আমি রিভার্স ফস্টার। আর আমার সাথের থালামুখওয়ালা দেখছো ওর নাম বর্গ কলিন্স।’
“তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে সত্যিই খুশি হয়েছি,” হৃদ্যতা প্রকাশ পেল নেবুলার গলায়।
“আমি নেবুলা এরমিন।”
“আমরাও খুশি, নেবুলা। ”
“বারকীপ,গলা চড়াল থালামুখো বার্গ। “গ্লাস ভরে দাও সবার।”
“তোমরা গরুর কথা বলছিলে’ স্মরণ করিয়ে দিল নেবুলা।
“এই মাত্র বারকীপ বলছিল তুমি নাকি প্রায় পাঁচ হাজার’ গরু কিনে ফেলেছ ব্লু মন্ডের কাছ থেকে। তুমি কি আরও কিনতে চাও?”
“আমার সেরকমই ইচ্ছে,”- স্বীকার করল নেবুলা ।
“রিপল র্যাঞ্জের জন্যে আরও দুই থেকে আড়াই হাজার গরু কিনব। ওরা বলেছে,পশ্চিম অঞ্চলের ছোট্ট সাইজের গরুগুলো ভাল। অনেকটা টেক্সান লংহর্নের মত।”
বেশকিছুক্ষণ কথা-বার্তা হল। এরপর আরেক পালা ড্রিঙ্ক হলো। তারপর দুই তরুণকে বিদায় দিয়ে করালে ফিরে গেল নেবুলা। ওখানে র্যাঞ্চারদের কাছ থেকে কেনা গরুগুলোর দেখাশোনা করছে এক র্যাঞ্চার আর তার দুই ছেলে। গরুগুলো চালান করে দেয়ার আগ পর্যন্ত এই চারণভূমিতেই ওগুলো চরানোর বন্দোবস্ত করে নিয়েছে নেবুলা । গরুগুলো কৃশ, কোমর হাড্ডিসার, চোখে বুনো দৃষ্টি। তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে করাল গেট ভেঙে বেরোবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ছাড়া পেতেই দুদ্দাড় করে ছুটল লেজ তুলে। বাতাসে ধুলোর ঝড় উঠল। খুব ভাল একটা গরুর পাল হয়েছে, ভাবল নেবুলা । তবে দাম যা আশা করেছিল, তারচেয়ে একটু বেশি দিয়ে ফেলেছে। এটাই তার প্রথম চালান। এখন খুব একটা হৃষ্টপুষ্ট নয়, তবে আশা করছে রিপল কিংবা মণ্টানার ঘেসো ভূমিতে নিয়ে যেতে পারলে তরতাজা ঘাস খেয়ে তাড়াতাড়ি মোটাতাজা হয়ে উঠবে। গরুগুলোর বয়স বেশি নয়।
তরুণ দুই কাউপাঞ্চারের কথাগুলো এখনো কানে বাজছে নেবুলার। তবে তাদের পরামর্শ মত কাজ করার ইচ্ছে ওর নেই। দু’জনের কথাবার্তা ও আচার-আচরণের ধরনে কাউপাঞ্চারের চেয়ে আউটল’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি মনে হয়। নেবুলা এধরনের লোকের ব্যাপারে আনাড়ি নয়। তবে ওরা যা বলেছে, তাতে অবিশ্বাস করাও শক্ত। কিন্তু ট্রেইলে নিজের কাজে যদি সে খুব বেশি দক্ষতা দেখাতে না-পারে, তাহলে তারা সহজে ওর কাছ থেকে গরুগুলো কেড়ে নিতে পারবে।গরুগুলোর দায়িত্বে থাকা লোকটাকে কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল সে। তারপর নিজের হোটেলের দিকে রওনা হলো। হঠাৎ বেড়ার কাছে দাঁড়ানো আগের সে-ছেলেটার দিকে নজর গেল ওর। ছেলেটা এখনও অপসৃয়মান গরুগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চকচকে আগ্রহ।
‘ওগুলো কি তোমার গরু?’ নেবুলার চোখে চোখ রাখল ও।
“হ্যাঁ, বাছা,’ বলল নেবুলা। আমার মনে হয় গরুগুলো আমারই। ”
‘তাহলে তুমি একজন ক্যাটলম্যান?’
“না, এটা কিন্তু মনে হয় না।” হাসল নেবুলা । আমি স্রেফ একজন গরুক্রেতা। একটা কোম্পানির
জন্যে কিনে নিচ্ছি এগুলো।”
‘তাহলে তুমি এখানকার কেউ নও।’
“আমারও সে রকম ধারণা। তা তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
‘আমি আমার মত আছি। কোন প্রয়োজন পড়লে ডাকবে। কারো যে কোন সাহায্যের জন্য অর্থের বিনিময়ে কাজ করে এই হেনরি’- বিজয়ী সুরে বলল হেনরি। বেশকিছু কথা হল ওদের মাঝে। নেবুলা হাসিমুখে বিদায় নিল হেনরির কাছ থেকে।
গরু কেনার জন্যে বেরোলে সব সময় নিজের ঘোড়ায় চড়ে ও। ওর ঘোড়াটা লম্বামুখো, ধূসর;চোখদুটো কাচের মত উজ্জ্বল চকচকে। ছুটার জন্যে পাগল হয়ে থাকে সারাক্ষণ। দিনের পর দিন পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর মাইল হেসে খেলে
চলতে পারে। নেবুলা ওকে মিরাসা বলে ডাকে। শহর থেকে বেরোনোর একটু পরেই নিজের গতিপথ বদলাল সে। সরু ওয়্যাগন রোড ধরে ফের এগোল। রাস্তাটা চলে গেছে পেনোলোয়া ক্যানিয়নের দিকে। এলাকাটা খোলামেলা। রাস্তা ছেড়ে একটু দূর দিয়ে এগোচ্ছে ও। ক্যানিয়নের মুখে পৌঁছানোর আগে মিসাসাকে হণ্টন গতিতে চলতে দিল। ক্যানিয়নের ভেতরটা হালকা ঝোপঝাড় আর ছোট ছোট গাছ-গাছড়ায় ভরা।হ্যারিসনদের বাকবোর্ডটা চোখে পড়তে ঘোড়ার গতি থামাল ও। ওদের গাইডকে ক্যানিয়ন থেকে সিকি মাইল দূর দিয়ে বাকবোর্ড নিয়ে যেতে দেখল। একটা বাঁক ঘুরতে চোখের আড়াল হয়ে গেল ওটা। রাস্তার পাশে একটা ঘন ঝোপের ভেতর ঢুকে গেল গেল ও মিসাসাকে নিয়ে। এমন একটা জায়গা বেছে নিল, যেখানে লুকিয়ে থাকলে ঘোড়াটা কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না। কিন্তু ও নিজে রাস্তার ওপর একটা চোখ রাখতে পারবে। প্রায় এক ঘণ্টা পরে ধৈর্যের ফল ফলল। বার্গ ও রিভার্সকে দেখা গেল আসতে। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে আসছে ওরা। মনেই হচ্ছে না এই এলাকায় ওরা তারই মত আগন্তুক। যেন এলাকার প্রতিটি ইঞ্চিই ওদের নখদর্পণে। এত দূর থেকেও ওদের মুখের ভাব পড়তে পারছে নেবুলা। খুশিতে রীতিমত টৈ টুম্বুর দুই পাঞ্চার। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটল নেবুলার।স্বল্প পরিচিত দুই পাঞ্চার বন্ধুর প্রতি ওর মনে বিশেষ কোনও বিদ্বেষভাব নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে স্রেফ পাঁজি লোক ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না ওদের। ওর সাথে চালাকি করতে চেয়েছে ওরা। যে পথে যাবার কথা, সে পথে না-গিয়ে তার বিপরীত দিকের পথে চলে এসেছে। অর্থাৎ যেদিক থেকে গিয়েছে, ফের সেদিকে ফিরে চলেছে। এর মানে কী হতে পারে, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না নেবুলার। আচমকা ঠোঁটের কোন থেকে হাসি মুছে গেল ওর। সামনে বাকবোর্ডে চড়া লোকগুলোর কথা মনে হলো। দুই রাইডার চোখের আড়াল হয়ে যেতেই মিসাসাকে নিয়ে ঝোপ থেকে বেরোল সে। তারপর ধীরে সুস্থে ফিরে গেল পূর্বের স্থানে। হেনরি তখনও সেখানে বসে আছে।
বন্দুকের বাটের খোঁচায় সচকিত হয়ে উঠল হেনরি। পিছনে দীর্ঘাদেহী একজন লোক। শহরের নতুন শেরিফ হয়তো। দেহের গড়ন (চিকন) হলেও কাঁধ চওড়া,হাড়গুলো চ্যাপ্টা এবং শক্ত। চেহারায় বুনোভাব প্রকট হয়তোবা স্বভাবও তেমনি। হেনরি ভাবছে অন্য কথা। বেশ কয়েকটা কাউন্টিতে তাকে খোঁজা হচ্ছে ব্যাংক ডাকাতি, রাশলিং, খুন আর তাসে চুরি করার অপরাধে।মাথার দাম ত্রিশ হাজার ডলার। শেরিফ কি তাহলে ধরে ফেললো !
নেবুলা হাসিমুখে বলল- “জেগে আছ না এখনও ঘুমাচ্ছো !”
‘অযথা তামাশা রাখো, কি বলবে বল’- গম্ভীরস্বরে বলল হেনরি।
“সারাবেলা এখানে বসে ভিক্ষে করার চেয়ে আমার সাথে চলো, ভালো কিছু করতে পারবে”
‘হা…হা…হা। কত দিবে ?’
“প্রতিদিন পঞ্চাশ ডলার আর পেটচুক্তি খাবার”
‘বেশ বেশ। কোথায় যেতে হবে বল’
শহর থেকে মাইল পনের দূরে পাহাড় পেরিয়ে মরুভূমিতে পৌঁছেছে কুখ্যাত আউট’ল হেনরি আর র্যাঞ্চার নেবুলা। কোম্পানির জন্য কেনা হাজার পাঁচেক গরুগুলো সে চালাকিপূর্বক অন্য ট্রেইল ধরে পাঠিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে, বেশ দক্ষতার পরিচয়ই সে দিয়েছে। হেনরি আর নেবুলা দু’জনই বেশ ক্লান্ত। নেবুলা দুই কাউপাঞ্চারের ধোঁকার কথা মনে করে মিটিমিটি হাসছে। যতদূর চোখ যায় সবুজের চিহ্ন মাত্র নেই । ধূসর মরু দিয়ে চলে গেছে রেললাইন । মানুষের চিহ্ন বলতে আছে শুধু একটা রেল স্টেশন । উইন্ডমিলের একটানা একঘেয়ে শব্দ আর মরুভূমির তপ্ত ধুলো হাওয়া বয়ে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কিছু কানে আসছে না । স্টেশন রুমে টেলিগ্রামের ঘড়ঘড় আওয়াজ । হেনরি স্টেশনের রুমের সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শেষবয়সী একজন মুখে উপর হ্যাট দিয়ে ঘুমাচ্ছে। কু…ঝিক…ঝিক, কু…ঝিক…ঝিক, কু…ঝিক…ঝিক শব্দে ট্রেন আসছে। ট্রেনের টিকেট কেনার কোন বালাই নেই। ট্রেন না গরুর গাড়ি সেটাই সন্দেহ। কাছেই একটা ম্রিয়মাণ শহর আছে। নেবুলা ওখানে যাবে। দুই ধোঁকাবাজ কাউপাঞ্চারকে নেবুলা নাখোঁজ করে দিয়েছে কিন্তু সে পাহাড়ের অপর প্রান্তের জায়গাটা অনন্ত একবার দেখে আসার জন্য ওদিকে যাচ্ছে।
ব্যাটেন শহরটা ছোট, ধারে কাছে জনবসতি তেমন নেই। বছর কয়েক আগে স্বর্ণের খনি পাওয়া গিয়েছিল এখানে,তখন রাতারাতি গজিয়ে উঠেছিল এটা। এখন স্বর্ণ ফুরিয়ে গেছে, এমনিতে শহরটার মরে যাবার কথা কিন্তু সীমান্তের কাছে বলে আউট’লরা প্রায়ই এখানে যাত্রা বিরতি করে। তাই কোনমতে এখনো টিকে আছে। তবে আইন কানুনের বালাই নেই। নামমাত্র ল’ম্যান আছে একজন, তবে সে ঘুষখোর এবং বেহেড মাতাল। শহরটাকে চালায় এক সেলুন মালিক, নাম ক্রিস্টোফার। তবে ওটা তার আসল নাম কিনা কে জানে!
হেনরি আর নেবুলা দু’জনে ঘোড়া ছেড়ে একটা সেলুনের সামনে নামল।ট্রেন থেকে নামার সময় কমদামে ঘোড়াগুলো পাওয়ায় নেবুলা নিজের জন্য বাদামী রংয়ের আর হেনরির জন্য কালো রংয়ের একটা কিনে নেয়। নেবুলা চটজলদি নেমে সেলুনের দিকে হাঁটতে থাকে। হেনরি ঘোড়ার লাগাম হাতে চারপাশ অনুসন্ধানী নজড়ে দেখতে থাকে। মিচমিচে কালো একটা বিড়াল হঠাৎ হেনরির পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। হেনরি আঁৎকে লাফিয়ে ওঠে।
মৃদু নারীর হাসির শব্দে হেনরি সেলুনের উপরের দিকে তাঁকায়। একটা অল্প বয়স্ক মহিলা খিল খিল করে হাসছে। রোল’স এন্ড রিম ক্যাফের মেয়েটাই এটা। এখানে কি করছে ? -ভাবলো হেনরি।
“হ্যালো, হেনরি “- উপর থেকে ডাকলো ভদ্রমহিলা।
‘হ্যা, তুমি সেই রাত্রের…..’
“হ্যা”; উত্তর জানাতে জানাতে উপর থেকে লোহার সিঁড়ি নামিয়ে, সেটা ধরে নিচে নামলো। নাটালিয়ান তোরেস।
‘ও হ্যা’, মুখে হাত দিয়ে নিজের ভুল ঢাকতে চাইলো হেনরি।
ভদ্রমহিলা শরীরে ঘিয়ে বর্ণের পাতলা একটা গাউন দেখা যাচ্ছে। হেনরি বিমোহিত হয়ে সেদিকেই তাঁকিয়ে আছে। নাটালিয়ান হেনরির আরেকটু কাছে চলে আসলো। হেনরি মুখ নামিয়ে নাটালিয়ার মুখের দিকে আসলো। অনেক্ষণ ধরে দু’জন কিস্ করলো। নেবুলা সেলুনের বাইরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল কিন্তু কিছু বলছিলোনা। বারটেন্ডার মেইল অর্ডার ক্যাটালগ থেকে দু’জনকে এমন পরিস্থিতিতে দেখে হোলস্টার হাতে দৌড়ে বের হয়ে আসে।
“সরে দাঁড়াও, নয়তো ভদ্রলোক তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে আমি কার্পণ্য করবো না”- গম্ভীর স্বরে বলল বয়স্কা বৃদ্ধমতন লোকটা।
হেনরি ও নাটালিয়ান দু’জনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নাটালিয়ান অজানা আশঙ্কায় ভয়ে ঢোক গিলল। দৌড়ে গিয়ে বৃদ্ধালোকের হোলস্টার মেঝেতে ফেলে দিল। নেবুলাও কিছু বুঝতে পারছিলনা। হাবার মত তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে দেখছে। হেনরি আর নেবুলা সেলুনে বসে আছে। গাঢ় কড়া কফিমগে চুমুক দিতে দিতে হেনরি আনমনে তাঁকিয়ে আছে বাইরের দিকে। মুহূর্তেই সেলুনে যেন ডিনামাইট বিস্ফোরণ হল। ক্রিস্টোফার তার দল-বল কয়েকজন নিয়ে হাজির। হেনরি কখনো এদের কাউকে দেখেনি বলে ভাবলে, এরা হয়তো কাউপাঞ্চার!
“প্লিজ,দয়া কর! এই ব্যবসাটাই আমার সব, কেড়ে নিলে এই বুড়ো বয়সে না খেয়ে মরব আমি, পথে বসবে আমার অবিবাহিতা মেয়ে!” ধরা গলায় মিনতি করল বুড়ো জনাথন। ছোট্ট একটা সেলুন চালায় সে। এই মুহূর্তে ওটারই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেচারা ক্রিস্টোফার।
“না খেয়ে মরার চেয়ে সীসা খেয়ে মরা যদি তোমার বেশি পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে এখনই ব্যবস্থা করছি!”- চড়া গলায় হেঁকে উঠল ষণ্ডা মার্কা এক গোঁফওয়ালা। জোড়া পিস্তল ঝুলছে তার কোমরে।মূহুর্তেই গর্জে উঠল ওটা। বুড়ো বুকে হাত দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। নেবুলা তৎক্ষণাৎ টেবিল ডিঙিয়ে ষণ্ডার রাইডিং স্কার্ট থেকে ছোঁড়া নিয়ে গলাটা দু’ভাগ করে দিল। ক্রিস্টোফার এমন পরিস্থিতিতে ব্যাথিত হল। সম্পূর্ণ নতুন দু’জন আগুন্তক তার এলাকায় এসে তার লোকজন মারবে, এ তো সহ্য করা যায়না। ক্রিস্টোফার সিক্সগানের দিকে হাত এগোল। মুহূর্তেই বুকে একটা বড় গর্ত নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ক্রিস্টোফার। তারপরই যেন নরক ভেঙ্গে পড়ল সেলুনের ভেতরে। কিল, ঘুষি আর লাথির বদৌলতে সেলুনের চেয়ার-টেবিল ভেঙে খান-খান হয়ে গেল। হেনরি যথেষ্ট দ্রুতগতিসম্পন্ন, ওকে সহজেই হারানোর মত কেউ নেই। কিন্তু র্যাঞ্চার নেবুলা অন্য ধাতুতে গড়া। রিস্টোর কার্ল পিস্তল খাপ মুক্ত হল বটে কিন্তু ট্রিগার টানার আগেই বুকে গুলি খেয়ে কেঁপে উঠল সে। তার পিস্তল থেকে একটা গুলি বেরিয়ে মেঝেতে একটা গর্ত সৃষ্টি করল। নিশ্চিত হবার জন্য নেবুলার কপালে আরেকটা বুলেট ঢুকিয়ে দিল কার্ল, তারপর তাঁক করলো হেনরির মাথা বরাবর।
অন্যদিকে নাটালিয়ানের শিকারে পরিণত হয়েছে কার্ল।প্রকাশ্যে পিস্তল না ঝোলালেও গাউনের নিচে একটা ডেরিঞ্জার রাখে সে। ওটা দিয়ে ক্রিস্টোফারের অন্য দু’জনকে কভার করে ফেললো মেয়েটা। চারপাশ এখন সুনসান নীরবতা। শহরের ল’ম্যান খবর পেয়ে ছুঁটে এসেছে। নেবুলার মৃত দেহ দেখে তিনিই যেন হেনরির চেয়ে বেশি কেঁদে উঠলেন। নেবুলা এরমিন। পেশায় একজন গোয়েন্দা। ব্যাবহার ও কথা-বার্তায় যে অমায়িক। পুরো দেশের গোপন সংস্থাগুলো যার সামনে মাথা নোয়ায়। তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। তার বুক পকেটে রাখা ডায়েরীটা তুলে নিল হেনরি। ডায়েরীর প্রথম পাতায় লেখা ‘দ্য এপিক জার্নি’। প্রতিটি পাতায় রয়েছে তার কর্মজীবনের সকল ইতিকথা। ডায়েরীর প্রমাণ সাপেক্ষে অর্থাৎ হেনরি সম্পর্কে নেবুলার লিখে যাওয়া তথ্যানুযায়ী হেনরি জজ ও জুরি প্যানেল থেকে রেহাই পায়।
আজ জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে হেনরি। নাটালিয়ান তোরেস দু’টো ঘোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার স্মিত হাসি। হেনরির হাতে নেবুলার ছিন্ন ডায়েরী। বাদামি বর্ণের ঘোড়ায় চেপে হেনরি মিলিয়ে যায় দূর দিগন্তের মাঝে। হেনরি তার ট্রেইলের শেষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। সত্যিই “দ্য এপিক জার্নি” !
-সমাপ্ত-