আজ ঈদ। আজ কুরবানি। কাজেম সুমনদের ঘরে এসে ডাকছে। সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকে বিছানা থেকে সুমনকে হেচকা টান দিয়ে তোলে, কী রে গোসল করবে না? উঠ, উঠ। শীতের মাঝে কেনে যে ঈদ আসে- চোখ কচলাতে কচলাতে বলল সুমন। সুমনের বিরক্তিমাখা কথা শোনে কাজেম কানে টিপ্পনি দিয়ে বলে, শীতবালক, গরম পানি দিয়া গোসল করবে নাকি আজ? কুড়ে একটা। সুমনের মা কাজেমকে বলে, বাবাজি নামাজ পইড়া একবার আইসো তো। কাজেম মাথা নেড়ে সায় দিল।
দুজন গোসল করতে যায় পুরান বাড়ির বড় পুকুরে, এই পুকুরে ঈদ আসলে সকলেই খাস করে গোসল করে। পুকুরের পানিও মাশাআল্লাহ। কাজেম সুমনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়, সুমন শীতে থরথর করে কাঁপে, কাজেম তার একমাত্র বন্ধু, যদিও সে অন্য গোষ্টির। তবুও তারা একে অন্যের শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই সুমনের রাগ উঠলেও কিছু বলেনি। কাজেম ইশারা দিয়ে বলে, তোর মনে আছেনি গতবার বাজি ধরেছিলে যে, তুই ভরা শীতে পুকুরে বাঁশের কুঠায় ধরে থাকবে, কেউ যদি ঈদ মোবারক না বলে তাহলে আমি বাজিতে জিতে যাব। আশ্চর্য! কেউ তাকে ঈদ মোবারক বলেনি। শীতের মাঝে গোসল মোবারকও বলতে পারতো কেউ। অনেকে বলেছিল কিরে সুমইন্না, তোর গরম লাগে বুঝি? প্রায় ১০ মিনিট পৌষের শীতে পানিতে থাকা কম কথা না। কাজেম বাজিতে জিতে যায়।
সুমন দুইটা ডুব দিয়েই পাড়ে উঠে যায়।
কীরে শীতবালক, সাবান লাগাইলে না! বুইড়ার শীতে ধরছে রে। বেশি লাগছে? যা যা উন্দালের ধারে যা।
কুয়াশার আড়ালে সূর্যটা উঁকি দিছে মাত্র। বাড়ির বাচ্চারা নতুন পোশাক পড়ে ঈদ জমিয়েছে উঠানে। ওরা নতুন পোশাকের ফিতা, স্টীকার ছিড়তে চায় না এই ভেবে যে, কেউ হয়তো বলবে, তোরটা দেখি পুরান রে।
কাজেম সবুজ রঙের পোশাক পড়ে সুমনদের বাড়িতে আসলো, এই পোশাকে তাকে বেশ মানিয়েছে। সুমনের চাচাতো বোন চুমকি মিটিমিটি হেসে বাচ্চাদের বলেছিল মাশাআল্লাহ! কাজেম ভাব দেখাইয়া মনে মনে বলে, সূর্যের আলো হার মাইনা যায় রে!
সুমন ঘর থেকে বের হতেই কাজেম মনে মনে বলল, এই সুমইন্নায় তিন বছর ধইরা লাল পোশাকই পাইছে। লাল্লু কোথাকার।
সুমন বলে- কি রে ইসমাইল কই, আইলো না যে?
ইসমাইলদের বাড়িতে যাচ্ছে দুজন। বাদলরা ডেখা ছুইটা কী যে অবস্থা করছে পাড়ায়।
ইসমাইলরা আজ দুইটা কুরবানি দিবে। কারণ তাদের গোষ্টি বড়। কাজেম, সুমন এবং ইসমাইল ওরা তিনজন ঈদগাহে যাচ্ছে। হঠাৎ কাজেম বলে, কী রে মানুষ কই?
এ্যা রে তোরা কি ভুলে গেছিস? রাতে না মাইকিং কইরা জানাইলো ঈদের নামাজ মসজিদে হবে- সুমন বলল।
হ্যা তাই তো, আজাইরা আইলাম এত পথ।
ওরা মসজিদের পথে রওয়ানা দেয়। সুমন বলল, আচ্ছা রে দোস্ত, ঈদের নামাজ ঈদগাহে না পড়লে না যেমন কীরকম লাগে। ঈদগাহে ধান বন সব শুকানো হয়, আর নামাজ চলে না। কথাগুলো যেন বিরক্তিকর ভাব নিয়েই সুমন বলল।
কাজেম বলল – নিশ্চয়ই এখানে কোনো ঝামেলা আছে তাই পতিত পইড়া রইছে। আজাইরা না জেনে কথা বলিস না।
ঈদ নামাজ শেষে মুসাফা, বুকাবুকি,হাতাহাতি করে বাড়ির দিকে যাত্রা তাদের। সুমনের আবারো তিতা জিজ্ঞাসা: আচ্ছা রে ইসমাইল, তোরা নাকি গোষ্টি বড় বলে এবার দুইটা কুরবানি দিবে?
কাজেম সুমনের দিকে আড়চোখে তাকালো।
হ্যা রে দোস্ত, না দিলে তো গোষ্টির মানুষ অন্য গোষ্টির হাতের দিকে চেয়ে থাকবে। তাই অনেক বছর চাপে পইড়াও বাবার এরকম উদ্যোগ আরকি।
তা না হলে পাড়ায় বলাবলি হবে, জারেফ মেম্বরের বেইল শেষ নাকি!
ইসমাইলের কথা শোনে সুমন খেক খেক করে হেসে বলল, কিছু মনে করিস না, গোষ্টির চাপে,লোক লজ্জায়,নাম করতে গিয়ে কুরবানি দেওয়া না দেওয়া একই কথা। প্রকৃত উদ্দেশ্য আল্লাহকে খুশি করা।
কাজেমের ইচ্ছা করতেছে সুমনের গালে ঠাস করে একটা থাপরা বসায়, তবুও রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল, বেশি বুঝস তুই, না? চল তো জলদি।
ইসমাইল তার কথার জবাব না দিয়ে বাড়ি চলে গেল দম্ভ ভরে।
কাজেম সুমনদের বাড়িতে ঘরের পিছনে আমগাছের তলায় বসে আছে, সকালের সেই সূর্যটা চুপি চুপি বলে গেল ঈদ মোবারক। কাজেম শোনেও না শোনার ভান করে বসে রইল। সুমনের বাবা খাসিটাকে কদমতলায় রেখে জবেহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সুমন পিঠা নিয়ে কাজেমের কাছে গিয়ে বসলো, কাজেম পিঠা খেতে খেতে বলল, কিরে জ্ঞানী, তোরা নাকি কারো বাড়িতে যাবে না বলে ঘরের খাসিটাকেই কুরবানি দিচ্ছিস? ইসমাইল আর তোদের চিত্র তো দেখছি
একই।
সুমনের বাবার ডাকে সুমন কাজেমের কথার জবাব না দিয়েই উঠানে চলে এলো।
কাজেমের গতবছরের কথা মনে আছে। ইসমাইলের ফুফু তো ছালেক চাচাকে সরাসরি বলেই ফেলল যে, কুরবানির গোশত যদি গোষ্টির মানুষেই না খায় তাহলে আর কেডায় খাইবো? আর মাইর ডেংগা লাগলে তো অন্য গোষ্টির মানুষ আইতো না। দূর দূর করে সেদিন ছালেক চাচাকে তারা তাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের গোষ্টির মানুষ নয় বলে।
কাজেম সুমনকে ডেকে বলল, যাই
রে, একবার যাইস গরীবের বাড়িত।
তুই আইস, বাড়িত কাজ অনেক। আমি অপেক্ষা করবো কিন্তু।
কাজেমরা যে গোষ্টিতে আছে তাদের মাত্র একটা কুরবানি পড়ে,অনেক বছর পড়ে না। এক দুই টুকরা পায় সকলে।।
কাজেমের বাবা তার হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলল, যা মোরগ নিয়া আয়, তোর দুলা ভাই আইবো।
চলবে……