দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে বড় হ্রদ বাংলাদেশের কাপ্তাই লেক। মাত্র অর্ধ শতাব্দী আগেও রাঙ্গামাটি জেলায় এ হ্রদের কোন অস্তিতই ছিল না। মনুষ্য সৃষ্ট এ হ্রদটি কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে তাই জানার চেষ্টা করবো আজকের এই লেখায়।
বাংলাদেশের দক্ষিন পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি পার্বত জেলা রাঙ্গামাটি। চট্রগ্রাম বিভাগের অধীনে এ জেলাটি আয়তনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জেলা। রাঙ্গামাটি বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যার সাথে ভারত এবং মায়ানমার দুটি দেশেরি আন্তর্জাতিক সীমানা রেখা রয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলার পর্যটনশিল্প গড়ে উঠেছে মূলত কাপ্তাই লেক’কে ঘীরে। কাপ্তাই শুধু বাংলাদেশেরি নয়, এটি দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে বড় হ্রদ। প্রায় ২ হাজার বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের এ হ্রদটি মূলত একটি কৃত্রিম হ্রদ। সমগ্র রাঙ্গামাটি জেলা জুরেই এ জলাধারটি ব্রিস্তৃত। যার অন্তরভুক্ত উপজেলা সমূহ হলঃ- রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, বরকল, নানিয়ারচর, লংগদু, জুরাছড়ি, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি।
কর্ণফুলি নদীর পানি দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য তৎকালীন ইংরেজ সরকার ১৯০৬ সর্ব প্রথম জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাবতা যাচায় করে। পরে পাকিস্তান সরকার অ্যামেরিকার অর্থায়নে ১৯৫৬ সালে কাপ্তায় বাধ নির্মান শুরু করে এবং ১৯৬২ সালে এর নির্মান কাজ শেষ হয়। ৬৭০ দশমিক ৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪ দশমিক ৭ মিটার উচ্চতার এ বাধ’টি নির্মান করে, ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং উটা ইন্টারন্যাশাল ইন কর্পরেটেড। কর্ণফুলি নদীর উপর কাপ্তাই বাধ নির্মান করার ফলে রাঙ্গামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে গিয়ে এ হ্রদের সৃষ্টি হয়। কাপ্তাই লেকের সর্বনিম্ন গভীরতা প্রায় ৩০ ফুট এবং সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ১০০ ফুটের উপরে। রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার শুভলং্যের কাছে প্রথমে বাধ নির্মানের পরিকল্পনা থাকলেও সেখানে বাধ দিলে ভারতের মিজোরামের আংশিক অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই ভারত সরকারের আপত্তির মুখে পরবর্তিতে কর্নফুলী নদীর আরও ভাটির দিকে কাপ্তাইএ বাধ নির্মান করা হয়। কাপ্তাই বাধ নির্মানের ফলে পার্বত্য চট্রগ্রামের মোট ৩৬৯ মৌজার মধ্যে ১২৫টি মৌজা পানির নিচে তলিয়ে যায়। হ্রদ সৃষ্টি হবার কারনে পুরনো রাঙ্গামাটি শহর পুরোটাই পানির চিয়ে তলিয়ে যায়। বাধ নির্মানের পূর্বে মাত্র ২৫০ বর্গ মাইল এলাকা ডুবে যাওয়ার পূর্বাভাষ দেয়া হলেও বাধ নির্মান শেষে ৩৫০ বর্গমাইল এলাকা ডুবে যায়।
এছাড়া এ এলাকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ
সরকারী ভাবে সংরিক্ষিত বন ভূমির ২৯ বর্গমাইল এলাকা
ও অশ্রেনীভুক্ত ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চল পানিতে ডুবে যায়।
সে সময় প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের ১ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ১৯৭০ সালে ফার্ক ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্ণ ফুলী প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পূরন হিসেবে ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হলেও পাকিস্তান সরকার মাত্র ২ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার ব্যয় করে। বর্তমানে কাপ্তাই লেক রাঙ্গামাটি জেলার একটি গুরুত্বপূর্ন সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। এ জলাধারে প্রচুর পরিমানে মিঠা পানির মাছ চাষ হয়। কাপ্তাই লেক থেকে বার্ষিক মৎস্য উৎপাদনের পরিমান ৭ হাজার টনেরও বেশি। তবে গবেষকরা মনে করেন আনুমানিক ৯০ বছর পর হ্রদটি তলদেশে পলিমাটির আস্তরন জমে সম্পূর্ন লেকটিই মাছ চাষের অনুপযুগী হয়ে উঠবে। কাপ্তাই লেকের মাধ্যমে সমগ্র রাঙ্গামাটি জুরে একটি বৈচিত্রপূর্ন ও দীর্ঘ জলপথের সৃষ্টি হয়েছে। এ হ্রদ সৃষ্টির পূর্বে যেসব জায়গায় পায়ে হেটে যেতে এক দিনেরও বেশি সময় লেগে যেত এখন সেখানে স্পিড বোর্ডে বা লঞ্চে মাত্র কয়েক ঘন্টায় যাওয়া যায়। এছাড়াও সমস্ত হ্রদটি নৌবিহারের জন্য পর্যটকদের জন্য একটি আকর্শনীয় স্থানে পরিনত হয়েছে।