কালি: কালো মেয়েদের সামাজিক অবস্থা

কালির বয়স ২১ হতে চলল। বাপ মা হারা অনাথ মেয়ে বাপটা জন্মের আগেই কলেরায় মারা গেছে। জন্মের সময় মা মারা যায়। বাপ মা হারা অনাথ মেয়ের তাই ঠাই হয় কাকা কাকির বাড়িতে। একেই তো চাল চুলোহীন অনাথ মেয়ে , বাপ মাকে কিছু রেখে যেতে পারেনি আবার গায়ের রঙ যে কৃষ্ণ বর্ণের, তাই একরকম বিরক্ত হয়েই কাকি তার নাম রাখে কালি। কালি বড় হতে লাগলো তার কাকা কাকির অপমান অবহেলা আর অত্যাচারে। বাড়ির সকল কাজ একা একাই করতো কালি।

যেন বিনে পয়সায় কাজের লোক কাকা কাকি ঠিকমত খেতে দিত না এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে কিছু যা পেতো তা খেয়েই চলতো কালীর। কাকা কাকির এরূপ আচরণ হলেও খুড়তুতো ভাই বোন আর গ্রামের সবার ভালোবাসা সে যেন পরিপূর্ণ। গ্রামের পশু- পাখি, গাছপালা, নদী -নালা, খাল -বিল মায়া ডোরে বেঁধে রেখেছে যেন কালিকে। কালি চাইলেও এ বাধন খুলতে পারবে না।

এ যেন নাড়ির টান। কালির পড়ালেখা করতে খুব ভাল লাগে। বাপ-মাহারা নিঃস্ব মেয়েকে কাকা কাকি যে, দয়া করে থাকতে দিয়েছে এই তো অনেক পড়ালেখা করাবে এটা ভাবাই তো কালীর কাছে বিলাসিতা। তবে খুব তো দাদা বিনুর কাছেই তার হাতে খড়ি হয় সংগোপনে। সাথে ঘুরতো তো দিদি রমার কাছ থেকে বিভিন্ন হাতের কাজ ও কুটির শিল্প তৈরি শিখে খালি। বিনু দাদার নয়নের মনি কালী। বিনু খুব ভালো ছাত্র। গ্রামের সবার গর্ব বিনু। কালীরো তার বিনু দাদাকে নিয়ে অহংকারে শেষ নেই।

বিনুর থেকে সংস্কৃত বাংলা ইংরেজি শিক্ষায় পটু হতে থাকে কালী। অন্যদিকে কালীর হাতে তৈরি শিল্প রমা দিদির “রমা কুটির শিল্প” নামক সংস্থায় বিক্রি হত। যেখানে গ্রামের বহু অবলা মেয়ে বউ কাজ করে স্বাবলম্বী। এভাবে বিনু আর রমার সাহায্যে কালির মাঝে শিক্ষার আলো ও স্বনির্ভরতার সৃহা জন্মাতে শুরু করে। এরই মাঝে বিনু দাদার বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ হয়ে গেল। মিনু যাবার বেলায় কালিকে বলে গেল নিজের খেয়াল রাখিস। আমার কাছে নিয়মিত পত্র লিখিস। কোন সমস্যা হলে রমাকে জানাতে ভুলিস না।

কালী কিছু বলল না শুধু কেঁদে গেল, আর বিনুদাদা যাবার পথে চেয়ে রইল। বিনু বিদেশ যাবার কিছুদিনের মাঝে রমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল পাশের বাড়ির রিমাইয়ের সাথে। রিমাই বড় ব্যবসায়ী সাথে পাত্র হিসেবে খাসা বলা চলে। মহাদুমধামে রমা রিমাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়েতে সব কাজ কালি একাই করেছে , আমার অগোচরে। কেননা রমা জানলেই কাকির সাথে অশান্তি করতো। আর কালি এই আনন্দের দিনগুলোতে কোন অশান্তি হোক চাইনি। রমা বিয়ে করে চলে যায় শ্বশুরবাড়ি।

যদিও পাশের বাড়ি তাও রমা ও বিনু দাদাকে হারিয়ে কালী নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। আর রমা বিনুর অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কাকা কাকি কালির উপর অত্যাচার বাড়িয়ে দেয়। এভাবে কেটে যায় কিছুদিন। রমা বাপের বাড়ি আসে। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম  নিয়ে রমা কালি কে জিজ্ঞেস করে, কিরে ভুলে গেলি রমা দিদিকে? একবারও দেখা করতে যাস না,আবার তোর হাতের তৈরি শিল্প দিচ্ছিস না কিছুদিন যাবত। কি হয়েছে ? কথা বলতে বলতে রমা খেয়াল করল কালির হাতের কালশিটে দাগ।

জিজ্ঞেস করতেই কালি বলে উঠলো পুকুর পাড়ে পড়ে গিয়ে এ হাল হয়েছে। আর এ কারণেই যায়নি রমা দিদির কাছে সে কিছুদিন। আসলে তা নয়, কাকি তাকে মেরেছে চেলা কাঠি দিয়ে। ভাত রাধতে দেরি হয়েছে বলে। আর এ কারণেই এই কালশিটের দাগ। তবে কালির মুখের কথায় বিশ্বাস করে চলে গেল তার রমা দিদি। এদিকে প্রায় প্রতিদিনই কালিকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। তবে কথায় আছে না, অভাগা যেদিকে তাকায় সাগর শুকাইয়া যায়। কালীর ক্ষেত্রেও ঠিক সেই দশা।

তার গায়ের রং এর কারণে কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। যা হোক দুই এক জন রাজি হয়, তবে মোটা অংকের যৌতুক দাবি তাদের। আর কাকীমা এ চালচুলহীন মেয়েকে যে ঘরে এতদিন ঠাই দিয়েছে, খাইয়ে বড় করেছে ,এই ঢের। আবার নাকি দেবে যৌতুক। দরকার হয় বিক্রি করে দেবে কালিকে। তাও এক পয়সা জন্য খরচ করতে নারাজ কাকা কাকি। অবশেষে ৫০ বছরের এক বুড়ো তিন ছেলে মেয়ের বাপের সাথে বিয়ে ঠিক হল কালির।

Related Posts

1 Comment

মন্তব্য করুন