সেই আদিকাল থেকেই মানুষ ধারণা করে আসছে সুখী থাকতে হলে প্রচুর পরিমাণে টাকা পয়সা থাকতেই হবে। আর টাকা পয়সা অর্জনের জন্য চাই বেশি বেশি জ্ঞান অর্জন আর উচু মাপের চাকুরি। তবে, আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্য যে, এসব থিউরি বা চিন্তাধারা বাস্তবে তেমন কার্যকর দেখা যায় না, যেরূপ মানুষ যুগ যুগ ধরে কল্পনা করে আসছে। দেখা যায় অনেক বিত্তশালী লোকও সুখের অভাব আর অশান্তিতে আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে। সংখ্যাটা বিত্তহীন মানুষদের থেকে বেশি বৈ কম নয়। তাহলে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়- টাকা হলেই কি সুখে থাকা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর প্রদানের প্রায়াশে আমার দেখা বাস্বব কিছু ঘটনা উল্লেখ করবো, যেন সুখের সংজ্ঞা কিছুটা অনুমান করা যায়। তাহলে চলুন ঘটনাগুলো দেখে নেয়া যাক-
ঘটনা-০১: করোনার কয়েকমাস পূর্বে আমি আইডিবিতে স্কলারশীপ পেয়ে ঢাকায় যাই ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এর উপর ফ্রি প্রশিক্ষণ নিতে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, উক্ত প্রতিষ্ঠানটি সৌদি আরবের ওয়াকফকৃত ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত দরিদ্র ও মেধাবী মুসলিম ছাত্রদেরকে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। যাই হোক, সেখানে আমাদেরকে যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দিতেন, তার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্লাসের ফাঁকে তার মায়ের প্রসঙ্গ তুলেলনে। আলাপ আলোচনায় জানতে পারলাম যে, তার ফ্যামিলির সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং চাকুরিজীবী। তার বড় ভাই স্বপরিবারে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
তার স্ত্রীও একটা চাকুরি করছে। আর এদিকে তিনি আমাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। সুতরাং অসুস্থ মাকে দেখার এবং সেবা করার মতো তার বা কারও সময় নেই। আলাপে আরও জানতে পারলাম যে, তার মায়ের সাথে আছে শুধুমাত্র কাজের এক মেয়ে। সে-ই তার সার্বক্ষনিক দেখাশুনা করছে। চিন্তা করে দেখুন, একজন মুমূর্ষূ মা এই দূরাবস্থায় সন্তানদেরকে দেখার জন্য কতটা ব্যাকুল থাকে। সন্তানদের খেদমত পাওয়ার জন্য কত উন্মুখ থাকে, সন্তানদের ভরসা আর উৎসাহ তখন কতটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু তার কি দূর্ভাগ্য যে, সন্তানরা সবাই প্রতিষ্ঠিত! যার কারণে এই মৃত্যুপথযাত্রী অসুস্থ মাকে সময় দেয়ার মতো কারও সময় নেই। যে পিতা-মাতা সন্তানদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আজীবণ চেষ্টা করেছে সেই পিতা মাতার খেদমত করার মত, তাকে এক নজর দেখার মতো তাদের আজ সময় নেই! তাহলে মা তার সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করে কি পেলো?
ঘটনা-০২: ময়মনসিংহের একটি প্রাইভেট মাদসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করি। করোনার সময় তখনও মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়ে যায় নি। একদিন মাদরাসায় গেলাম পরিচিত ছাত্র-শিক্ষকদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য। সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎ হলো মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও প্রধান শিক্ষকের সাথে। আলাপ করে জানতে পারলাম যে, তার পিতা সম্ভবত করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা অতংক ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে হাসপাতালে ভর্তি না করিয়ে গুপনে ডাক্তার দেখিয়ে কিছুদিন ময়মনসিংহে চিকিৎসা নেন। কিন্তু রোগ না কমায় তার ছোট ভাই, ময়মনসিংহের বড় মসজিদ মাদরাসার শিক্ষক, মাদরাসা হতে ছুটি নিয়ে পিতাকে নিয়ে বাড়িতে চলে যান এবং সার্বক্ষনিক তার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন।
গুপনে ডাক্তার ম্যানেজ করে চিকিৎসা নিতে থাকেন। গ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে এবং পুলিশের অহেতুক বেরিকেডের ভয়ে এসব গুপন রাখেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও রোগ না কমায় এবং দিনকে দিন রোগ বাড়তে থাকায়, মাদরাসার মুহতামিম নিজেও অন্যান্য শিক্ষকদের উপর মাদরাসার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে পিতার সেবার জন্য গ্রামের বাড়িতে চলে যান। দুই ভাই রাত-দিন পিতার সেবায় নিযুক্ত হয়ে যান। বহু চেষ্টা, খেদমত আর দোয়ার ফলে তার পিতা একসময় সেড়ে উঠে। তার পিতা ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু দুই ছেলেকেই পড়িয়েছেন মাদ্রাসায়। বুঝতে পারলেন কি? কেন তার দুই ছেলেকেই মাদ্রাসায় পড়িয়েছিলেন? হয়তো বা তিনি এমন কোন চিন্তা করে ছেলেদেরকে পড়াননি। কিন্তু প্রতিটি কাজ তার ফলাফলেই প্রমাণ দেয়ে যে, তা লাভের না লসের।
ঘটনা-০৩: আমাদের গ্র্রামটি একেবারে অজপাড়া গায়। এখানকার মানুষ পড়ালেখার গুরুত্ব তেমন বুঝে না। তাছাড়া এখানাকার মানুষের আর্থিক অবস্থাও খুবই সূচনীয়। তাই কোনমতে ইন্টারে ভর্তি করিয়েই আমার ভাতিজীকে বিয়ে দিয়ে দিই লেখাপড়া না জানা, খেটে খাওয়া এক ছেলের কাছে। কিছুদিন আগে আমার ভাতিজীর ডেঙ্গুজ্বর হয়। ডাক্তারগণ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে শেরপুর সদর হাসপাতাল থেকে তাৎক্ষনিক ঢাকায় রেফার্ড করে দেন। ঢাকা হাসপাতালে তখন করোনা রোগির চাপ বেশি থাকায় তাকে রেফার্ড দিয়ে দেয় মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানে শুরু থেকেই তার সাথে অবস্থান করে তার মা, ফুফু শ্বাশুরি, আর তার স্বামী। তাছাড়া তার শ্বশুর ঢাকায় থাকার কারণে প্রতিদিন এসে খোঁজ খবর নিয়ে যায় এবং ঔষধ পত্র, ফলমূল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় পথ্য কিনে দিয়ে যায়। এতগুলো মানুষ তাকে সময় দেয়া সম্ভব হয় এ কারণে যে, কেউ শিক্ষিত নয় এবং চাকুরিজীবিও নয়। তাই তাদের কাছে সময়ের তেমন গুরুত্বও নেই। কিন্তু এদিকে আমি ছোটখাট একটা চাকুরিতে আছি বলে সময় করে দেখতে যাওয়ার ফুসরৎ পাচ্ছি না। কিন্তু আমার মা তো অতো শিক্ষিত আর চাকুরিজীবি নয়, তাই মা অতোকিছু বুঝে না, আমাকে দেখতে যাওয়ার জন্য বার বার তাগাদা দিতে থাকে। তাগাদার জোরে আমার সময় বেরিয়ে আসে।
ছোটকাল থেকেই ইসলামী শিক্ষা আর লেবাস বড় হওয়ার কারণে বিপদে আমাকে পরিবারের সবাই ভরসা মনে করে। বিশেষ করে দোয়া দুরুদ পড়ার কাজে। আমার ভাতিজী আমাকে দেখে যেন আমাকে দেখে যেন প্রাণ পেলো। দেখা করতেই বলে উঠলো- “কাকা দোয়া পড়ে আমার শরীরে একটু ফুঁ দিয়ে দেন। আমার জন্য একটু দোয়া করেন, আমি যেন তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাই। ও কাকা! এতদিন হয়ে গেলো জ্বর এখনো কমছে না কেন? আমি কি আর সুস্থ হবো না? এসব বলতে বলতে তার চোখ বেয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়। আমি কাছে গিয়ে দোয়া পড়ে শরীরে ফুঁ দিয়ে তাকে ভরসা দেই। দেখো মা, তোমার চারপাশের সবাই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত, প্রতিদিনই তো কত মানুষ সুস্থ হচ্ছে আর ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছো না? তাহলে তুমিও সুস্থ হবে, অত ঘাবড়িয়ে যাচ্ছ কেন? অসুস্থ হলে তো একটু খারপ লাগবেই! আমার কথায় সে বিরাট ভরসা পায়, মনে সাহস পায়। রাতে শুতে গিয়ে চিন্তা করলাম, যদি আমাদের পরিবারের সবাই সেই স্যারের মতো উচ্চ শিক্ষিত আর চাকুরিজীবি হাতো তবে কি এতগুলো মানুষ তাকে সময় দিতে পারতো? সুখ কী? টাকা? নাকি বিপদে কাছের মানুষগুলোর সান্বিধ্য পাওয়া আর ভরসার কথাগুলো শুনতে পাওয়া?