একবার এক গ্রামের সৌখিন মানুষজন শখ করে ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করলেন। পার্শ্ববর্তী গ্রাম এবং দূরদূরান্ত থেকে বেশ কয়েকটি ঘোড়া আনা হলো ঘোড়দৌড়ের জন্য। এরমধ্যে একটি ঘোড়া ছিলো ঐ গ্রামেরই এক খোঁড়া ফকিরের ঘোড়া। ঐ খোঁড়া ফকির তার ঐ ঘোড়ায় চড়ে সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করতো।
সেই খোঁড়া ফকির তো কোনমতেই তার ঘোড়া দিতে চাইছিল না, পরে গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি গিয়ে তাকে পাঁচকেজি চালের লোভ দেখানোর পর সে রাজি হয়। তবে সে শর্ত দেয় যে, কোনো অবস্থাতেই তার ঘোড়াকে গ্রামের বাইরে নেওয়া যাবে না আর খুব জোরে দৌড়ানোর জন্য জোরও করা যাবে না।যাহোক, তার সব শর্ত মেনে নেয়া হলো। পাঁচকেজি চাল নিয়ে তবেই খোঁড়া ফকির তার ঘোড়া গ্রামের মুরুব্বিদের হাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তুলে দিলো ঘোড়দৌড়ের জন্য।
ওদিকে পার্শ্ববর্তী গ্রাম এবং দূরদূরান্ত থেকে বেশ কয়েকটি তাগড়া ঘোড়া আনা হয়েছে ঘোড়দৌড়ের জন্য। দেখার মতো সেসব ঘোড়া। খোঁড়া ফকিরের ঘোড়া রুগ্ন, দুর্বল আর দেখতে একেবারে কাহিল অবস্থা। ঐসব তাগড়া ঘোড়ার পাশে খোঁড়া ফকিরের ঘোড়া দেখে মনে হচ্ছিলো ঘোড়া না, যেন ঘোড়ার এক নাদান বাচ্চা। যাইহোক, একসময় ঘোরদৌড় শুরু হলো।
খোঁড়া ফকিরের ঘোড়াসহ সেই আয়োজনে মোট ঘোড়া ছিলো বারোটি। অর্থাৎ খোঁড়া ফকিরের ঘোড়া ছাড়াও আরও এগারোটি ঘোড়া পার্শ্ববর্তী গ্রাম এবং দূরদূরান্ত থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছিলো। সবগুলো ঘোড়াকে একলাইনে দাঁড় করিয়ে গ্রামের মুরুব্বি হিসেবে চেয়ারম্যান সাহেব বাঁশি বাজাতেই দৌড় শুরু হয়ে যায়। চোখের নিমিষেই ঘোড়াগুলো গ্রামের রাস্তার বাঁকে বাঁশঝাড় ও গাছগাছালির আড়ালে চলে যায়।
এদিকে ঘোড়দৌড় উপলক্ষে গ্রামের মাঠে মেলা বসেছে। সেখানে লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবসহ গ্রামের লোকজন লাঠিখেলা উপভোগ করছে। লাঠিখেলা উপলক্ষে পাশের আরও অনেক গ্রাম থেকে লাঠিয়ালরা এসেছে। তারা লাঠিতে যেমন তেল মেখেছে তেমনি সারা শরীরেও তেল মেখেছে। জমে উঠেছে গ্রামবাংলার মানুষের চিরন্তন লাঠিখেলা।
এসব উপলক্ষে রীতিমতো একটা মেলা বসেছে। নানারকম দোকানপাট বসেছে। ছোটো বাচ্চাদের মনভুলানো নানারকমের মাটির খেলনা, ছোটো মেয়েদের চুড়ি, ফিতা, কানের দুলসহ নানা রকমের গয়না ইত্যাদি দেদার বিক্রি হচ্ছে। কোথাও আবার ভাপা পিঠা, তেলের পিঠা, খাজা-গজা, নারিকেলের মোয়া ইত্যাদি নানারকম খাবার দাবার বিক্রি হচ্ছে। সবমিলিয়ে একটা জমজমাট মেলা বসেছে সেখানে।
ওদিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঘোড়াগুলো নির্দিষ্ট করে দেওয়া এলাকা দৌড়ে ফিরে এসেছে। এর মধ্যে লাল একটা ঘোড়া সবার আগে ফিরে এসেছে। সেই ঘোড়া হয়েছে ফার্স্ট। এরপর সাদা একটা ঘোড়া এসেছে। সেটা হয়েছে সেকেন্ড। তারপর কালো একটা ঘোড়া এসেছে। সেটা হয়েছে থার্ড। ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড সবগুলো ঘোড়ার সহিসকে পুরস্কার দেয়া হলো। এরপর বাকি ঘোড়াগুলোর সহিসদেরও পুরস্কার দেয়া হলো।
তখন সবাই খেয়াল করে দেখলো খোঁড়া ফকিরের ঘোড়াটা এরমধ্যে নেই। সবাই যখন পুরস্কার নিয়ে চলে গেলো, মেলাও শেষ হয়ে গেলো প্রায়; তখন দেখা গেল খোঁড়া ফকিরের ঘোড়াটা কোনমতে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির। সেই ঘোড়ার পিঠে যে সহিস ছিলো সে রাগে গরগর করতে করতে বললো, আমাকে খোঁড়া ফকিরের এই অধম ঘোড়া কে দিয়েছে? আজ তার একদিন কী আমার একদিন।
তারপর চিল্লাতে চিল্লাতে সে আরও বললো, খোঁড়া ফকিরের এই অধম ঘোড়া আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে। এই গ্রামের সব বাড়িতে গিয়ে গিয়ে ভিক্ষা নিয়ে আমার অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে। ভিক্ষা ছাড়া তো এই ঘোড়া একচুলও নড়ে না কোনো বাড়ি থেকে। এই ঘোড়ার কারণে আমাকে ভিক্ষা পর্যন্ত নিতে হয়েছে। সাড়ে তিন কেজি চাল আর বারো টাকা আট আনা ভিক্ষা পেয়েছি আমি এই খোঁড়া ফকিরের ঘোড়ার কারণে। এই আমার কপাল! সবাই যখন ঘোড়া দৌড়ায় আর আমি তখন ভিক্ষা করি!!
সাইফুল হক : লেখক, সম্পাদক, গবেষক।
ঘোড়া, খোঁড়া ফকির, মজার গল্প, হাসির গল্প