জ্যোর্তিবিদ্যার জগৎ এতটাই বিস্তৃত যে একটা বিষয় সম্পর্কে জানতে গেলে,আরেকটি বিষয় সম্পর্কে জানতে দেরি হয়ে যায়। এই বিস্তৃত বিশাল মহাবিশ্বে এত ঘটনা ঘটে যে, এমন অনেক ঘটনা আছে বিঙ্গানীরা এখনো তার কারণ ও বের করতে পারেনি।তবে বিগত শতকে বিঙ্গানীরা আগিয়েছেন বহুদূর।আর আমরা আজকে যে বিষয় নিয়ে কথা বলবো তা হলো “হারমোনিক কনভারজেনস্”।হারমোনিক কনভারজেনস্ এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় গ্রহগুলোর একই সারিতে আসা বা ‘perfect alignment’. আমাদের সৌরজগতে যে আটটি গ্রহ রয়েছে তাদের কক্ষপথের দৈর্ঘ্য,বিন্যাস,কোণ সবই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের।তাই একই সারিতে কক্ষপথের একই জায়গায় আটটি গ্রহের মিলিত হওয়া একটু যেন বিস্ময়কর ও অসম্ভবপর ব্যাপার।তবে প্রথম যেবার বিঙ্গানীরা এই অবস্থাটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন,তা ছিল ১০০ AD ৯৪৯ সালে।তবে সেখানেও এত পরিপূর্ণভাবে গ্রহগুলো একই সারিতে আসেনি।হয়তো কিছু ডিগ্রি এর ব্যবধানে কাছাকাছি এসেছিল।এই অসস্থা আবার শেষবার যখন পর্যবেক্ষণ করা হয় তা ছিল ৬ মে,২৪৯২ সাল।তাই বোঝায় যাচ্ছে,গ্রহগুলোর একই সারিতে আসাটা কতটা দুর্লভ ঘটনা।তবে সর্বশেষ ২০০২ সালে বৃহস্পতি,শনি,মঙ্গল,বুধ,শুক্র প্রায় কিছু ডিগ্রির ব্যবধানে পর পর দেখা গিয়েছিল।এমন একটি ঘটনা আবার দেখা যাবে ৮ সেপ্টেম্বর ২০৪০ সালে।
এখন কথা হচ্ছে,এরকম কনভারজেনস্ বা একই সারিতে আসার জন্য পৃথিবীর উপর কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?পৃথিবী কি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে?অতিরিক্ত অভিকর্ষণ বলের কারণে স্রোতের টানে সব কিছু কি ভেসে যেতে পারে?উত্তর হচ্ছে না,এমন কিছুই হবার সম্ভাবনা নেই।কারণ সৌরজগতের গ্রহগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত।তাই একে অপরের উপর অভিকর্ষণ বলের পরিমাণ অতি ক্ষুদ্র।পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের গ্রহ শুক্র।তবে এই গ্রহটাও যখন পৃথিবী থেকে সবচেয়ে কম দূরত্বে থাকে তখনও এদের মধ্যে দূরত্ব থাকে প্রায় ৯২ মিলিয়ন কিলোমিটার।এমনিই অভিকর্ষ একটি দুর্বল বল,তার উপর এত দূরত্বে কোন পরিবর্তন ই অনুভূত হওয়াটা অসম্ভবপর।
এইরকম কনভারজেনস্ এর কারণে সর্বোচ্চ ২% পরিবর্তন হতে পারে জোয়ার ভাটাতে।সর্বশেষ ৪ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে যখন সূর্যের সাথে চাঁদ ও সৌরজগতের চারটি গ্রহ প্রায় কাছাকাছি এসেছিল তখন মাত্র ১৭° সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষিত হয়েছিল।
“লিজেন্ড অব কোরাতে ” হারমোনিক কনভারজেনস্ নিয়ে অনেক কিছু দেখানো হয়।এটি নিয়ে অনেক মিথ ও প্রচলিত রয়েছে।তবে লিজেন্ড অব কোরার মতো ওমন বিস্ময়কর শক্তির আবির্ভাব হারমোনিক কনজারজেনস্ এর কারণে সম্ভব নয়।
২১ ডিসেম্বর ২০২০:দুই গ্রহের মিলন
২১ ডিসেম্বর ২০২০ পৃথিবীর মানুষ সাক্ষী হতে যাচ্ছে আরও একটি মহাকাশের বিস্ময়ের।সৌরজগতের পঞ্চম ও ষষ্ঠ গ্রহ বৃহস্পতি ও শনি কাছাকাছি আসতে আসতে যুগ্ম গ্রহ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে এইদিন।বিঙ্গানীরা এটিকে ডাকছেন “Great Conjunction of Jupiter And Saturn”বলে।এই সময়ে এক ডিগ্রির দশ ভাগের একভাগ ডিগ্রির ব্যবধানে থাকবে বৃহস্পতি ও শনি।সবচেয়ে বড় কথা পুরো ডিসেম্বর জুড়ে খালি চোখেই এটি দেখা যাবে সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে।২১ ডিসেম্বর পশ্চিম আকাশে চোখ রাখলে কাছাকাছি দুটি জ্বলজ্বলে বস্তুর মধ্যে উজ্জ্বলতর টি বৃহস্পতি আর তার চেয়ে কম উজ্জ্বলটি শনি।আর কারও কাছে যদি টেলিস্কপ থাকে তবে সে শনির বেল্ট,এবং বৃহস্পতির বায়ুমন্ডল ও দেখতে পারবে।সাধারণত বৃহস্পতি ও শনি একই জায়গায় আসে প্রতি বিশ বছর পর পর।গাণিতিক ভাবে যদি দেখাতে চাই তবে-
বৃহস্পতি সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে 12বছরে
শনি একবার প্রদক্ষিণ করে 30 বছরে।
তাই বৃহস্পতি এক বছরে পার করে কক্ষপথের 30°
আর শনি এক বছরে পার করে কক্ষপথের 12°
তাই বৃহস্পতি এক বছরে আগিয়ে যায় (30°-12°=18°)
তাই 360° যায় 360°÷18°=20 বছর।
এইভাবে হিসাব করে যে তারিখ গুলোতে বৃহস্পতি ও শনির এই কনজাংশন ঘটা সম্ভব তা হলো-
মে 28,2000
ডিসেম্বর 21,2020
অক্টোবর 31,2040
এপ্রিল 7,2060
মার্চ 15,2080
তাই এই সব তারিখ গুলোতে সব সময়ই যে এই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় তা না।পর্যবেক্ষণ করা তখনই সম্ভব যখন পৃথিবী,বৃহস্পতি,শনি একই লাইনে থাকবে।আবার সূর্য যদি শনি ও বৃহস্পতির সাথে এক লাইনে চলে আসে তবে দিনের বেলা এমন ঘটনা ঘটে যা দিনের আলোয় দেখা সম্ভব হয় না।এইবার সূর্য, শনি ও বৃহস্পতি এর সাথে একই লাইনে নেই,তাই ঠিক সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে চোখ রাখলেই দেখা যাবে গ্রহ দুটিকে।
এবারের কনজাংশন আরও একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ।কারণ এবার মাত্র 0.1° দূরে থাকবে শনি ও বৃহস্পতি।এর আগে সর্বশেষ যত কম ডিগ্রি দূরে ছিল এই দুটি গ্রহ তা ছিল 3°। 0.1° বলতে আমরা একটি সহজ উদাহরণ দেখে আসতে পারি।সাধারণত পূর্ণ চন্দ্রের এক পার্ট এর সাথে আরেক পার্টের ব্যবধান থাকে 0.5°।অর্থাৎ শনি ও বৃহস্পতির মধ্যে ব্যবধান থাকবে পূর্ণ চন্দ্রের পাঁচ ভাগের এক ভাগ।
ঠিক এরকম বৈশিষ্ট্যের কনজাংশন দেখা যাবে মার্চ 15,2080।তাই প্রতিদিন চোখ রাখুন পশ্চিম আকাশে।
যদি আপনার ভালো লাগে মহাকাশের সব বিস্ময়কর ঘটনা তাহলে এটি মিস করবেন না।
আজকে এ পর্যন্তই।আবার নিয়ে আসবো মহাকাশের আরও অনেক বিস্ময়কর ঘটনা নিয়ে।