আমি রাকিব। চুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করছি। তাই বরাবরের মতোই একটু ওয়ার্কহোলিক মানুষ আমি। দিনরাত কাজ করতে হয় প্রজেক্ট নিয়ে। মাঝে মধ্যে জুনিয়র ভাই/বোনদেরকেও কাজে সাহায্য করার জন্য আমন্ত্রণ দিতে হয়। আমার লাইফস্টাইল জানতে চান? খাওয়া, ঘুমানো, ইবাদত করা আর প্রজেক্ট নিয়ে ব্যাস্ত থাকা; ব্যাস এটাই।
চেহারা আর ক্যারেক্টার দু’টোই ভালো হওয়ায় অনেক মেয়ের প্রপোজাল আসতো। ভালোও লাগতো কাউকে কাউকে। শুধু পরিবারের দিকে চেয়ে আর কোনদিকে এগোতাম না।
একদিন একটা বিয়ের দাওয়াত এলো; বাসায় এসে স্বপরিবারে উপস্থিত হওয়ার নিমন্ত্রণ দিয়ে গেলেন আমার মায়ের এক বান্ধবী। খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন আম্মু আর ওই আন্টি। আগামী শুক্রবার উনার বড় মেয়ের বিয়ে ছিলো।
আম্মু বিয়েতে যাবেন, সেটা কনফার্ম। কিন্তু একা যাবেননা। আমাকে যেতেই হবে। এদিকে প্রজেক্টের কাজ পড়ে থাকার কারণে আমিও বাহানা দেখাচ্ছিলাম, যাবোনা। আম্মুও নাছোড়বান্দা, যুক্তি দিচ্ছিলেন কিভাবে কাজ শেষ করে উনাকে নিয়ে যাবো। শেষমেশ রাজি হয়ে গেলাম।
আম্মু বিয়ের একদিন আগেই সেখানে চলে গেলেন আমাকে নিয়ে। উনাদের ঘরে ঢুকতেই আন্টির খুশি হওয়া দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই মূলত তিনি বেশি খুশি হয়েছেন। ভেবেছিলেন জোর করলেও আমি আসবোনা। কিন্তু মায়ের অতটা অবাধ্য আজ পর্যন্ত হতে পারিনি।
অল্পতেই নজর চলে গেল সুসজ্জিত একটা বেডরুমের দিকে। টাইটানিক সিনেমার নায়িকা রোজের বেডরুম যেমন, অনেকটা তেমন। আন্টি আমাদেরকে ওই রুমটাতেই বসতে দিলেন।
রুমে ঢোকা মাত্রই আমার একটু ঢোক গেলা হলো। আল্লাহর এক অতীব সুন্দর সৃষ্টির দিকে হঠাৎ চোখ পড়ায় দৃষ্টিটা একটুখানি অগোছালো হয়ে যায় আমার। নজরকাড়া সৌন্দর্য তার। জানতে পারি উনি আন্টির ছোট মেয়ে।
– আন্টি আপনারা এদিকে বসুন। আমি উঠি।
– আরে না না কিছু হবেনা। তুমি বসতে পারো।
প্রথমবার তার কন্ঠ শোনামাত্র আমি অভিভূত হয়ে যাই। মাশাআল্লাহ! এত সুন্দর চেহারার সাথে কন্ঠেরও এত সুন্দর মিল! সত্যিই আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার।
এভাবে করে তার প্রত্যেকটা কাজে কর্মে আমি মোহান্বিত হয়ে যাই। শুনলাম, সে নাকি অনেক ভালো নাস্তা তৈরি করতে পারে। চোখ হাঁটিয়ে দেখলাম তার ঘরের দেওয়ালগুলো কাগজের তৈরি সুন্দর সুন্দর ক্রাফ্ট দিয়ে সাজানো। একটু পর আন্টি এলে জিজ্ঞেস করি, তিনি বলেন ঘরের সৌন্দর্যবর্ধিত যেকোন কাজ তাঁর এই ছোট মেয়েটাই করে। সবই ইউটিউবের কারসাজি।
পরেরদিন সবাই বিয়েতে যাই। একটা মানসম্মত ক্লাবে ওর বড় বোনের বিয়েটা হয়। খাওয়া শেষে আমি একটু জিরোচ্ছিলাম গেস্টের সিটে। হঠাৎ সে আমার পাশে বসে পড়ে। তারপর প্রায় অনেকক্ষণ নিরব ছিলাম। শেষে নিরবতা সে নিজ থেকেই ভাঙ্গায়। ওই মেয়ের সাথে আমার প্রথম কথোপকথন ছিলো এইরকম,
– কেমন আছেন আপনি?
– জ্বী ভালো। আপনি?
– জ্বী বেশ ভালো। খেয়েছেন তো?
– জ্বী। আপনি খাননি?
– হ্যাঁ খেয়েছি। আপনার আম্মু কোথায়?
– আম্মু বোধ হয় আপনার আম্মুর সাথে আছেন। খুব ক্লোজ উনারা।
– জ্বী। আসলে, আমার কোন খালা নেই তো, আমার নানার একমাত্র মেয়ে আমার আম্মু। আপনার মায়ের সাথে অনেক আগের বন্ধুত্ব। তাই একেবারেই ছাড়তে চাচ্ছেননা আপনার আম্মুকে। কিছু মনে করবেননা।
– আরে নাহ্.. মনে করার কি আছে। আন্টি তো আমার আম্মুর মতোই, যেটুকু দেখলাম।
– জ্বী, আপনার আম্মুও অনেক ভালো, যেটুকু দেখলাম।
– হুম। আপনার আম্মুর মেয়ে আপনিও অনেক ভালো, যেটুকু দেখলাম।
– হিহি! আপনি যা বলেন তাই।
– হুম। কোন ক্লাসে পড়েন?
– আমি এইবার মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছি।
– হুম। ভালো মতো পড়েন তো?
– জ্বী। আপনি কোন ক্লাসে পড়েন?
– ইন্জিনিয়ারিং ৩য় বর্ষ।
– . . . .
– কি হলো কিছু বলছেননা যে?
– আমি ভেবেছিলাম আপনিও এবার এস.এস.সি দিবেন।
– হাহা! দেখতে এতই ছোট মনে হয় আমাকে?
– বড় ছেলেদের দাড়ি-মোচ দেখেছি। আপনার তা নেই।
– হাহাহা! তাই বলেই আমি মেট্রিক পরিক্ষার্থী?
– আরে না। বাই দ্য ওয়ে, আমি হাবিবা সুলতানা। দুইদিন আমাদের বাড়িতে ছিলেন, অথচ আপনার নামটাও শোনা হয়নি।
– আমি রাকিব সুলতান।
– ওয়াও! সুলতানার সঙ্গে সুর মিলালেন শেষ পর্যন্ত!
– হাহা! আপনার এই “ওয়াও” এক্সপ্রেশনটা দেখার জন্য বললাম। আসলে আমার পুরো নাম রাকিব রায়হান।
– হিহি! আপনি আর যাই হোন, খুব মজার মানুষ কিন্তু।
এটা বলেই অনেক মিষ্টি করে একটা হাসি দিল সে। এবার কিন্তু ঘন্টা বাজতে শুরু করলো আমার। একটু পর বুঝতে পারলাম, কিরে! আমি তো এরকম না! কত মেয়ে এলো গেলো কত মেয়ের দিকে চোখ পড়েও তা ফিরে এলো, কিন্তু এর প্রতি চোখ আটকালো কেন? বিবেককে নালিশ দিলাম আবেগের নামে, কেন এত তাড়াতাড়ি একটা মানুষকে সে পরিবর্তন করে ফেলে..
বিবেকও যেন আবেগের সুরে সুর মিলিয়ে বলছে, এই মায়াটা হরহামেশা পাওয়া যায়না। তাকে আবৃত করে নাও..
বিশ্বাস করুন, সেই থেকে আমাদের আড়াই বছরের রিলেশন, আর তারপর এই মেয়েই আমার বউ হয়ে আমার ঘরে আসে। আমি খুব লাকি এই মেয়েটাকে পেয়ে। আশা করি এসব প্রেমের গল্প তো প্রচুর শুনেছেন সবাই। তাই আমাদের প্রেম চলাকালীন কোন কথাবার্তা এখানে প্রকাশ করিনাই।
আজ আমার জীবনের একটা ছোটগল্প বলবো, শুনবেন? নতুন লাগতে পারে, আবার মিলেও যেতে পারে কারো সাথে।
হাবিবাকে বিয়ে করার পর খুব সুখেই দিন কাটতে লাগলো আমার। প্রত্যেকটা দিন যেন বসন্ত হয়ে নামতো আমার জীবনে।
কোন একদিন একটা অবসর মুহুর্তে সে আমার বুকে মাথা রেখে বলে,
– আপনার সাথে প্রতিটা দিনই আমার খুব ভালো কাটে।
– কেন? আগে ভালো কাটতোনা বুঝি?
– হ্যাঁ। কিন্তু..
– কিন্তু?
– আচ্ছা থাক বাদ দিন।
– বাদ দেওয়ার তো কিছু দেখছিনা। বলতে পারো। কিন্তুটা কি?
– না থাক। চলুননা আমরা কোথাও বেড়াতে যাই।
– তা তো যাবো। বলো কোথায় যাবে?
– আশে পাশে কোথাও নিয়ে চলুন। বেশি টাকা খরচ করতে হয়না এমন কোন জায়গায় চলুন।
– হাহা! ইঞ্জিনিয়ারের বউ হয়েও এমন কথা বলো?
– হুম। দেখলাম তো। পুরো দেশটাই চালাচ্ছেন আপনি। তাইনা?
– তা অবশ্য না। আচ্ছা এবার বলো একটু আগে কি একটা যেন বলতে চেয়েছিলে।
– . . . .
– আচ্ছা ঠিক আছে, সমস্যা হলে পরে বলিও।
স্বামী হিসেবে মনে একটু আঘাত পেলাম। সে কি সত্যিই আমাকে আপন করে নিতে পারেনি?
এরপরে একদিন,
সে হঠাৎ এসে আমাকে জরিয়ে ধরে কান্না করা শুরু করে দেয়। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। ফের তাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করি।
– কি হয়েছে আমার লক্ষ্মীসোনার? কান্না করছে কেন?
– . . . .
– আচ্ছা থাক। বলতে হবেনা। একটা কথা শুনবা?
– জ্বী
– কাল আমরা চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সি-বীচ যাচ্ছি। সাথে আব্বু-আম্মু আর আমার শশুর-শাশুড়িও..
– আমি যাবোনা প্রিয়।
– কেন প্রিয়তমা?
– না কিছু না।
– আচ্ছা, হঠাৎ কি এমন হলো যা আমাকে এতদিন ধরেও বলা যায়না?
– রাকিব, আমি আর বুকে চাপা দিয়ে থাকতে পারছিনা। তোমাকে আর ঠকাতে পারছিনা আমি।
– হাহা! আরে বলে ফেলো। কোন সমস্যা নেই। কোন নতুন রিলেশন?
– কখনো না।
– প্রাক্তন ডাক দিয়েছে?
– আমার প্রাক্তন নেই। তুমিই প্রথম তুমিই শেষ।
– তো কি হয়েছে যা আমার লক্ষ্মীসোনাকে কষ্ট দিচ্ছে? নির্ভয়ে বলে ফেলো..
– আসলে রাকিব….
– হুম..
– ক্লাস নাইনে থাকতে আমার রেপ হয়েছিলো।
– . . . .
– রাকিব, বিশ্বাস করবা, আমি একটা ছেলেকে বন্ধু হিসেবে ভালো জানতাম। তাকে ভালোবাসি কিংবা পছন্দ করি, এমনটা না। কোচিংয়ের পড়া রেডি করতে সে প্রায়সময়ই আমার সাহায্য নিত। আর মাঝে মাঝে আমারও প্রয়োজন হতো তার কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার।
– তারপর?
– তারপর একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে কোত্থেকে যেন সে এসে সামনে দাঁড়ায়। আমার পথ রোধ করে তার সাথে আরও কয়েকজন অচেনা ছেলেদের পাশে দাঁড়িয়ে রেখে জনসম্মুখে আমায় প্রপোজ করে। আমি তার মুখের উপর সেটা রিজেক্ট করে দিই।
– তারপর?
– তারপর আরো একদিন সে আমাকে ফলো করে আর বারবার রিকোয়েস্ট করতে থাকে, তার এক মামাতো বোনের জন্য শপিং করতে যাবে আর আমি যেন তাকে সাহায্য করি। আমি তাতেও মানা করে দিই এবং বলি যে, আমি এভাবে সাহায্য করতে পারিনা।
– তারপর কি হলো?
– সেই দুঃসময়টা আসলো..
– কিভাবে?
– যখন আমি হাঁটতে হাঁটতে এমন জায়গা পর্যন্ত পৌঁছালাম, যেখানে লোকালয় একটু কম, ওই ছেলে কোত্থেকে যেন তার সঙ্গীগুলোকে নিয়ে এসে আমার মুখ বেঁধে আমাকে একটা মাইক্রোবাসে তুলে নেয়।
– . . . .
– তারপর আমাকে ওদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে পশুর মতো..
– মুখটা একটু বন্ধ করো প্রিয়। আমি আর নিতে পারছিনা..
– (হাবিবা কান্নায় ফেটে পড়ে এবার..)
– কাঁদছো কেন প্রিয়? ওরা তো তোমাকে ধর্ষেণাই।
– (হাবিবা কাঁদছে..)
– ওরা ধর্ষেছে তো আমাকে। আমার অর্ধাঙ্গিনীকে। আমার নিয়তিকে। আমার ভবিষ্যতকে।
– (রাকিবকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে হাবিবা)
– কাঁদিওনা প্লিজ। আর কাঁদিওনা। তুমি কি ওদের কারো কোন প্রমাণ রাখতে পেরেছো?
– হ্যাঁ।
– আমাকে দিতে পারবা?
– হ্যাঁ।
– তাহলে এক্ষুণি দাও।
– অকালে কুমারীত্ব নষ্ট হওয়া এই অঙ্গটা ছাড়া আর কিছুই রাখতে পারিনাই আমি..
– . . . .
– তুমি আমাকে আজ বা কাল ডিভোর্সের জন্য নিয়ে যাবে তাইনা রাকিব? বিশ্বাস করো, ডিভোর্সের সময় আমি তোমার কাছ থেকে একটা কড়িও দাবী করবোনা। তুমি চিন্তা করিওনা।
– একটা চড় দেবো তোমাকে ডিভোর্সের কথা বললে।
– . . . .
– চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। কিন্তু চাঁদকে সেটা বলতে নেই। সে কষ্ট পেয়ে রাতের বেলা আলো দেওয়া বন্ধ করে দিলে কি হবে, ভেবেছো একবার? আজ থেকে তোমার প্রতিশোধ গুলো আমার। কখনো যদি পথেঘাটে, দোকানপাটে, পাড়া-মহল্লায় তাদের কোন একজনকে দেখতে পাও, সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা বের করে জাস্ট একটা ছবি তুলে নিবা। আমার আর কিছু লাগবেনা। দুনিয়াটা তাদের জন্য নরক বানিয়ে দেবো। আরেকটা কথা, ছেড়ে যাওয়ার কথা দ্বিতীয়বার বলবানা। আমি তোমাকে অর্জন করেছি। কাঠখড় কম পোড়াতে হয়নি। এখনও অনেক ভালোবাসা পাওয়ার বাকি আছে তোমার কাছ থেকে, যা এই জীবনে দিয়ে শেষ করতে পারবে কিনা সন্দেহ। অতএব, আমার পাওনা ভালোবাসাগুলো যাতে হারিয়ে না যায়, তুমি শুধু আমার..
ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করা রাকিব এখন রেপিস্টগুলোর সিরিয়াল কিলিং-এর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়..