ছোটবেলাতে টিভি দেখার প্রতি ভীষণ নেশা ছিল আমার। কিন্তু দূর্ভাগ্য, আমাদের নিজস্ব কোনো টিভি ছিল না। তাই কষ্ট করে দোকান-বাড়ি আর রাস্তার মোড়ে বসেই টিভি দেখতে হতো আমাকে। তারপরও টিভি দেখার প্রতি একচুল পরিমাণ অনীহা ছিল না মনে। আমাদের গ্রামে আমি এমন কোনো বাড়ি রাখিনি, যে বাড়িতে আমি একদিন কিংবা একরাত টিভি দেখেনি। তবে দিনে যেখানেই টিভি দেখি না কেন রাতে টিভি দেখার আমার একটা নির্দিষ্ট আস্তানা ছিল। আর সেই নির্দিষ্ট আস্তানাটা হলো আমার আপন চাচাতো ভাইয়ের বাড়ি।
আমাদের বাড়ি থেকে আমার সেই চাচাতো ভাইয়ের বাড়ির দূরত্বটা ছিল অনেকখানি। তারপরও ঝড়-বৃষ্টি কিংবা বাড়ির দূরত্ব কোনো কিছুই আটকে রাখতে পারতো না আমাকে। তো সে যাহোক, টিভি দেখার প্রতি এরকম নেশা ছিল বলে পড়াশোনা যে একদমই করতাম না, বিষয়টা তেমন নয়। পড়াশোনার প্রতি আমার আলাদা একটা টানই ছিল। তাই আল্লাহর রহমতে কোনো পরীক্ষাতেই কখনো খারাপ রেজাল্ট হতো না, প্রায় সব সাবজেক্টেই ৯৫ এর উপরে।
প্রতি রাতের ন্যায় সেদিনও টিভি দেখছিলাম বসে বসে। দিনটি ছিল রবিবার। আর রবিবার মানেই ‘সানডে ধামাকা’। প্রতি রবিবারেই টিভিতে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান হতো। আর সে দিনেও হচ্ছিল। তাই বসে বসে দেখছিলাম আর মজা নিচ্ছিলাম। ঘড়িতে সময় দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে, বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় আমার অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। অতিদ্রুত বাড়ি ফিরে যেতে হবে। কিন্তু তারপরও মন চাইলেও দেহ যেন তার আসন ছেড়ে উঠতে একেবারেই নারাজ। শেষমেষ যখন অনুষ্ঠান শেষ হলো, ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ঠিক দেড়টা বাজে। বুঝতেই পারছিলাম ভাগ্যে আজ খারাপ কিছু আছে। তবে কী আছে, সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ির গেটে গিয়ে যখন পৌঁছালাম তখন হাড়েহাড়ে টের পেলাম সেদিনের প্রাপ্তি। গেটে বাড়ির ভিতর থেকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন আব্বা। বুঝতে বাকি রইলো না, আজকে তাহলে বাকি রাতটুকু বাইরেই কাটাতে হবে!
শীতের রাত। সন্ধ্যা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত টিভির ঘরে ছিলাম বলে শীতের অনুভূতি ঠিক অনুভব করিনি। আর বাড়িতে আসার সময়ও চিন্তায় উত্তেজিত ছিলাম বলে শীতটা তেমন বুঝতে পারিনি। তবে বাড়ির গেটের সামনে এসে বাড়িতে ঢোকার ভাগ্যে তালা দেখে শরীরটা কেমন হিম হয়ে উঠলো আমার। আর সেইসাথে প্রকৃতির শীতও যেন বেশ করে চেপে ধরলো আমায়। এমন সময় চোখ পড়লো বাড়ির সামনে স্তুপ করে রাখা মসুর মাড়াই করা ভূসির দিকে। বসে পড়লাম তার উপরে।
এতক্ষণ বাড়িতে ঢোকার রাস্তা বন্ধের কষ্টে চারিদিকে ভালো করে তাকানো হয়নি। ভূসির ওপর বসে পড়তেই চোখ পড়লো আকাশের দিকে। কষ্টভরা মনে হঠাৎ যেন রোমাঞ্চ এসে নাড়া দিল। আকাশে একটা সুন্দর ফুটফুটে চাঁদ উঠেছে। যার সৌন্দর্য্য প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। এক মূহুর্তে ভুলে গেলাম বাড়িতে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমোতে না পারার কষ্ট।
এতদিন শুধু সন্ধ্যাবেলার চাঁদই দেখেছি। আর বইয়ে পড়েছি চাঁদের অপরূপ সৌন্দর্য্যরে বর্ণনা। বইয়ে চাঁদের অপরূপ সব সৌন্দর্য্যরে বর্ণনা পড়ে যখন সন্ধ্যাবেলার চাঁদ দেখতাম তখন মনে হতো, কবি-সাহিত্যিকরা মনে হয় কল্পনার উপর ভর করেই চাঁদ সম্পর্কে একটু বেশি বেশিই লিখে গেছেন। কিন্তু আজ এক পলকেই বুঝলাম কথাগুলো কত সত্যি!
বাড়ির পাশেই ছিল রেললাইন। ভূসির স্তুপ থেকে দাঁড়িয়ে রেললাইনে উঠে পড়লাম। রেললাইন থেকে চাঁদের সেই অপরূপ মহিমাময় সৌন্দর্য্যে প্রকৃতিকেও কী যে সুন্দর লাগছিল, তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি। রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি সাইরেন বাজিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে একটি ট্রেন। ক্ষণেকের জন্য মনটা যেন চুপসে গেল। মনে চিন্তা আসলো- এখন রাত দুইটা-তিনটা বাজে। এই সময়ে আমি যদি রেলাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে ট্রেনের মানুষগুলো কী ভাববে আমাকে দেখে! যদিও তাদের ভাবনাতে কিছুই হতো না আমার তবুও চক্ষু লজ্জার কারণেই লাইনের পাশে সোজা দাঁড়িয়ে থাকা বুনের ঝাঁড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম নিজেকে আড়াল করতে। বেরিয়ে আসলাম আবার ট্রেনটা চোখের সামনে থেকে সরে যেতেই। তারপর আবারও উঠে পড়লাম লাইনে আর সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম চাঁদের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে। এমনিভাবে বেশ কয়েকবার ঘটলো আমার আর ট্রেনের লুকোচুরি খেলা আর চাঁদের সেই অপরুপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করার মজা!