রুস্তম আলী এক নজরে তাকিয়ে বুলুর বেড়ে উঠা শরীরে দিকে তাকিয়ে ছিল।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হালকা থুথু নিক্ষেপ করল,তার আদরের বুলুর যদি আবার নজর লাগে।
তিনজনের ছোটো একটি সংসার রুস্তমের।রুস্তম, তার মেয়ে মালা আর বুলু।পেশায় দিনমজুর রুস্তমের এই ছোটো সংসারেও অভাবের কমতি নেই।তার স্ত্রী রমাও চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।দু’বেলা খাবার যোগাতে যেখানে ঘাম ঝরে, সেখানে চিকিৎসা বিলাসিতা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে রুস্তম বুলুকে তাড়া দেয়।
-বুলু চল,এবার বাড়িত যাই।
ঈদের যাকাতের টাকা আর মজুরি জমিয়ে বহু কষ্টে বছর তিনেক আগে বাছুরটিকে কিনে রুস্তম।আদর করে নাম রাখে বুলু।অবশ্য বুলু এখন আগের সেই ছোট্টোটি নেই।রুস্তম আর মালার যত্নে সে এখন তেজি ষাড়।
-কি রুস্তম,মাইয়ার বিয়া দিবা না?
আফতাব ঘটকের ডাক শুনে থামে রুস্তম।
-হ চাচা,দিমু।ভালা পাত্র পাইলে জানাইয়েন।
-ভালা পাত্র হাতে আছে।তয়, মাইয়া বিয়া দিবা হাতে ট্যাহা-পয়সা কিছু আছে?
-চাচা,এই কুরবানির হাটে ষাড়গান বেইচ্যা দিমু।
-ঠিক আছে,ট্যাহার বন্দোবস্ত কইরা জানাইয়ো।
-আইচ্ছা।
বুলুর বিক্রির কথা বলে নিজের অজান্তেই বুকটা কেপে উঠল রুস্তমের।সে কি আগে কখনো ভেবেছিল বুলুর বিক্রির কথা? তিনবছর ধরে তার সুখদুঃখের সাথি বুলু।তাকে ছাড়া রুস্তম থাকবে কিভাবে?
মেয়ের বিয়ের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত করে রুস্তম।গরীবের আবেগ থাকতে নেই।
-বাপজান,খাওন দিছি।খাইতে আহো।
-বুলুরে কিছু দেবার পারছ নাই মা?
-তোমারে তো কইছি,ভুষি ফুরায় গেছে।
-কি করুম মা,ট্যাহা পয়সা নাই।
-ভাতের মারের লগে লবণ পানি দিছি।
-আর একটা মাস কষ্ট কর মা।কুরবানির হাটে বুলুরে বেইচ্যা তোর ভালা এক্কান বিয়া দিমু।
কুপির আলোয় রুস্তম লক্ষ্য করল,মালার চোখ অশ্রুসিক্ত। রুস্তম না দেখার ভান করে খাওয়াতে মন দিল।
ঘুমানোর আগে রুস্তমের আজ তার স্ত্রী রমার কথা মনে পড়ছে।কত কষ্টই না করল তার সংসারের জন্য। অথচ ডাক্তারের দেয়া ঔষধ গুলো কিনে খাওয়ানোর সামর্থ্য ছিল না।আজ মালা আর বুলু দুজনই বড় হয়েছে। বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই মেয়ের বিয়ের আয়োজন নিজ হাতে করত।বুলুকে নিজ হাতে গোসল দিয়ে হাটে পাঠাতো।কষ্টে বুক ভার হয়ে যায় রুস্তমের।আবেগরূদ্ধ দৃষ্টি অন্ধকার ছাপিয়ে যেন অলীক দৃশ্যের অবতারণা ঘটায় তার চোখে-যাতে দেখা যায় রমার ফিরে আসা।
বুলুকে নিয়ে হাটে যাচ্ছে রুস্তম।মালা আদর করতে গিয়ে কান্না আটকে রাখতে পারেনি।কিন্তু রুস্তম পেরেছে।পুরুষের কাদঁতে নেই।
রুস্তম আলী বুলুকে বিক্রি করে দিয়েছে এক লাখ দশ হাজার টাকায়।একদিকে মেয়ে বিয়ে দেয়ার আনন্দ অন্যদিকে বুলুকে বিক্রির কষ্ট নিয়ে সে বাড়ি ফিরে।গরীবের আনন্দের সাথেও কষ্ট জড়িয়ে থাকে।
আজ মালার বিয়ে।পাত্রপক্ষকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। রুস্তম টাকাগুলো গুনে পাত্রপক্ষের প্রতিনিধিকে দেয়।প্রতিনিধি টাকা পেয়ে গুনতে থাকে।হঠাৎ বলে উঠে-এই ট্যাহা তো জাল!
রুস্তম কিছু বুঝে উঠতে পারে না।টাকার আবার জাল কি?
একে একে টাকাগুলো অনেকে দেখে।রুস্তম ঘরে রাখা অবশিষ্ট টাকা এনেও তাদের হাতে দেয়।সবাই দেখে নিশ্চিত হয়,মালার বিয়ের আয়োজনের দশহাজার টাকা বাদে এক লাখ টাকার সবগুলো জাল নোট।রুস্তমকে বুঝানো হয়,এগুলো নকল টাকা।এই টাকা দিয়ে কিছু কেনা যায় না।রস্তমের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়।
জ্ঞান ফিরলে সে দেখে মাথার পাশে বসে মালা হাতপাখা দিয়ে তাকে বাতাস করছে।এমন সময় তার মেয়ের বিয়ের কথা মনে পড়ে।মনে পড়ে, জাল টাকা নিয়ে হট্টগোলের কথা।তার এতদিনের চেপে রাখা কান্না বাধ ভেঙে বেরিয়ে আসে।অনেক সময় পুরুষের কান্নাও আষাঢ়ের ঢলকে হার মানায়।মালা তার বাবার বুকের উপর পড়ে।একসাথে কাঁদতে থাকে বাবা-মেয়ে।কেরোসিন কমে আসা কুপির নিভু নিভু আলো যেন তাদেরই সাথি।বুলুও কি দেখছে রুস্তম আর মালার কষ্ট…?
গল্পঃবুলু
লেখকঃমুহাম্মদ আসাদুজ্জামান