ভারতের আসাম রাজ্যের দিমা হাসাও জেলার বিস্ময়কর এক রহস্যময় গ্রাম জাতিংগা। এই জাতিংগা গ্রামে পাখিরা আত্মহত্যা করে। পাখিদের এই রহস্যময় আত্মহত্যা সারা পৃথিবীর পাখি বিশেষজ্ঞদের কাছে এক আশ্চর্য রহস্যময় বিষয়। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছ, কিন্তু আজ পর্যন্ত পাখিদের এই রহস্যময় আত্মহত্যার কোন কূলকিনারা হয়নি।
পাখিদের রহস্যময় এই আত্মহত্যা প্রতিবছর বর্ষাকালে খুব বেড়ে যায়। বিশেষ করে বর্ষাকালে রাতের বেলায় যখন গ্রামের কোথাও মশাল বা আলো জ্বালানো হয়, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা এসে সেই আলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। একটি দুটি পাখি নয়, শত শত হাজার হাজার পাখি একসাথে আগুনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। পাখিদের রহস্যময় এই আত্মহত্যার রহস্য উদঘাটনে অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, কিন্তু রহস্য আরও জটিল হয়েছে।
জাতিংগা গ্রামের বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানে বহুবছর আগে একবার এক লোকের একটা ভেড়া হারিয়ে গিয়েছিলো। সেই ভেড়া খুঁজতে রাতে একদল গ্রামবাসী মশাল হাতে পাহাড়ে গিয়েছিলো। তখন ছিলো বর্ষাকাল। হঠাৎ একঝাঁক পাখি উড়ে এসে সেই মশালের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সেই থেকে শুরু। তারপর থেকে অদ্যাবধি পাখিদের এই রহস্যময় আত্মহত্যা চলছেই।
এখনো প্রতিবছর বর্ষাকালে জাতিংগার পাখিদের রহস্যময় আত্মহত্যা দেখতে হাজার হাজার পর্যটক আসামের জাতিংগা গ্রামে যায়। সারাবছরই জাতিংগার বিস্ময়কর ও রহস্যময় পাখিরা আত্মহত্যা করে। তবে বর্ষাকালে তাদের আত্মহত্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বিশেষ করে বর্ষাকালের রাতে যখন বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিস্কার হয়ে আসে, তখন যদি কেউ মশাল জ্বালায়; তখনই জাতিংগার বিস্ময়কর পাখিদের রহস্যময় আত্মহত্যার আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে থাকে।
পাখিবিজ্ঞানীরা জাতিংগার পাখিদের রহস্যময় আত্মহত্যা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার পর বলেছেন, বর্ষাকালের রাতে যখন বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিস্কার হয়ে আসে; তখন যেকোনো কারণেই হোক, সেখানকার মাটিতে প্রচণ্ড ভূচুম্বকত্ব বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। আর সেই প্রচণ্ড ভূচুম্বকত্ব বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্যে কেউ মশাল বা আগুন জ্বালালে পাখিদের মধ্যে একধরনের চুম্বকীয় আবেশ তৈরি হয়।
আর এই চুম্বকীয় আবেশের কারণে পাখিদের মধ্যে আত্মহত্যার মারাত্মক প্রবণতা তৈরি হয়। যার কারণে পাখিরা দ্বিগ্বিদিক ভুলে ছুটে এসে আগুনে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে। তবে এর বিপরীতে যুক্তি হচ্ছে যে, শুধু বর্ষাকালেই বৃষ্টির পানিতে সেখানে প্রচণ্ড ভূচুম্বকত্ব বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সৃষ্টি হয়? বছরের অন্য সময়ে হয় না কেনো? বছরের অন্য সময়ে কী সেখানে ভূচুম্বকত্ব বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড থাকে না? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বিখ্যাত সব পাখিবিজ্ঞানীরা।
জাতিংগা গ্রামের মানুষ মনে করে, পাখিদের রহস্যময় আত্মহত্যা আসলে দেবতার অভিশাপ। কেউ হয়তো দেবতাদের কোনো কারণে ক্ষুণ্ণ করেছে, তাই দেবতারা পাখিদের রহস্যময় আত্মহত্যার মাধ্যমে তাদের শাস্তি দিচ্ছেন। তাই তারা দেবতাদের খুশি করার জন্য মন্দির নানারকম ভোগ দেয়। তারা পাখিদের রহস্যময় এই আত্মহত্যা নিয়ে সবসময় শংকিত থাকে।
যারা সেখানে থাকে না, তারা হয়তো মনে করতে পারে যে, পাখিদের রহস্যময় আত্মহত্যা নিয়ে শংকিত হওয়ার কী আছে? এটা তো খুবই আনন্দের ব্যাপার। রাতে আগুন জ্বেলে পাখির বার্বিকিউ খাওয়ার তো দারুণ সুযোগ আছে সেখানে। দূর থেকে এমনটা ভাবা খুব সহজ ও আনন্দের বিষয়। কিন্তু বছরের পর বছর সেখানে থাকলে পাখিদের রহস্যময় এই আত্মহত্যা আসলে খুব পেইনফুল একটা ব্যাপার।
তবুও কেউ যদি সেখানে যেতে চান, তাহলে বর্ষাকালে যাবেন। কেননা, বর্ষাকালেই জাতিংগার বিস্ময়কর পাখিদের রহস্যময় আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। আর জাতিংগা সিলেটের তামাবিল সীমান্ত থেকে বেশ কাছেই।
সাইফুল হক : লেখক, সম্পাদক, গবেষক।
পাখিদের আত্মহত্যা, জাতিংগা, রহস্যময়