সারা পৃথিবীতে এমন অনেকগুলো স্থান রয়েছে যেখানে আগে শহর বা জনপদ ছিলো এবং মানুষের কোলাহলে মুখরিত ছিলো শহরগুলো। বাড়িঘর রাস্তাঘাট রেল লাইন সবকিছুই মানুষ জীবন যাপনের জন্য তৈরি করেছিলো। কিন্ত বিভিন্ন কারনে এই শহর জনপদগুলো আজ পরিত্যাক্ত। আজ আপনাদের এমনই কিছু শহরের গল্প বলবো। যেগুলোতে একসময় লোকজনে ভরপুর ছিলো কিন্ত আজ সেটি পরিত্যাক্ত।
১. ফোরমানস্ক: একসময় মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ ছিলো এই শহরটি। দক্ষিন নামিবিয়ার নামি মরুভূমিতে রয়েছে এই পরিত্যাক্ত শহরটি। একসময় হীরা সমৃদ্ধ এলাকা ছিলো এটি। এখানে একজন রেলওয়ে কর্মী বালি পরিষ্কার করতে গিয়ে একটি হীরের টুকরা খুজে পান। তারপর হীরের টুকরা পাওয়ার জন্য পাগলের মত মানুষের আনাগোনা শুরু হয় এখানে। ১৯০৮ সালের দিকে জার্মানিরা এখানে বসবাস শুরু করে। এবং খুব দ্রুত মরুভূমির মধ্যে একটি জাকজমকপূর্ণ শহরে পরিনত হয়। স্কুল, হাসপাতাল, বিলাসবহুল আবাসিক ভবন সবকিছুই ছিলো এই শহরে। কিন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই খনিতে হীরের পরিমান কমে যেতে শুরু করে এবং শহরটিও আস্তে আস্তে খালি হতে শুরু করে। ১৯২৮ সালে এখান থেকে ২২৭ কিলোমিটার দূরে আরেকটি হীরের খনির খোজ পাওয়া যায়। ফলে ঘরবাড়ি যেমন ছিলো সেভাবেই ফেলে রেখে নতুন খনির লোভে শহর ছাড়ে মানুষ। এখন মরুভূমির বালি ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিয়েছে শহরটিকে।
২. পিপিয়েট শহর: পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত পরিত্যাক্ত শহরগুলোর মধ্যে পিপিয়েট শহর অন্যতম। সোভিয়েত ইউনিয়নের বেলারোস সীমান্তের কাছে তৈরি করা হয়েছিলো একটি নিউক্লিয়ার কেন্দ্র। এখানকার কর্মীদের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো পিপিয়েট নামক এই শহর। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল কর্মীদের ভূলের কারনে একের পর এক বিষ্ফোরন হতে শুরু করে নিউক্লিয়ার বোমা। বিষ্ফোরনের সময় মারা যায় মাত্র চারজন কিন্ত ক্ষতি হয় বিষ্ফোরনের পরে। পারমানবিক বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। যার ফলে অসুস্থ হতে থাকে এই শহরের মানুষ। প্রায় পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই দূর্ঘটনায়। এতবছর পর আজও বহুলোক সেই তেজষ্ক্রীয়তায় ভূগছে। তার পর থেকেই এই শহরটি পরিত্যাক্ত।
৩. গার্নেট: আমেরিকায় পরিত্যাক্ত এক শহরের নাম গার্নেট। এটি একসময়ে গোল্ডমাইন সম্বলিত বসবাস ও বানিজ্যিক এলাকা ছিলো। ধারনা করা হয় ১৮৯৮ সালের দিকে এখানে প্রায় এক হাজার মানুষ বসবাস করতো। তখন শহরটির নাম ছিলো মিচেলো। প্রায় দুই দশক পর খনির স্বর্ণ ফুরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শহরটি ফাঁকা হতে শুরু করে। এবং ধীরে ধীরে পরিত্যাক্ত হতে শুরু করে। এর মধ্যে ১৯১২ সালে এখানে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রায় অর্ধেক শহর ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে এটি সংরক্ষিত পর্যটন কেন্দ্র। প্রতি বছর প্রায় ১৬ হাজার পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন।
৪. গানকানজিমা: এটি জাপানে অবস্থিত। ১৮৫০ সালের দিকে একটি কোম্পানী দ্বীপটি কিনে নেয়ায় বসতি স্থাপন শুরু হয়। তারা সমুদ্র নিচ থেকে কয়লা অহরনের জন্য একটি প্রকল্প শুরু করেন। পরে ১৯১৬ সালে এখানে কংক্রিটের বড় বড় ভবন নির্মান করা হয়। শ্রমিকদের আবাসস্থল ও সামুদ্রিক দুর্ঘটনা থেকে তাদের রক্ষা করতে তৈরি করা হয়েছিলো এ শহরটি। ১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে জনবসতি ছিলো ৮৩৫ জন। তখনকার সময়ে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছিলো এটি। ১৯৬০ সালে মানুষ কয়লার পরিবর্তে তেল ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে কয়লার খনিগুলো একে একে বন্ধ ঘোষনা করা হয়। ১৯৭০ সালে এ কোম্পানীটিও অফিশিয়ালভাবে বন্ধ ঘোষনা করা হয়। যার ফলে শ্রমিকরা এ শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
৫. হাউডোয়ান: চীনের পূর্বাঞ্চলে একটি দ্বীপে অবস্থিত এই শহর। এটি পঞ্চাশ বছর আগেও মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ ছিলো। প্রায় দুই হাজার জেলে পরিবারের বাস ছিলো এই শহরটিতে। একটি বিশাল বন্দর হিসেবে বেড়ে উঠেছিলো শহরটি। এখান থেকে জেলেদের মাছের চালান চলে যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে। এখানকার বাসিন্দারা ভেবেছিলো এই শহরটি হয়তো সারাজীবন এমনই থেকে যাবে। কিন্ত ধীরে ধীরে বন্দরটি বন্ধ হয়ে যায়। জেলেরাও চলে যেতে থাকে শহর ছেড়ে। একসময় এই শরহটি পরিনত হয় পরিত্যাক্ত শহরে। এর মধ্যে প্রকৃতিও তার কাজ শুরু করে দেয়। লতাপাতা ও গাছপালায় ঢেকে যায় শহরটি। এই শহরটি এখন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। শহরটি নতুন করে গড়ে তোলারও কোনো উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি কারন এখানে নতুন করে গড়ে তোলার মতো অবশিষ্ট আর কিছুই নেই।