“ভালোবাসা কখন এবং কিভাবে মানুষের জীবনে আসে, তা বোঝা বড়ই, কঠিন। ভালোবাসা যেকোনোভাবে আসতে পারে, আর সেই ভালবাসায়, সৃষ্টি হয় কিছু গল্প!”
বাজারে গিয়েছে, বেলা তখন, দশটা বাজে। অবশ্য এই সময় আমার বাজারে যাবার সময় নয়। তবুও বাধ্য বাজারে আসতে হল। বাড়িতে মেহমান এসেছে হঠাৎ করে। বাবা কোন কাজে বাইরে গিয়েছিল। আর এমনিতেই আমি সকালবেলা খুব দেরি করে ঘুম থেকে উঠলাম সেদিন। মা”আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বাজার আনতে বললো। আমি বাজারে গিয়ে পৌছালাম দশটা বাজে। খুব তাড়াহুড়ো করছিলাম। অবশ্য হাতে তেমন কোন কাজ নেই তবুও অভ্যাসটাই আমারে এমন। কোন কিছুতেই মন বসেনা। মনটা সারাক্ষণ শুধু তুই তুই করে ঘুরে বেড়ায়।
কিন্তু তুই থেকে তুমি অব্দি তখন আমি পৌঁছায়নি। হতে পারে আমার একটু দেরি হচ্ছিল। দুনিয়ার মানুষগুলো তো এমনই, সবাইকে যেখানে যেতে হবে, সেখানে কেউ দুদিন আগে, আবার কেউ কেউ দুদিন পরে। যাবার সময় যখন চলে আসবে তখন আমরা সবাই চলে যাব। রেখে যাবো কিছু স্মৃতি আর কিছু গল্প। যাইহোক আমি বাজার প্রায় শেষ করে ফেলেছি। মোটামুটি যা যা কেনার ছিল সবই কিনে নিয়েছি। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম, টাকা তেমন একটা বেশি নেই। অবশ্য অন্যান্য দিন,বাজার করলে কিছু থাকে।
বাজার করার পর যে টাকাটা বাঁচে, সেটা আমি কোনদিনই বাড়িতে ফেরত দেই না। আর এই জন্য, বাড়ির কেউ আমাকে বাজার করতে বলেনা। অবশ্য সে ক্ষেত্রে আমার দুটো লাভ হয়। বাজারে গেলে লাভ হয় কিছু টাকা। আর বাজারে না গেলে বেঁচে যায় কিছু সময়। দুটোই আমার কাছে মূল্যবান। পকেটে হাত দিয়ে দেখি বাজার শেষ করবার পর মাত্র 50 টাকা বেঁচেছে। মনটা একটু একটু খারাপ। অন্যান্য দিনের চাইতে অনেক বেশি টাকা থাকে।
কিন্তু আজ তেমন একটা লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি 50 টাকা, দিয়ে কি করব সেটা ভাবছিলাম। হঠাৎ মাথার মাঝে বুদ্ধি এলো, এক কাজ করলে কেমন হয়। 50 টাকা ফোনে লোড দেই। আজকাল ফোনে অনেক টাকার দরকার হয়। সবকিছুতো ডিজিটাল। ডিজিটাল দুনিয়ায় চলতে গেলে এখন টাকা গুনতে হয়। এখানে টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। যাই হোক বাজার থেকে আমার বাড়ি বেশি দূর নয়। সে কারণে রিক্সা ভাড়া নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালাম না। পায়ে হাঁটার রাস্তা। 5 মিনিট হাঁটলেই বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায়।
আমার চা পান খাওয়ার কোন অভ্যাস নেই। ছোটবেলা থেকেই এগুলো ইগনোর করে চলেছি। অবশ্য এই জন্য বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে আমার কম কথা শুনতে হয় না। প্রায় প্রতিটা সময়ই তারা আমার এই নিয়ে আমার সাথে ঠাট্টা গুজব করে। তবুও বিষয়টা আমার কাছে খুব ভালোই লাগে। এজন্য আমার পকেট মানি খুব একটা লাগেনা। অল্প টাকা হলেই সুন্দরভাবে দিন পার করে দিতে পারি। যাই হোক অন্য কোন কিছু চিন্তা না করে, আমি সোজা একটি ফেক্সি লোডের দোকান চলে এলাম। লোডের দোকান টি আমার পূর্ব পরিচিত। দোকানের মালিক রাসেল ভাই।
উনি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। মাঝে মাঝে বাজারে আসলে রাসেল ভাইয়ের দোকানে কিছুটা সময় আড্ডা দেই। কিন্তু আজ বাড়িতে মেহমান আসার কথা। তাই সে দিক থেকে চিন্তা না করে আমি ফোনে লোড দেওয়ার কথা চিন্তা করলাম। কাল থেকে ফোনে টাকা নাই। কারো সাথে তেমন একটা যোগাযোগও করতে পারছিনা। আজকাল পকেটের টাকা না থাকলে চলে। কিন্তু ফোনে টাকাটা থাকতেই হবে।এটি এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মত হয়ে গেছে। হয়ে গেছে জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাকে ছাড়া আমাদের এক বেলাও চলে না।
সত্যি বলতে কি বিজ্ঞানের এই যুগে, সবকিছুই এখন স্মার্টলি চলে। আমিও তার বিকল্প কিছু ভাবিনা। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। দোকানে গিয়ে দেখলাম রাসেল ভাই কম্পিউটার চালাচ্ছেন। রাসেল ভাইকে গিয়ে বললাম, ভাই লোড দিতে হবে। ভাই কোন কথা না বাড়িয়ে, জিজ্ঞেস করল কত টাকা লোড দিব? আমি বললাম বেশি না ভাই, মাত্র 50 টাকা! রাসেল ভাই আমার মুখের দিকে ফিরে তাকালেন, উনি একটু ভেবেচিন্তে আমাকে বললেন, 50 টাকা লোট না দিয়ে, 48 টাকা দেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম 48 টাকা কেন? উনি সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন, আপনি জানেন না, আজকে 48 টাকার একটা ভালো অফার আছে। আমি ভেবে দেখলাম বিষয়টি মন্দ না।
আমি 48 টাকা লোড দিতে বললাম। রাসেল ভাই আমাকে 48 টাকা লোড দিয়ে দিলেন। আমি 50 টাকার নোটটি তাকে দিলাম। উনি 50 টাকার নোট 3 ড্রয়ারে রেখে, আমাকে একটি দুই টাকার নোট ফেরত দিলেন। আমি এবার একটু মনোযোগ দিলাম। রাসেল ভাই যে দু টাকার নোটে আমাকে দিয়েছেন, নোট একদম নতুন, চকচক করে উঠছে। আজকাল নতুন টাকা পাওয়াই যায়না। নতুন টাকার প্রতি আকর্ষণ সবারই থাকে। আর যদি সত্যিই একদম চকচকে হয় তাহলে তো কথাই নেই। ছোটবেলায় ঈদের সময় বাবার কাছ থেকে চকচকে নোট চাইতাম। এখন বিষয়গুলো মনে হলে হাসি পায়। তবে আজ আমি হাসছি না। তারা আছে। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে হবে না হলে মা বকাবকি করবে।
আমি দু টাকার নোট হাতে নিয়ে একটু দেখতে লাগলাম। তবে একটুখানি চমকে গেলাম আমি। দুই টাকার নোটের ঠিক উল্টো পাশে, কিছু একটা লেখা রয়েছে! স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটি কোন মোবাইল নাম্বার। আমি নটি হাতে নিয়ে, নাম্বারটি চক দেখতে লাগলাম। খুব অদ্ভুত একটি নাম্বার। পুরো নাম্বারটি ঠিক আছে। সাধারণত আমাদের ফোন নাম্বার গুলো, 11 ডিজিটের হয়ে থাকে। কিন্তু আমি নাম্বারটিতে 11 ডিজিট দেখতে পেলাম না।
নাম্বার টি সম্পূর্ণ ঠিক আছে, তবে লাস্ট এর একটি সংখ্যা নেই। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম। বিষয়টি আমি একটু সিরিয়াসলি নিলাম। আমার যে বয়স, তাতে বিষয়টি সিরিয়াসলি না নিয়ে উপায় ছিল না। আমার কাছে জিনিসটি খুব সুইট লাগছিলো। যিনি নাম্বারটি লিখেছেন তিনি খুব বেশি যে চালাক নয়, সেটি আমি বুঝে গিয়েছি।
কারণ লাস্ট এর একটি ডিজিট নেই। কিন্তু আমি যদি 9 বার ট্রাই করি তাহলে যেকোনো একটি নাম্বারে সেই নাম্বারটি মিলিয়ে যাবে। আমি খুব তাড়াতাড়ি অংকটি করে ফেললাম। ভাবলাম, জিনিসটি আমি বের করবো। নাম্বারটি কার হতে পারে। আমি বাড়িতে চলে এলাম। মেহমানরা কি চলে এসেছেন? এমন প্রশ্ন করার সুযোগ আমার তখন আর ছিল না। সারাদিন মেহমানদের সাথেই গল্পগুজব আড্ডা তে কাটালাম। বাড়িতে এসে আমি বাজারের আইটেম ঘটনাটিকে ভুলেই গিয়েছিলাম। মেহমানরা চলে যেতে, যেতে রাত্রি তখন ঠিক দশটা। আমি ঘুমোতে গেলাম রাত 11 টার পর। কিন্তু দুচোখে ঘুম আসছিল না। এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম। গরমের দিন গুলো তো এমনিতেই ঘুম আসতে একটু দেরি হয়।
কারেন্ট আছে ফ্যান ও চলছে তবুও চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ আমার সেই ফোন নম্বর টা এর কথা মনে হলো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ইস নাম্বারটি যদি কোন মেয়ে মানুষের হত। আমি নাম্বারটি কে রিচার্জ করতে লাগলাম। প্রতিবার আমি এক থেকে শুরু করে, একেকবার একেক জনকে কল করতে লাগলাম। প্রথমবার যোগ করলাম এক, দ্বিতীয়বার 2, তৃতীয়বার 3, এমনিভাবে আমি 9 পর্যন্ত যোগ করলাম।
প্রথম 24 বার চেষ্টা করার পর, আমি খুব একটা সফলতা পেলাম না।কিন্তু সপ্তমবার যে নাম্বার থেকে আমি ফোন করেছিলাম, সেটি কেউ রিসিভ করেনি তখন। বাকি সবগুলোই আমি চেষ্টা করে তাদের সাথে কথা বলেছি। তবে খুব বেশী ভাববার মতো তেমন কাউকে পাইনি। আমার শুধু বার বার মনে হচ্ছিল, “সেভেন ডিজিট”ওই নাম্বারটার কথা। কারণ তখনো ওই নাম্বারের ব্যক্তির সাথে আমার কথা হয় নি। মনে মনে খুব এক্সাইটিং হতে শুরু করলাম।
মনে মনে ভাবছিলাম যদি আমি যেমনটা ভাবছি তেমন হয়, তাহলে তো খুব ভালোই হতো।কারণ আমরা ছেলেরা মেয়েদেরকে খুব সহজেই পটিয়ে নিতে পারি। এটা আমাদের গড গিফটেড একটা গুণ। আর তাছাড়া ডিজিটাল যুগে এগুলো এখন একটা সাধারণ ব্যাপার। তবুও সাধারণ হলেও এ সমস্ত জিনিসের সাথে কানেক্টিং হতে ডিজিট লাগে। আমি বারবার ওই নাম্বারটিতে, চেষ্টা করতে লাগলাম। 17 বার চেষ্টা করার পর, অবশেষে ফোনটি রিসিভ হলো। ফোনটি যখন রিসিভ হলো প্রথম কণ্ঠস্বর শুনে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, মনে মনে আমি যে” তুই থেকে” তুমি কে “খুঁজে বেড়াচ্ছি, সেটা হয়তো আমি পেয়ে গেছি।
তারপর খুব বেশিদিন আমার আর কষ্ট করতে হয়নি। এই দুই টাকার একটি নোট থেকেই, আমার প্রথম প্রেমের শুরু। যায় এখন প্রণয় থেকে গড়িয়ে, মহা সমুদ্রের কাছাকাছি চলে এসেছি। এখনো সেদিনের ঘটনার কথা মনে পড়ে। সেদিন যদি আমি 48 টাকা লোড না দিতাম, তাহলে আজকের, আমার এই তুমি কি পাওয়া হয়তো, কখনোই সম্ভব হতো কিনা জানিনা। আর এই দুই টাকার নোটে লেখা আমার ভালোবাসা, এখন হয়ে গেছে একটি গল্প।
ধন্যবাদ, দুই টাকার নোট কে। দুটাকার নোট হয়তো একদিন উঠে যাবে, কিন্তু আমার ভালোবাসা উঠে যাবে কিনা সেটা কোনভাবেই গ্যারান্টি দিয়ে বলা সম্ভব নয়। তবে চাইবো, দুই টাকার নোটটি ও যেন চিরকাল থাকে, তেমনি ভাবে ভালোবাসাও যেন রয়ে যায় চিরকাল। এই ছিল আমার গল্প। দুই টাকার নোটে, লেখা আমার ভালোবাসা।