রতন, খুব সুন্দর মন মানসিকতার এক অসাধারণ ছেলে। ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরতে সে পিছুপা হয়নি। শিক্ষা দীক্ষায় খুব বেশি অগ্রসর না হলেও কর্মচাঞ্চল্যতা তাকে এনে দিয়েছিল জীবনের সাফল্য। ছোটখাটো চাকরি তার প্রথম জীবনের গল্প। অবশ্য রতনের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। যেভাবেই হোক তাকে জীবনে সফল হতে হবে। প্রতিজ্ঞা আর পরিশ্রম দুটোই তার মাঝে ছিল বিরাজমান।
দেখতে দেখতে কৈশোর পেরিয়ে কখন যে যৌবনে নৌকা ভাসিয়েছে তাছে খুব বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখেনি। পারিবারিক চাপে এক সময় বিয়ের কাজটি সম্পন্ন হয়ে গেল। কথায় বলে, জন্ম মৃত্যু এবং ভাগ্য সবকিছুই বিধাতার হাতে লেখা। রতনের বিয়ের ভাগ্যটা বোধহয় সেরকম ই ছিল। অল্প বয়সে কর্মের উন্নতিতে তার বউ ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন ছিল। সমাজের সবাই প্রশংসায় ভাসিয়ে দিল তাকে। অবশ্য প্রশংসায় ভাসাবার মতই অবস্থান এসে চলে এসেছিল।
তার মহল্লার সবচেয়ে সুন্দরী বউ ছিল তার। মেয়েটির নাম ছিল শাপলা। অসম্ভব সুন্দরী ও গুণবতী। অল্প দিনেই তার সৌন্দর্য ও গুণের খবর চারিদিকে চমকাতে লাগলো।হাটে কিংবা বাজারে যখন তার বউ এর প্রশংসা করা হতো তখন রতন মনে মনে খুব খুশী হত। আসলে কপাল থাকলে এরকম বউ জোটে কপালে। রতনের কপালটাও বোধহয় বিধাতার হাতে লেখা ছিল। সংসারে খুব বেশি স্বচ্ছলতা না থাকলেও দাম্পত্য জীবনে তারা খুব সুখেই দিন কাটাতে লাগলো।
হঠাৎ একদিন রতনের মাথায় সুবুদ্ধি হল। সে অনেক ভাবনা চিন্তা করে একটি নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। স্বদেশ ছেড়ে সে বিদেশগামী হবে। কারণ সেখানকার টাকার মান অনেক বেশি।ছোটবেলা থেকে পরিশ্রম এবং মেধার কারণে যে যোগ্যতা তার অর্জিত হয়েছে তা বিদেশে খাটালে অর্থের অভাব হবে না। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। অল্প দিনেই সবকিছু গোছগাছ করে ফেলল সে।
অবশ্য রতনের বিদেশ যাওয়ার জন্য তার বউ শাপলার অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল। স্বামীকে নানাভাবে সে অনুপ্রেরণা দিতে লাগল। কারণ একটাই আর্থিক স্বচ্ছলতা। অবশেষে রতন বিদেশ চলে গেল। প্রথম প্রথম খুব ভালো ফলাফল না করতে পারলেও কিছুদিনের মধ্যে সে বিদেশেও সফলতার বীজ বপন করে ফেলল। ধীরে ধীরে রতনের সংসারে ভাগ্যলক্ষী প্রসন্ন হতে লাগল। কাঁচা ঘর পাকা হল। সাদামাটা জীবন হলো রঙিন। এ যেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো। দেখতে দেখতে দু বছর চলে গেল। রতনের বাড়িটি এখন বিল্ডিং।
বাড়িতে আসবা পত্রের যেন দোকান সাজিয়ে ফেলেছে সে। অবশ্য প্রতিটা জিনিস তার স্ত্রী শাপলার হাতে গড়া। খুব বুদ্ধিমতি এবং রুচিশীল মেয়ে। দুজনের সামাজিক দূরত্ব থাকলেও মনের দূরত্বে তারা ছিল অনেক কাছাকাছি। প্রতিদিনই ফোনে তাদের কথা হতো। রতন বারবারই বলতো আর কিছুদিন থেকেই চলে আসবো দেশে। এর মাঝে নতুন এক সুখবর চলে এলো। রতন যে কাজটি করতো সে কাজ সে ছেড়ে দিয়েছে।আগের চাইতে প্রায় তিনগুন বেশী থাকায় সে এখন অন্য মালিকের কাজ করছে।
সংসার আরো ফুলে-ফেপে অস্থির হতে লাগল। এলাকার এখন টক অব দ্যা নিউজ এ পরিণত হয়েছে রতনের এই কর্মদক্ষতা। দিন গড়াতে লাগল সময় বয়ে চলতে লাগল তার নিজ নিজ গতিতে। মাঝে মাঝে তার দেশের জন্য মনটা ছুটে যেত। তবুও আর্থিক ঝলকানিতে কিছুটা কিছুটা হলেও সে রঙিন চশমা পড়ে নিয়ে সবকিছু ভুলে যেতে। কিন্তু, ভাগ্য যেখানে সুপ্রসন্ন সেখানে শনির আগমন অনির্ধারিত।
তিন বছর পরের কথা:
রতনকে, আনার জন্য তার বড় ভাই এয়ারপোর্টে অপেক্ষমান। ঘন্টা দুয়েক পর রতন বিমান থেকে নেমে এলো। কার মুখ দেখে মনে হল কিছুক্ষণ আগে, সে আগুনের তলদেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে। কোন কথা না বলে তারা আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়িতে উঠে বসে পড়ল। রতনের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।তার বড় ভাই ও বেশি কথা না বলে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল।অনেকদিন পরে দেখা হলেও দু’ভাইয়ের মধ্যে যে ভাবসাব সেটি দেখে মনে হচ্ছে না তারা সচ্ছল। গাড়ি এগোতে লাগলো। ঘন্টা দুয়েক পর গাড়ি যমুনা সেতু ক্রস করতে লাগলো।এই দুই ঘন্টা যাবৎ দু’ভাইয়ের মধ্যে তেমন কোনো কথা হলো না। রতনের গোমরা মুখটা এবার খুলতেই হলো।
ভাই: তুই কোন চিন্তা করিস না/
রতন: তোমরা থাকতে আমার এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল তোমরা তা কিছুই টের পেলে না?
ভাই: আমি থানায় মামলা করে দিয়েছি
রতন: মামলা করে কি হবে ভাই যা হবার তা তো হয়েই গেছে/মামলা করলে কি আর সবকিছু ফেরত আসবে?
ভাই: শাপলা যে এরকম একটি কাজ করবে তা আমরা কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি/ব্যাংক এবং বাড়িতে যে ক্যাশ পুরোটায় বলতে গেলে উধাও
রতন: চোখের পানি মুছতে মুছতে, যে ছেলের সাথে বেরিয়ে গিয়েছে সে কি আমার থেকে উত্তম?
ভাই: বাজারে একটি দোকান আছে/খুব ভালো চলে না/তবে খুব চতুর একটি ছেলে/শাপলা মাঝে মাঝে ওর দোকান থেকেই জিনিসপত্র কেনা কাটা করতেন/
রতন: আচ্ছা ভাই অন্যের ঘর ভেঙে তারা কি মজাটা পায়/এদের কি বিবেক বলে কিছু নেই? ওরা কি মানুষ? ভিতরের কলিজাটা কি একবারও কেঁপে উঠলো না/
ভাই: সবই বয়স বুঝলি রতন? তুই হয়তো অর্থকরী কামিয়েছিস /কিন্তু বউয়ের মন কামাতে পারিস নি/সারা জীবন শুধু টাকার পিছনে দৌড়ালে/শেষমেষ তোর “বউটাই” চুরি হয়ে গেল/
রতন: ভাই, এখন আমি কি করব?
(রতন এবং তার ভাই দুজন দুজনের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে) এরা হয়তো বিকৃত মন-মানসিকতার মানুষ নয়/তবে সমাজ বদলে গেছে/মানুষ বদলে গেছে/বদলে গেছে আমাদের চরিত্র/
এখানে একটি শাপলার কথা বলা হলেও, এরকম অনেক “শাপলা”কথার বেড়াজালে কিংবা ছলনার আশ্রয় চুরি হয়ে যাচ্ছে অবিরত। গল্পটি এখানে শেষ হতে পারত।
দুমাস পর শাপলা ফিরে এলো। যে ছেলেটির সাথে এসে গিয়েছিলো, নতুন স্বপ্নের নতুন বাসা বোনার জন্য, সেই ছেলেটি তার সব টাকা-পয়সা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এখন “শাপলা”সবকিছু হারিয়ে কলঙ্কের দাগ মাথায় নিয়ে সমাজের এক সামাজিক গল্প হয়ে বেঁচে রইল।